শ্রীনিবাস রামানুজন
পরাধীন ভারতে এই দেশেরই এক প্রাইমারী স্কুল। অঙ্কের মাস্টারমশায় ভাগ শেখাচ্ছেন স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর জন্য শিক্ষকমশায়রা নানান উদাহরণ দিয়ে বোঝান—এটাই শেখানোর নীতি। শিক্ষকমশায় উদাহরণস্বরূপ ছেলেদেরকে বললেন—আচ্ছা বলো দেখি, পাঁচটা কলা পাঁচজন ছাত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিলে প্রত্যেক ক টা করে পাবে? উত্তরে সবাই একসাথে বলে উঠলো—একটা। উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে এবার শিক্ষকমশায় আবার জিজ্ঞাসা করলেন-“আচ্ছা বল দেখি, এক হাজারটা কলা এক হাজার জন ছেলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকে কটা করে পাবে?” ছেলেরা সমস্বরে উত্তর দিল—“প্রত্যেকে একটা করেই পাবে।”এবার ওই ছাত্রদলের মধ্যে একটা ছাত্র হঠাৎ ওই শিক্ষকমশাইকে প্রশ্ন করে বসল – “আচ্ছা স্যার, শূন্যটা কলা শূন্য জন ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হলে, প্রত্যেকে কটা করে কলা পাবে।” প্রশ্ন শুনে বন্ধুরা সবাই হেসে উঠল—ভাবখানা এমন যে এটা আর কি কোনও প্রশ্ন হল। অঙ্কের মাস্টারমশাই কিন্তু প্রশ্নটার গুরুত্ব ও চিন্তার গভীরতা বুঝতে পারলেন। ছোট ছাত্রর কাছ থেকে এমন প্রশ্ন তিনি আশাও করেননি। এই অসাধারণ প্রশ্ন শুনে তিনি বুঝতে পারলেন যে এই ছাত্র ভবিষ্যতে নিশ্চয় বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ হবেন। সেদিন মাস্টারমশাইয়ের এই ধারণা কিন্তু মিথ্যে হয়নি। সেই ছোট ছাত্রই ভবিষ্যতে এক বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ হলেন শ্রীনিবাস রামানুজন।
শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজনের জন্ম ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দের ২২ শে ডিসেম্বর। তামিলনাড়ু রাজ্যের বিখ্যাত নদী কাবেরীর তীরে বর্ধিষ্ণু শহর এরোডে রামানুজনের জন্ম হয়। এরোড ছিল রামানুজনের মামার বাড়ী। ভারতের মন্দির স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত তাঞ্জোর জেলার প্রাচীন শহর কুম্ভকোনমে ছিল রামানুজনদের বাড়ী। তাঁরা ছিলেন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর বাবা ছিলেন এক কাপড়ের দোকানের সাধারণ কর্মচারী আর তাঁর মা ছিলেন ধর্মপ্রাণা ও ভক্তিমতি এক মহিলা। শৈশবকাল থেকেই রামানুজন শান্ত ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। সেজন্য বাড়ির ভিতরেই তাঁর অধিকাংশ সময় কাটত। রামানুজন অল্প বয়স থেকেই মায়ের কাছ থেকে স্ত্রোত্রপাঠ ও গান শিখেছিলেন। গীতা, বেদ, উপনিষদের বিভিন্ন বাণীও মুখস্থ ছিল বালক রামানুজনের। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, তামিল সাধুসন্তদের বাণী ও তিনি সুন্দরভাবে আবৃত্তি করতে পারতেন। পাঁচ বছর বয়সে রামানুজন কুম্ভকোনমের এক বিদ্যালয় ভর্তি হন। সেখানেই তিনি তামিল বর্ণমালা ও গণিতের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। এই সময়ই রামানুজন তার শিক্ষকদেরকে আকাশের তারাদের দূরত্ব ও আয়তন বিষয়ক নানান কঠিন প্রশ্ন করতেন। তাঁর এই মানসিকতা শিক্ষকদের খুবই মুগ্ধ করত। ছোটবেলা থেকেই বালক রামানুজন এত একাগ্রচিত্তে অঙ্ক করতেন যে সহপাঠী বন্ধুরা অনেক সময় দুষ্টুমি করে তার জামার ভিতরে ছোট ছোট পাথর ঢুকিয়ে দিলেও তিনি তা টের পেতেন না। মাত্র দশ বছর বয়সে এই প্রতিভাবান ছাত্র প্রাথমিক স্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। এরপর রামানুজন কুম্ভকোনমের হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে সংস্কৃতকে বেছে নেন। ওই স্কুলটিতে ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় পনেরোশো এবং শিক্ষক ছিলেন তিরিশজন। শিক্ষকরাই বিভিন্ন ক্লাসে পঠনপাঠন বিষয়ক রুটিন তৈরি করতেন। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রামানুজন একবার ওই রুটিন সুন্দরভাবে তৈরি করে দেন। তাঁর এই কাজের জন্য ছাত্র রামানুজন সমস্ত শিক্ষকের নজরে আসেন। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই রামানুজন গণিতের প্রায় সব শাখাতেই বিশেষ করে- জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সেই তিনি ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের লেখা গণিত বিষয়ক অনেক বই পাঠ করেছিলেন। এই সময় A synopsis of Elementary Results in Pure and Applied Mathematics বইটি পাঠ করে তিনি গণিতপাঠে অনুপ্রাণিত হন। এরপরই রামানুজন শুধু গণিত শাস্ত্র পাঠ নয়, গণিতে বিশেষ করে জ্যামিতি বিষয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তখন তিনি তাঁর ছোট এক নোটবুকে এক একটি উপপাদ্য নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে লিখে রেখেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় রামানুজনের এই নোটবুক পরবর্তীকালে বহু পন্ডিতের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে রামানুজন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ন হন এবং এর ফলে তিনি সুব্রমনিয়ম বৃত্তি লাভ করেন। এরপর রামানুজন কুম্ভকোনমের এক সরকারি কলেজে এফ.এ পড়ার জন্য ভর্তি হন। এখানেও গণিতের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে তিনি শারীরবিদ্যা বিষয়টি পড়তে খুবই ভয় পেতেন। প্রাণীদের দেহ কাটা ছেঁড়া করা তিনি পছন্দ করতেন না। তবে অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলো তেমন মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা না করার জন্য রামানুজন বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেন এবং এই ফেলের দরুন তাঁর বৃত্তিটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তার পড়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। কিন্তু তবুও এই বিরল প্রতিভার গণিত চর্চায় ভাটা পড়ল না। প্রথাগত সিলেবাসের গণিতচর্চা না করে তিনি গণিতের গভীরে গিয়ে গণিতচর্চা করতে লাগলেন। এই সময় নানা পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যাও এসে উপস্থিত হল। কিন্তু এইসব বাধাবিপত্তি তার গণিতচর্চার অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানল। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে রামানুজন বিখ্যাত গণিত অধ্যাপক ভি. রামস্বামী আয়ারের সংস্পর্শে আসেন। তারপর রামানুজন তাঁর গবেষণালব্ধ “পেপার”গুলির মধ্যে কয়েকটি বাছাই পেপার কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হার্ডির কাছে পাঠিয়ে দেন। হার্ডি ও রামানুজনের মধ্যে শুরু হল গণিতবিষয়ক পত্রালাপ। হার্ডির সঙ্গে রামানুজনের এই যোগাযোগের ফলে রামানুজনের জীবনটাই পাল্টে গেল। এর পর রামানুজন অধ্যাপক হার্ডিকে প্রায় একশোটি গণিত বিষয়ক পত্র পাঠিয়ে দিলেন। অধ্যাপক হার্ডি এতে খুবই উৎসাহিত হলেন এবং রামানুজনকে কেম্ব্রিজে আমন্ত্রণ জানালেন। রামানুজনও ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন এবং ধীরে ধীরে হার্ডি এবং রামানুজনের মধ্যে এক গভীর সম্পর্কও তৈরি হল। কেম্ব্রিজে রামানুজন কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং এই কারণে তিনি দারুণ অপুষ্টিতেও ভুগতে লাগলেন। রামানুজনের শরীর ভেঙে পড়ে ও তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। ১৯২০ খ্রীস্টাব্দে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে এই প্রতিভাধর গণিতবিদের জীবনাবসান হয়।
0 Comments