মান্ধাতার উপাখ্যান
বাংলায় একটি চালু প্রবাদ আছে- 'মান্ধাতার আমল'; যার অর্থাৎ অনেক পুরানো দিনের বা বহু পূর্ব থেকে যার অস্তিত্ব আছে। আসলে প্রাচীনকালে সত্যি-সত্যি, মান্ধাতা নামে এক রাজা ছিলেন। বিচিত্র তাঁর জন্মের ইতিহাস, তেমনি বিচিত্র, উজ্জ্বল ও বর্ণময় ছিল তাঁর জীবন কাহিনি ও চরিত্র। রাজা মাঙ্গাতা ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ, বিদ্বান, পরাক্রমী ও যশস্বী ব্যক্তিত্ব। তাঁর রাজত্বকাল করে, বা কোন সময়ে ছিল, তার যথাযথ ইতিহাস নির্ভর কাল-নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও মহাভারতের গল্পে তাঁর অস্তিত্ব বলে দেয় যে, এই রাজার রাজত্বকাল ছিল অতি প্রাচীনকালে। পৌরাণিক যুগে।
যাইহোক, এবার আসা যাক মূল গল্পে, যা মহাভারতের বনপর্বে 'একশো পঞ্চাশতম' অধ্যায়ে সংকলিত আছে।
যুধিষ্ঠির লোমশ ঋষিকে বললেন- “হে ব্রাহ্মণ! ত্রিলোক-বিখ্যাত রাজা যুবনাশ্বনন্দন মান্ধাতার বিষয়ে জানতে চাই। তিনি কিভাবে জন্মেছিলেন? শুনেছি তাঁর স্বর্গলোকে গতি হয়েছিল। তাঁর নাম মান্ধাতা হলো কেন ? দয়া করে আপনি মান্ধাতার চরিত্র বর্ণনা করুন।”
লোমশ মুনি বললেন- “হে রাজা! ইক্ষ্বাকু বংশে যুবনাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি এক হাজার বার অশ্বমেধ যজ্ঞ ছাড়াও আরও অনেক বড় বড় যজ্ঞ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সন্তানের মুখ-দর্শন সুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এভাবে চলার পর তিনি একসময় নিজের মন্ত্রীর হাতে রাজ্যভার ছেড়ে দিলেন। তারপর শাস্ত্র-নির্দিষ্ট বিভিন্ন অগ্নি-সংযম বিধি গ্রহণ করে বনবাসী হলেন।”
একদিন রাতে তিনি নির্জলা উপবাস পালন করার পর মহামুনি ভৃগুর আশ্রমে প্রবেশ করলেন। ঐ সময় মহাত্মা ভৃগু রাজা যুবনাশ্বের সন্তান কামনায় একটি যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞস্থলে একটি পবিত্র কলসিতে মন্ত্রঃপূত জল রাখা ছিল। রাজমহিষী সেই জল পান করে পুত্র লাভ করবেন— এই কারণে কলসিতে মন্ত্রঃপূত জল রাখা ছিল । মহর্ষিগণ সারাদিনের ক্লান্তিতে তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন। রাজা যুবনাশ্ব সারাদিন উপোসী এবং তার উপর নির্জলা ছিলেন। তাই ঐ রাতে তিনি ভীষণ পিপাসার্ত হয়ে পড়েন। তাঁর গলার স্বর শুকিয়ে গিয়েছিল। তবুও একফোঁটা জলের আশায় তিনি আশ্রম-মধ্যে ঢুকে ‘জল’, ‘জল’ বলে ক্ষীণকণ্ঠে চীৎকার করতে থাকেন। কিন্তু কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি। তিনি ঐ অবস্থায় ইতস্তত খুঁজতে খুঁজতে বেদীর উপর রাখা জলপূর্ণ কলসিটি দেখতে পান। তারপর কলসির সমগ্র জল পান করে তৃষ্ণা মেটান। এবং পরম তৃপ্তি লাভ করেন।
কিছুক্ষণ পর মহর্ষি ভার্গব ও অন্যান্য মুনিগণ ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে, কলসিটি জলশূন্য। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকেন যে, এই কাজ কার দ্বারা হতে পারে ? মহারাজ যুবনাশ্ব সেই সব আলোচনা শুনে বললেন- “হে মহর্ষিগণ! আমি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে ঐ জল পান করে ফেলেছি।”
ভগবান ভার্গব তখন বললেন- “হে রাজা! কলসির মধ্যে রাখা জল ছিল অত্যন্ত পবিত্র। আপনার পুত্র কামনায় আমি ঐ জলে ব্রহ্মস্থাপন করে রেখেছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল আপনার সহধর্মিণী ঐ জল পান করে পরাক্রমী, তপোবল-যুক্ত এক সুযোগ্য পুত্র প্রসব করবেন। ঐ পুত্র নিজের বাহুবলে ইন্দ্রকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু আপনি সেই জল পান করে গোটা পরিকল্পনাটি নষ্ট করে দিলেন। তবে এই ঘটনা থেকে বুঝলাম, দৈবাদেশ দুর্লঙ্ঘ্য, অখণ্ডনীয়। আমি নিশ্চিত ঐ জল পান করে যে ফল পাওয়া উচিত, আমরা তাকে আটকাতে পারব না। আপনি তৃষ্ণার্ত হয়ে আমার তপস্যা- লব্ধ মন্ত্রঃপুত জল পান করে ফেলেছেন। তাই আপনিই ওই রকম পুত্র প্রসব করবেন। ভয় পাবেন না। আমরা আপনার জন্য অদ্ভুত একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করব যাতে, আপনি গর্ভধারণের যন্ত্রণা না পান।
এভাবে একশ বছর অতিক্রান্ত হ'লে মহারাজ যুবনাশ্বের বাম পাশ ভেদ করে একদিন এক তেজস্বী সন্তান বেরিয়ে এলো। এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি প্রমাণ করলো তাপাবল কি অদ্ভুত এবং বিচিত্র। এতে মহারাজের না হ'লো কোন শারীরিক কষ্ট, না হালা বা প্রাণহানি। সেই বালককে দেখার জন্য স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র সেখানে হাজির হলেন। দেবতারা ইন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন- “দেবরাজ! কিং ধাস্যাত (কি পান করবে ?) বালক ?"
তাতে দেবরাজ তার মুখে তর্জনী ঢুকিয়ে বললেন- 'মাং ধাতা' (অর্থাৎ আমার আঙুল চুষবে)।
এভাবে দেবতারা বালকের নাম দিলেন, মাংধাতা, তা থেকে হলো ‘মান্ধাতা'। বালক সকল বেদ, ধনুর্বেদ, সকল দিব্যাস্ত্র, 'আজগর' নামের ধনু, স্বর্গের অমূল্য শর সকল এবং অভেদ্য কবচের অধিকারী হলেন। দেবরাজের আশীর্বাদে এই বালক মাত্র বারো দিনে বারো বছরের ন্যায় পূর্ণতা পেরেছিলেন।
পরে দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারা অভিষিক্ত হয়ে তিনি ধর্মের দ্বারা ত্রিলোক জয় করেছিলেন। তিনি সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল এবং তেজস্বী ছিলেন। তিনি প্রচুর যাগ-যজ্ঞ করেছিলেন। সবশেষে চয়ন ক্রতুর অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করে তিনি প্রভূত পুণ্যলাভ করেছিলেন, দেবরাজ ইন্দ্রের অর্ধেক আসন লাভ করেছিলন।
এই ধর্মাত্মা নরপতি একদিনেই জয় করেছিলেন গোটা পৃথিবী। তিনি ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে দশ হাজার পদ্ম গোধন দান করেছিলেন। একসময় একটানা বারোবছর অনাবৃষ্টি হয়েছিল, তখন এই মহাত্মা দেবরাজ ইন্দ্রের সামনে বৃষ্টি ঘটিয়ে জগতের কল্যাণ সাধন করেছিলেন। এই তেজস্বী রাজার যজ্ঞস্থান ছিল কুরুক্ষেত্রের মধ্যভাগে। মান্ধাতা সিংহাসনে বসেই পৃথিবী জয় সম্পন্ন করেন অতি সহজে। এরপর তিনি স্বর্গ জয়ে মন দিয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দ্র তাঁকে জানালেন, পুরো পৃথিবী তখনও জয় হয়নি, কেন না লবণাসুর তাঁর অধীনতা তখনো মেনে নেয়নি। তখন তিনি পুনরায় লবণাসুরকে জব্দ করতে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তবে সেই যুদ্ধ ছিল তাঁর শেষ যুদ্ধ। মান্ধাতা লবণাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
0 Comments