আদিবাসী ও গণ আন্দোলন

আদিবাসী ও গণ আন্দোলন



স্বনামধন্যা লেখিকা শ্রীমতী মহাশ্বেতা দেবী 'বর্তিকা' ৩৩তম বর্ষ জানুয়ারী-মার্চ '৮৯ সংখ্যার সম্পাদকীয় কলমে লিখেছেন, এখন সমগ্র আদিবাসী জীবনকে জানবার এক তীব্র আকাঙ্খার সময়। এ সংখ্যা বের করা আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। আমি জানি কেন আমার উদ্বেগ। স্বাধীন ভারতবর্ষে সুসভ্য প্রাচীন, মহান আদিম অধিবাসী আদিবাসীরা কোন স্বীকৃতি পায় নি। স্কুলে পাঠ্য ইতিহাসে লেখা হয় না আদিবাসী কৃষকদের সংগ্রামগুলি ভারতের স্বাধীনতার অঙ্গ। সাঁওতালী, গোল্ডী, কুরুখ, ওরাওঁ এসকল ভাষায় সিন্ধ্রি বা কাশ্মীরী ভাষার চেয়ে বেশী মানুষ কথা বলেন। তবু সে সব ভাষা স্বীকৃতি পায় না। পশ্চিমবঙ্গে, বিহারে, সাঁওতালি ভাষা সাহিত্যের চর্চা আছে। কিন্তু সাঁওতালি বা অন্য আদিবাসী সাহিত্য পত্রিকা চালান, বই ছাপাবার কোন সরকারী সাহায্য নাই। এটা ভারতীয় জনগণের এক বিশাল অংশকে স্বীকৃতি না দেবার নীতি। এ নীতির পিছনে কি অন্য নীতি নেই? আমি মনে করি, আদিবাসী ভাষাগুলিকে স্বীকৃতি দেবার সময় এসে গিয়েছে।

ভাষা বিষয়ে স্বীকৃতি দানে বিমুখতা, মানে মানুষগুলিকে অস্বীকার করা। আদিবাসীদের বিশাল ভূমিকাকে অস্বীকার করা।

এক সময় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ একই শাসনাধীনে ছিল। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ বলতে জানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা। উড়িষ্যায় আদিবাসী লাকসা সানা নায়েক-এর নেতৃত্বে কোরাপুট আন্দোলন হয়। যাহা আগষ্ট আন্দেলনের অঙ্গীভূত। অন্য একজন খ্যাতনামা আদিবাসী নেতা লক্ষণ নায়েক-এর নেতৃত্বেও আন্দোলন হয়। আদিবাসী নেতার পরিচালনায় লোধা, শবর, সাঁওতাল, ওরাওঁ ইত্যাদি আদিবাসীরা মাতালী থানা অবরোধ করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ছিল। কোরাপুটে ব্রিটিশ পুলিশের সাথে আদিবাসী জনতার সংঘর্ষ হয়। উড়িষ্যায় বেশ কিছু স্বদেশী রাজ্য থাকায় আদিবাসী আন্দোলন তেমন মারাত্মক আকার ধারণ করেনি।

১৯১৭ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ড অঞ্চ লে কৃষক আন্দেলন হয়। এ আন্দোলনে আদিবাসী নেতা রামেশ্বর সিং মুণ্ডা, হাদু কোল কামার-এর নেতৃত্বে মুণ্ডা, ওরাওঁ, ভূমিজ ও বিভিন্ন জনজাতির মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন করেছিল। এ কাহিনী ঐ এলাকার বয়স্ক মানুষের কাছে 'মেলি' বা 'মেড়ি আন্দেলন' নামে খ্যাত। রামেশ্বব সিং মুণ্ডা, হাদু কোল কামারসহ আরও কয়েকজন শহীদ হন। ১০০ জনের 

কারাদণ্ড হয়। যাবজ্জীবন দণ্ডিত হন ৩৭ জন। এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হন কয়েকশত মানুষ। এত বড় আন্দোলনের বিবরণ ইতিহাসে অপ্রকাশিত। এই প্রকাশিত বিবরণ মেড়ি আন্দোলনের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদযাপন কমিটির আলোচনায় শ্রুতিগোচর হয়েছে। তাই বিষয়টি তুলে ধরলাম।

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়ের লেখা 'গণ-আন্দোলনে সাঁওতাল সমাজ' পুস্তক থেকে জানতে পারি, অমিয় কিস্কু ১৯৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে সরকারী চাকরী পান নি। অন্যান্যদের ন্যায় আদিবাসীরা ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে ভারতমাতার কোলে জীবন আত্মাহুতি করেছেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা ভেবেছিলেন ভারতবাসীর কাছ থেকে সঠিক মর্যাদা পেয়ে ভাষা, সংস্কৃতি ও আর্থিক উন্নতি করবেন। দেশীয় সরকার সেভাবে কাজ না করে বঞ্চনার দ্বারা অবহেলা করে রেখেছে।

ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা ইতিহাস বঞ্চি ত ১৯০৮ সালে কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট অত্যাচারী কিংস ফোর্ডকে হত্যা করার জন্য শহীদ ক্ষুদিরাম বোসকে বোমা বাঁধা শিখিয়ে ছিলেন ভালুকবিধা গ্রামের ডমন হেমব্রম। মেদিনীপুর জেলার শেষপ্রান্তে ছেঁদা পাথর অঞ্চ লে তারা এক সময় রীতিমত বোমা বাঁধা ও ছোঁড়া শিখতেন। পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে ভরা নির্জন ঐ অঞ্চলটি ছিল নিরাপদ লোকালয় বর্জিত। পুলিশ এসব ঘটনা জানতে পেরে ডমন হেমব্রমকে পিটিয়ে হত্যা করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এরূপ মূল্যবান তথ্যকে ইতিহাসের পাতায় স্থান না দিয়ে গোটা আদিবাসী সমাজকে অবমাননা করা হয়েছে। এ তথ্য শিশু পাঠ্যপুস্তক থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষা পুস্তকে স্থান দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।

পুরুলিয়া জেলার দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী কানু শবর ও লচু শবর মহাশয়কে জানি । স্বনামধন্যা লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর জন্য শবর মেলা রাজনোয়াগোড়ে দু'বার উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। লঘু শবর মঞ্চে উঠে নিজেকে দেখিয়ে বলে, আমি লছু শবর। স্বাধীনতা সংগ্রামী। পেনশন পাই। মঞ্চে সলাবত মাহাত ঝুমুর গান গাইছেন

পুরুলিয়ার কঠিন মাটি, এ মাটি করেছি খাঁটি, আমরা মাটি কাটি, ফসল ফলাই,পুরুলিয়ার মাটিকে ভাই প্রণাম জানাই।

লছু শবর ছোট খাটো মানুষ। পরণে হাঁটুর উপরে সস্তা ধুতি। মোটা খদ্দরে তৈরী গলা বন্ধ কোট। কাঁধে চার ভাঁজ করা কাঁথা। লঘু শবরের বাড়ি পুরুলিয়া জেলার বড়বাজার থানার অন্তর্গত জাহানাবাদ গ্রামে । ১৯৪২ সাল ৪২-এর ভারত ছাড় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সবার মুখে “ইংরেজ ভারত ছাড়ো”। এ সময় গান্ধীবাদী নেতা রেবর্তী চ্যাটার্জী বললেন, থানা আক্রমণ করতে হবে। পরের দিন আদিবাসী আন্দোলনকারীরা থানা ঘিরে ফেলল। মদের ভাটি উচ্ছেদ করল। কয়েক হাজার মানুষ থানায় চড়াও হল। পুলিশ ভয় পেল। হাতজোড় করে আত্মসমর্পণ করল। সংগ্রামীরা পুলিশদের বলল, বন্দেমাতরম বল। পুলিশ তাদের সাথে গলা মেলাল। এরপর থানা জ্বালানো হল। পরে লঘু শবর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ১০ বছর জেল খাটল। দেশ স্বাধীন হয়েছে। শবর মেলায় লঘু শবর জনে জনে বলছে ব্রিটিশ সেই যে ‘অপরাধপ্রবণ জাত' বলে আখ্যা দিয়ে গেছে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও শবররা এ নাম বহন করে চলেছে। দেশীয় সরকার শবর উন্নয়নের মাধ্যমে শবরদের বঞ্চ না না করে উন্নয়নের দ্বারা এ বদনাম মুছে দিতে পারে। কিন্তু আজও তারা করেনি। এ সকল তথ্য আজ ইতিহাসে লেখার দিন এসেছে। তাদের সঠিক ইতিহাস রচিত হোক। সকলে জানুক, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য আদিবাসীদের উজ্জ্বল ইতিহাসের গুরুত্বও কোন অংশে কম নয় ।

....মেদিনীপুর জেলায় ব্রিটিশ বিরোধী আদিবাসী আন্দোলনের বিষয় বলতে গেলে বলতে হয় ভূমিজ আদিবাসী গঙ্গানারায়ণ সিং-এর নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল তাকে ব্রিটিশরা চুয়াড় বিদ্রোহ' বলে আখ্যা দেন। ‘চুয়াড়' কথার অর্থ হচ্ছে 'ধাঙর বা অসভ্যদের' বিদ্রোহ। এ নাম ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরেও রয়ে গেছে। আমরা আদিবাসীদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই দিকুরা বাইরের দেশ থেকে ভারতবর্ষে এসে আদিবাসীদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামকরণ করেছে। হরোপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো ধ্বংসকারীরা আদিবাসীদেরকে কখনো দাস, দস্যু, রাক্ষস, খক্কস, বানর নাম দিয়েছে। এরপর যতদিন গেছে তত নাম আদিবাসীদের ঘৃণার জন্য করেছে। আদিবাসীদেরকে কখনো কোল, সাঁওতাল নাম চাপিয়ে দেওয়া হল। এরপর বলা হল ধাঙড়, বুনা। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আদিবাসীদেরকে যদি মানুষ বলে ভাবতেন তা হলে আদিবাসী ইতিহাস লেখা ও ভাষা স্বীকৃতি দানে বিমুখ হতেন না। ওরাওঁ আদিবাসীরা কুরুক্ষেত্রে বসবাস করতে গিয়ে কুডুখ হলেন। কুডুখ বা কুরুখ কথাটি স্থান থেকে এসেছে। আবার সদরে বা শহরে বসবাস করার জন্য হলেন সাদরি। সাদরি ভাষা সদর বা শহর থেকে উৎপত্তি বলা হয়। সাদরি ভাষীর মানুষ ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, শবর, খেড়িয়া, লোধা ইত্যাদিরা। পশ্চিমবঙ্গে সাদরি ভাষার স্বীকৃতি নেই। সাদরি ভাষী কম পক্ষে ২০/২৫ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। গুরখারা মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষ বাস করে নেপালী ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছেন। নেপালের নেপালীদের ভাষাকে বলা হয় নেপালী ভাষা। গুরখা জাতি নেপালী ভাষাকে মাতৃভাষা করে নিয়েছেন।


রিজালি সাহেব লিখেছেন, ভূমিজরা মুণ্ডাদের একটি শাখা। মুণ্ডা পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তেই মুণ্ডা গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূমিজ নামে পরিচিত হয়েছে। ভূমিজ নামটা মনে হয় জমি বা ভূমিতে বসবাস করার জন্য ভূমিজ নামকরণ। এ নাম অপরের দেওয়া নাম। মুণ্ডা গোষ্ঠীর একটা অংশ এ নামে পরিচিত হওয়ায় তা ত্যাগ করতে পারেনি।

বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। ইহারা এক সময় ব্রিটিশ শক্তির ক্ষমতা বিস্তার, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে ভাল চোখে দেখেনি। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন সম্বন্ধে আদিবাসী মানুষ বীতশ্রদ্ধ ছিল। যেমন তারা এক সময় রক্ষণশীল উচ্চ-বর্ণীয় মানুষকে ভাল মনে করেনি। আজও করে না।

ওয়ারেন হেষ্টিং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন পাশ করে প্রকৃতি সম্পদের জমিকে তাদের অধিকার করে অর্থশালী অ-আদিবাসীদেরকে জমি লিজ দিয়ে অর্থ উপার্জনের রাস্তা কায়েম করেন। স্বদেশী উচ্চবর্ণের জমিদার, জোতদার, ঠিকাদার, ঠকবাজ, সুদের কারবারীরা যখন আদিবাসীদের উপর উৎপীড়ন শুরু করল তখন আদিবাসীরা দলবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠল। ১৮৫৭ সালের পূর্বে যে সকল ছোট বড় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ১৭৯৯ সালে মুণ্ডা/ ভূমিজ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।

১৮৩২-৩৩ সালে মানভূমের পুরুলিয়া, মেদিনীপুরে আদিবাসী গঙ্গানারায়ণ সিং- এর নেতৃত্বে আদিবাসীরা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে রাজস্ব দিতে যখন অস্বীকার করল তখন বিরোধ সৃষ্টি হয়। আদিবাসী ভূমিজ, মুণ্ডা, ওরাওঁ, খেড়িয়া, লোধা, শবর—এক কথায় খেরোয়াল গোষ্ঠীর মানুষ ব্রিটিশ সেনার সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করল। আদিবাসী গঙ্গ নারায়ণ সিং যেভাবে বিদেশী ব্রিটিশ শক্তিকে হটিয়ে অন্ততঃ কিছু দিনের জন্য ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল তা ইতিহাসে স্মরণীয়। এই আন্দোলনকেই গঙ্গানারায়ণ বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়ের “গণ আন্দোলনে সাঁওতাল সমাজ” পুস্তক থেকে জানা যায় উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মানুষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে পিছিয়ে থাকেনি। পুরনো কাগজ-পত্র থেকে জানা যায় ১৯৪২-এর ১৪ই সেপ্টেম্বর বিপ্লবীরা বালুরঘাটের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত, ডাকঘর, সাব-রেজেষ্ট্রি অফিস, পাটের অফিস প্রভৃতি জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন প্রায় আট হাজার আদিবাসী ও রাজবংশী বিপ্লবী এই অভিযানে অংশ নেয়। এর নেতৃত্ব দেন এক আদিবাসী কৃষক গঙ্গারাম ওরাওঁ।

উত্তরবঙ্গের কুচবিহার জলপাইগুড়ির আদিবাসী মানুষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পিছিয়ে থাকে নি। আমরা বয়স্ক মানুষদের কাছে শুনেছি লাল সুকরা ওরাওঁ আদিবাসীদের নেতৃত্বে দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে অমর হয়েছেন।

১৯৩২-৩৩ সাল মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আদিবাসী নেতা জিতু সর্দ্দার ব্রিটিশ ও সকল বিদেশী তাড়িয়ে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন এনে দিল সেই সুযোগ।

সুকুমার দাস লিখিত উত্তর বঙ্গের ইতিহাস থেকে জানা যায় আদিবাসীরা ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

১৯০৫ সাল ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে ভাগ করা। বাংলা বলতে অধুনা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য। স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু, মুসলমান ভাই ভাই ধ্বনির সাথে অন্ত্যজ আদিবাসী মানুষদের মানবিক অধিকারবোধ, বিশেষ করে মালদা ও দিনাজপুর জেলায় লক্ষ্য করা যায়। গিরিজা রায়ের আহ্বানে কাশীশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বঙ্গ ভঙ্গ রোধ ও অসহযোগ আন্দোলনে আদিবাসীরা অংশ নেয়।

মালদা জেলায় আদিবাসীদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার চলছে। ব্রিটিশ ও তাঁর খোসামোদকারী হিন্দু, মুসলমান জমিদার, জোতদার, ঠিকাদার সঙ্গে মহাজন কারবারীরা আদিবাসী মানুষকে ভীষণভাবে ঠকাচ্ছে।

১৯২৬ সালে আদিবাসীরা উচ্চ-বর্ণ হিন্দু সমাজের কাছে সম্মান দাবী করল। কারণ জাত প্রথায় আদিবাসীরা হিন্দু মন্দিরে প্রবেশ ও পূজা দিতে পারত না। একারণে তারা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কাছে কালী পূজা করার দাবী করল। মালদার বুকে আদিবাসীরা কালী পূজা করবে তা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মেনে নিল না। আদিবাসীরা কালী পূজা করবেই। উচ্চ-বর্ণের গঠিত হিন্দু সমাজ আদিবাসীদের কালীপূজা করতে দেবে না বলে ব্রিটিশ শাসককে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে পূজা বন্ধ করে দিল। আর এই সঙ্গে কাশীশ্বর চক্রবর্তীকে জেলা থেকে বার করে দেওয়া হল। আদিবাসীরা জিতু সদারের নেতৃত্বে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেল। আন্দোলনের চাপে আদিবাসীরা পূজা করতে পারবে বলে ব্রিটিশ প্রশাসন পূজা করার অনুমতি আদিবাসীদের দিল। ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধের জন্য ব্যাপক পুলিসি ব্যবস্থার আয়োজন

করল।

ব্রিটিশ প্রশাসন আদিবাসীদের গণ আন্দোলনের দাবী মানতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু বিষয়টাকে ভাল নজরে দেখল না। উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের সাথে আদিবাসীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের বিরোধ ছিল। তাই আদিবাসীদের রাজনৈতিক জাগরণকে খতম করতে জিতু ও অর্জুনকে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় প্রশাসন জড়িয়ে দিল। আদিবাসীরা প্রকাশ্যে ব্রিটিশ বিরোধীতা শুরু করল। আদিবাসী নেতাদের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায় ব্যাপক জমায়েত ও ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান প্রচারকে জোরদার করে তুলল। ব্রিটিশ পুলিশের সাথে আদিবাসীদের লড়াই শুরু হয়ে গেল।

মালদা জেলার জোতদার শ্রেণীর মুসলমানেরা আদিবাসীদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিকে ভাল চোখে দেখল না। যারা আদিবাসীদের রাজনৈতিক বিকাশ চাইছিল না তারা এই সুযোগে মুসলমানদের সাথে আদিবাসীদের বিভেদ ও লড়াই লাগিয়ে দিল। ভূমি প্রধান মুসলমান সমাজের অত্যাচার ও শোষণে আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। এ সময় আদিবাসীরা জিতু সদার-এর নেতৃত্বে আদিনা মসজিদ আক্রমণ করল। জেলা প্রশাসন এ ঘটনার পুরো সুযোগ নিল। দাঙ্গা সৃষ্টির অপরাধে আদিনা মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে ব্রিটিশ পুলিশ আদিবাসীদের উপর গুলি চালাল। আদিবাসীরা তীর, ধনুক, বালুয়া নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। সামনা-সামনি লড়াইয়ে বহু আদিবাসী বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাল। একজন কনস্টেবল আদিবাসীদের তীরে বিদ্ধ হয়ে মারা গেল। বন্দুকের গুলির সামনে আদিবাসীদের তীর, ধনুক, বালুয়ার লড়াইয়ের সময় জিতু বন্দুকের গুলি খেয়ে মৃত্যু বরণ করলেন। এ ঘটনার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ আদিবাসীদের ব্যাপক ধরপাকড়, হয়রানি, জরিমানা, জেল ও হাজত বাস করাল।

১৯৩০ সালে দিনাজপুর জেলায় আদিবাসীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। বালুরঘাট জেলায় আদিবাসী নেতা সিদুপ-এর নেতৃত্বে আইন অমান্য কর্মসূচীতে আদিবাসীরা সামিল হল। তারা খাজনা না দেওয়ার আন্দোলন জোরদার করল।

১৯৩০ সাল অক্টোবর মাসে পতিরাজ অঞ্চ লে আদিবাসীরা বড় বড় মিছিল করে চৌকিদারী ট্যাকস আদায় বন্ধ করে দিল। কিছু স্থানে তারা বন্দী অবস্থায় থানায় নিতে পুলিশকে বাধা দিল।

১৯৩২-৩৩ সালে আচকা অঞ্চ লের আদিবাসীরা ব্রিটিশ প্রশাসনকে সবরকম কর দেওয়া বন্ধ করে দিল। সরকার অচিরে আদিবাসীদের উপর দমন ও পীড়ন নীতি নামিয়ে দিল। ফলে আদিবাসীদের সাথে ব্রিটিশ পুলিশের সংঘর্ষ বেঁধে গেল। বিভিন্ন গ্রামে ছোট বড় সংঘর্ষ ঘটল। বহু জায়গায় গুলি চলল। পুলিশ শত শত আদিবাসীদের জেলে পুরে দেয়। ব্যাপক ধরপাকড়, নির্যাতন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে চুরমার করে দিল। আদিবাসীরা সেদিন উত্তরবঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গণ প্রতিবাদের যে সংগ্রামী দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তা স্বরাজ আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহের এক স্মরণীয় অধ্যায়।

১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ বাংলার মাটিকে দেশীয় জমিদারদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়। নিজে খাসমহল রেখে দেয়। নীলকর সাহেবরা নদীয়া জেলায় নীলকুঠি বানিয়ে নীলচাষ শুরু করে। নীল চাষে মুনাফা বেশী। তাদের সেই লাভের সকল অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিত। তারা বাংলার উন্নয়নের কথা চিন্তাই করত না।

নদীয়া জেলার যে সকল জমিদার ও জোতদারের উদ্ভব হয়েছিল তাদেরকে জমি রাখতে লেঠেল ও ফৌজ পুষতে হত। খাজনা, দাদন আদায়, হাটে তোলা তোলার জন্য আলাদা আলাদা কর্মচারী রাখত। জমিতে ফসল ফলুক আর নাই ফলুক কৃষকদের খাজনা দিতে হবে। জমিদারগণ ইচ্ছামতন যখন তখন জমির খাজনা বাড়িয়ে দিত। কৃষকরা ফসল ফলিয়ে বাজারে বিক্রি করতে গেলে জমিদারের তোলাবাজেরা ইচ্ছামত ঝাঁকা, ঝুড়ির ফসল তুলে নিত। নীলকর সাহেবেদের সিপাই এসে তদ্রুপ করত। প্রতিবাদ করার উপায় ছিল না। প্রতিবাদ করলে সঙ্গে থাকা লাঠিয়ালরা মারধর করত। কৃষকেরা ভয়ে মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করত। জমিদারের বাড়িতে কোন উৎসব, পূজা, ছেলে- মেয়ের বিয়ে হলে কৃষককে নজরাণা কর দিতে হয়। কর না দিলে অত্যাচার করা হত। নদীয়া জেলার জমিদাররা যখন বিভিন্ন ধরনের জুলুম, অত্যাচার কৃষকদের উপর চালাচ্ছে, তখন নীলকর সাহেবরা কৃষকদের দাদন দিয়ে জোর করে ধান চাষের পরিবর্তে নীল চাষ করতে বাধ্য করাচ্ছে। কোন কৃষক নীল চাষ করতে না চাইলে হালের গরু জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মারধর করছে। নীলকর সাহেব আর ব্যবসায়ী জমিদার যারা টাকার জোরে ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে তারা উভয়ে মিলে কৃষকদের উপর অন্যায় অত্যাচার, পীড়ন ও জুলুম চালাচ্ছে। কৃষকদের দেখার লোক নেই।

নীলকর সাহেব ও দেশীয় জমিদারের অত্যাচারে আদিবাসী কৃষকেরা যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল তখন এক আদিবাসী নেতার নেতৃত্বে আদিবাসীরা প্রতিবাদ প্রতিরোধ আরম্ভ করল। খাজনা দেওয়া বন্ধ করল। চাষী মার খেয়েও নীল চাষ করল না। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেল। আদিবাসী নেতা বিশ্বনাথ সদার দলবল নিয়ে নীলকর সাহেব ও জমিদারদের লাঠিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আদিবাসী কৃষক বনাম নীলকর সাহেব ও জমিদারের লেঠেল বাহিনীর লড়াই বেঁধে গেল। সিপাহীরা বন্দুকের গুলি ছুঁড়ল। আদিবাসীরা তীর নিক্ষেপ করল। একদিকে বন্দুক, লাঠি, অন্যদিকে তীর, ধনুক, বালুয়ার লড়াই চলল। বহু কৃষক প্রাণ হারাল। অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাল। এক সিপাহী  পিছন থেকে গুলি করে বিশ্বনাথ সদারকে হত্যা করল। আদিবাসীরা ব্রিটিশ রাজ্য শাসনকে কোনদিনই ভালো চোখে দেখেনি। বিদেশী শাসন তারা পছন্দ করত না। এ কারণে তারা ব্রিটিশ ও তার তোষামোদকারী জমিদারদের তাড়িয়ে পরাধীনতার লজ্জা নিবারণে বারে বারে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আদিবাসীদের কৃষি আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অঙ্গ। ইহা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। তবে অনেকে আদিবাসীদের বহু আন্দোলনকে • বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়ে আদিবাসী ইতিহাস লেখেননি। আদিবাসীদের অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে ও এখনও হচ্ছে।

বিহার রাজ্যে ছোটনাগপুর অঞ্চ লে আদিবাসীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে। ইহাকে ঐতিহাসিকগণ কোল বিদ্রোহ আখ্যা দিয়েছেন। ওরাওঁ, মুণ্ডা, হো প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী কোয়েল নদীর ধারে সমতল ভূমিতে বসবাস করার জন্য বহিরাগত মানুষ তাদেরকে কোল নামে চিহ্নিত করেছিল। এ অঞ্চ লে তারা স্বাধীনভাবে বসবাস করত।

১৮২০ সালে পোড়হাটের রাজা ব্রিটিশ আনুগত্য স্বীকার ও বিপুল পরিমাণে বার্ষিক কর দানে সম্মত হন। তিনি পার্শ্ববর্তী কোল অঞ্চ লটি নিজের রাজ্য বলে দাবী করেন। ব্রিটিশ সরকারও মেনে নেন। এরপর রাজা ওরাওঁ, হো, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে খাজনা আদায়ে যান। এতে আদিবাসীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা রাজকর্মচারীদের হত্যা করে। আদিবাসীরা জানত জমি প্রকৃতির দান। জঙ্গ ল পরিষ্কার করে জমি করা। খাজনা কিসের তাঁরা জানত না। ক্ষমতার জোরে জমি অন্যের করে নেওয়া যায় এ ধারণা আদিবাসীদের ছিল না।

তাঁরা দীর্ঘকাল ধরে জাতপাতের বন্ধনে পড়ে স্কুলে ঢুকতে পারেনি। বর্ণ-হিন্দুরা আদিবাসীদের শূদ্র বলে স্কুলে প্রবেশের অধিকার দেয়নি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এরকম বাধা প্রকটই ছিল। ভারতীয় সংবিধান সেটাকে দূর করেছে।

পোড়হাটের রাজকর্মচারী হত্যার কারণে রাজা ক্ষেপে গিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে জানায়। ব্রিটিশ সেনাদলের সেনাপতি একদল ব্রিটিশ সেনা নিয়ে রাজার সাথে কোলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। আদিবাসী কোলরা তীর-ধনুক, বালুয়া, টাঙ্গি নিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

পরের বছর ১৮২১ সালে ব্রিটিশরা পুনরায় কোলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানে। ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর হাতে তখন কামান ছিল। কোলরা প্রবল ভাবে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১৮৩১ সালে পুনরায় কোল, ওরাওঁ গোষ্ঠীর মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ রাজস্ব আদায়ের জন্য ছোটনাগপুর অঞ্চল হিন্দু, মুসলমান ও শিখ মহাজনদের ইজারা দেয়। মহাজনরা ভূমির রাজস্ব আদায়ের জন্য কোল, ওরাওঁ আদিবাসীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার চালায়। তারা গরীব ওরাওঁদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এ ছাড়া উচ্চ হারে খাজনা নির্ধারণ, ব্রিটিশ বিচার ও খাজনা সংক্রান্ত আইন-কানুন পাল্টে আদিবাসী ওরাওঁদের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এই শোষণ, উৎপীড়নের প্রতিবাদে আদিবাসী ওরাওঁ নেতা বুদ্ধ ভগত, জোয়া ভগত প্রভৃতিদের নেতৃত্বে আদিবাসীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অপরদিকে ঝিন্দরাই মানি, সুই মুণ্ডার নেতৃত্বে আদিবাসী কৃষকরা সংঘবদ্ধ হয়ে ১৮৩১ সালে রাঁচী জেলায় সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলস্বরূপ, সিংভূম, মানভূম, হাজারীবাগ ও পালামৌ জেলায় সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঐতিহাসিক জীবন মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আরও জানা যায় ইংরেজ চার্লস মেটাকাফের মতে বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন ধ্বংস ও সকল অত্যাচার রোধ করে দেশকে স্বাধীন করা।

বিদ্রোহী ওরাওঁ, মুণ্ডা, হো আদিবাসীরা কঠোরতার আশ্রয় নেয়। জমিদার, জোতদার, শস্য ব্যবসায়ী, মহাজন, ব্রিটিশ কর্মচারী আদিবাসী নয় এমন সকল মানুষ বিদ্রোহীদের আক্রমণে রেহাই পায়নি। তাঁরা জমিদার, মহাজন ব্যবসায়ীদের ব্রিটিশ শাসনের অঙ্গ বলে মনে করত। কেবলমাত্র কামার ও ছুতোররাই তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। কারণ অস্ত্র, শস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের জন্য তাঁদের প্রয়োজন ছিল।

বিদ্রোহ দমনের জন্য দানাপুর ও পাটনা থেকে সেনাবাহিনী আসে। বিভিন্ন স্থানে সেনা বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ চলে। দু'বছর বহু চেষ্টার পর তীর, ধনুক, বালুয়া, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্রের বিপক্ষে আধুনিক বন্দুক, কামান, অস্ত্রাদি ব্যবহার করে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী নয় তেমন আদিবাসী যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। হাজার-হাজার আদিবাসী নরনারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার এ বিদ্রোহ দমন করে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার এ অঞ্চ লটি বিহার প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এর শাসনভার সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ করে। এ ব্যবস্থা ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

১৯৪৬-৪৭ সালে কৃষক সভার আহ্বানে অবিভক্ত ২৪-পরগণা জেলার হাড়োয়া, ক্যানিং, সন্দেশখালি, গোসাবা, কাকদ্বীপ, মথুরাপুর ও সাগরথানায় আদিবাসীরা তে- ভাগা আন্দোলন করল। কৃষকদের দাবী ফসলেব দু'ভাগ পাবে চাষী এক ভাগ পাবে  জমিদার। সন্দেশখালি থানার আদিবাসী বর্গাদাররা পুরো ফসল জমিদারের খামারে তুলছে। কৃষক জমিদারকে ফসলের ভাগ এক-তৃতীয়াংশ দিতে চেয়েছে। জমিদার তা নেয় নি। কৃষক ন্যায্য দাবী আদায়ে সংঘবদ্ধ। জমিদারেরা পুলিশের সাহায্য নিয়ে কৃষকদের দমন পীড়নের ব্যবস্থা নেয়। পূর্বেই বলেছি আদিবাসীরা যেমন ব্রিটিশ বেনিয়াকে ভাল চোখে দেখেনি তেমনি জমিদারকেও ভাল চোখে দেখেনি। ২৪-পরগণা জেলার আদিবাসীরাও তার ব্যতিক্রম নয়।

তে-ভাগা বিষয়কে নিয়ে সরকার বনাম আদিবাসী কৃষকদের লড়াই বাঁধল। ১৯৪৭ সালের ৮ই মার্চ সরকারী পুলিশ গুলি করে হত্যা করল আদিবাসী রবিরাম সর্দ্দার, পাগলু সদার, চামু সদার, বিশাল সর্দ্দার, বিরু সর্দ্দার ও রতিকান্ত সদারকে। এঁরা শহীদ হলেন। অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করা হল।

আমরা জানতে পারি সেই তিলকা মাঝি থেকে আরম্ভ করে টানা ভগত, সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ও বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে বড় বড় ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ যেমন হয়েছে তেমনি ছোট ছোট আদিবাসী কৃষক লড়াই-আন্দোলনও হয়েছে। আদিবাসী আন্দোলনগুলি ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, মাহালী, হো, কোড়া, লোধা, শবর, খেড়িয়া ইত্যাদি আদিবাসীরা ব্রিটিশ শোষণ, শাসন থেকে মুক্তি ও ন্যায্য বিচার পাওয়ার জন্য জাতীয় আন্দোলনগুলিতে অংশগ্রহণ করেছে। অ-সহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, বিয়াল্লিশের আন্দোলন, আগষ্ট আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সম্বন্ধে বলতে অধিকাংশই মনে করেন সাঁওতালরাই আদিবাসী। সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে একটা গোষ্ঠী। আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, খেড়িয়া, শবর, লোধা, মাহালী, গোণ্ড, কোড়া ইত্যাদিরাও আদিবাসী। এরা এক সময় খেরোয়াল নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে আদিবাসীরা অন্যদের কাছ থেকে নামকরণ পেয়ে কেউ হলেন কোড়া, কেউ হলেন কোল, কেউ হলেন সাঁওতাল ইত্যাদি। আদিবাসীদের একটা গোষ্ঠী সমতলে বসবাস করতে গিয়ে হলেন সাঁওতাল। লক্ষ্য করা গেল অল ইণ্ডিয়া রেডিও (আকাশবাণী-কলকাতা) সাঁওতালী সংস্কৃতিকে বিকাশের জন্য বেতারস্থ করার সুযোগ ও স্বীকৃতি দিল। অন্যান্য আদিবাসী সংস্কৃতি বিকাশে ওরাওঁ, মুণ্ডা, মাহালী, কোড়া, গোণ্ড, শবর, খেড়িয়া, লোধা ইত্যাদি আদিবাসীদের যোগাযোগকারী সাদরি ভাষার বিকাশ, আদিবাসী সংস্কৃতিকে বিমুখ ও অস্বীকার করল।

আমার মনে হয় সাঁওতাল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল বলে ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে সরকার অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে বেতারস্থ করার স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। খুব ভাল কথা। কিন্তু অন্যান্য আদিবাসী ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, কোড়া, শবর, লোধা, খেড়িয়া, গোণ্ড আদিবাসীরাও স্বাধীনতা ও বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন করে শহীদ হয়েছেন। তাঁদের যোগাযোগকারী সাদরি, ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে অল ইণ্ডিয়া রেডিও দপ্তরের কর্মকর্তাগণ কেন যে স্বীকৃতি দানে বিমুখ হচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। এক কথায় বলা যায় অস্বীকার করছেন সাদরি ভাষা গোষ্ঠীর আদিবাসীদেরকে।

ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ ইত্যাদি আদিবাসীরা ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই আন্দোলন করে শহীদ হয়েও তাদের যোগাযোগকারী সাদরি ভাষায় পঠন-পাঠন ও ভাষাকে উন্নতি করতে স্বদেশী সরকারের স্বীকৃতি না পেয়ে আজও তারা বঞ্চিত। আজও আদিবাসী ইতিহাস লেখা হল না। অল ইণ্ডিয়া বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী কলকাতা থেকে সাদরি ভাষায় গান ও কথিকা পরিবেশন করার সুযোগ স্বীকৃতি পেল না। আদিবাসীরা সার্বিক উন্নয়নে আজও বঞ্চিত। আর কত কাল আদিবাসীরা উপেক্ষিত হবে তা আমার জানা নেই ।

সাম্প্রতিক কালে সাদরিতে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। সাদরির মাধম্যে বাংলা-হিন্দি ভাষাভাষী মানুষকে আন্তরিকতার ডোরে বা সাদর সম্ভাষণে বিমোহিত করা যায় বলেই 'সাদরি’

নামের সার্থকতা, সাদরি এখানেই বিরাজিত, অনুরণিত।

সাদরির অর্থ—এখন বাংলা ব্যাকরণের নিয়মাধীনে 'সাদরি' শব্দের প্রত্যয় সন্ধি বা সমাগত অর্থ নির্ণয় করা যাক। সাদর = ই + সাদরি। ইহা তদ্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দ। যার অর্থ হল আন্তরিকতা বা বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব।

আবার স+আদর = সাদর (সন্ধি)

আদরের সহিত = সাদর (বহুব্রীহি)। এই দুটি শব্দের অর্থই হল আন্তরিক। অর্থাৎ আন্তরিক, সহৃদয়, সম্মানপূর্ণ, ভদ্র, অকৃত্রিম, স্নেহশীল, প্রীতিপূর্ণ, দয়া এই সুকুমার সমূহ ‘সাদর' শব্দের মধ্যে অস্তিত্বশীল। এক্ষেত্রে সাদরি নামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

কেউ কেউ সাদরিকে সাদান / সাদানি বলে থাকেন। মূলতঃ সাদান / সাদানি হল সাদারি শব্দেরই রূপান্তর মাত্র। রেভাঃ শান্তি নাওরঙ্গী এরূপ মন্তব্য করেছেন।

বর্তমানে সাদরিতে সাহিত্য চর্চার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কালিপদ সরদার (ওরাওঁ) ‘সাদরি পাড়হা' গ্রন্থটি (১৯৯৫ সালে প্রকাশিত) সাদরিভাষী জন গোষ্ঠীকে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই লেখকের বাংলায় লেখা বইগুলো—

(১) দেশজ আদিবাসী সমাজ (১৯৯৪ সালে প্রকাশিত)

(২) জাগ্রত আদিবাসী (১৯৯৮ সালে প্রকাশিত)

(৩) সুন্দরবনের কারমি (২০০২ সালে প্রকাশিত)।

এই প্রবন্ধের লেখক নেহেরু ওরাওঁ সাদরি সাহিত্য চর্চার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার রচিত বইগুলো (১) হাঁড়িপানি (নাটক) ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত। (২) হামনি (কবিতাগুচ্ছ) ১৯৮৯ সালে। তার রচিত অপ্রকাশিত বইগুলো (১) সাদরি ভাষার ব্যকরণ (২) সাদরি অভিধান (৩) তুহানি আওয়া (একাঙ্কিকা) (৪) হামার সাথী (নাটিকা) (৫) সেক্সপিয়ারের 'কিংলিয়ার'-এর সাদরি অনুবাদ। তার বাংলায় লেখা বইগুলো (১) অনুসন্ধান (কবিতাগুচ্ছ) (২) বীরসা মুণ্ডা (নাটক) (৩) সাত্যে-শিবে-সুন্দারে (উপন্যাস) এগুলো প্রকাশিত হয় নি। (৪) কার্ত্তিক ওরাওঁ সম্পর্কে দু'টি কথা (জীবনী সংক্রান্ত) ১৯৯১ সালে প্রকাশিত। (৫) জাগরণী (কবিতাগুচ্ছ) ২০০৩ সালে প্রকাশিত।

_সুরেন কুজুর (গৌড় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কর্মচারী)-এর আর্থিক সহযোগিতায় নেহেরু ওরাওঁ 'নাগড়া' নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা (১৯৯২-৯৩) করতেন।

পত্রিকাটির ভাষা ছিল সাদরি ও বাংলা। এই পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন কালিপদ সরদার ( ওরাওঁ / দঃ ২৪-পরগণা), বিজয় কুমার এক্কা (বারুইপুর / দঃ ২৪-পরগণা), বাবুরাম ওরাওঁ (মানিকো), পূর্ণচন্দ্র সরদার (মিনজি/ তপন) মনিমালা কুজুর (সালাস) পুশনো ওরাওঁ (বদলপুর), সুনীল বাখোয়ার (বদলপুর), নিমাই মুরারী মুন্ডা (মুর্শিদাবাদ) এবং আরো অনেকেই। নেহেরুও কবিতা গল্প লিখতেন। এই সকল কবি, লেখকদের লেখার মাধ্যম ছিল সাদরি। একবছর চলার পর আর্থিক কারণে 'নাগড়া'-র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আদিবাসী সাহিত্য চর্চার সুবাদে ভারতীয় দলিত সাহিত্য একাডেমী দিল্লিতে ১৯৯৩ সালে নেহেরু ওরাওঁকে ডঃ আম্বেদকর ফেলোশিপ পুরস্কারে ভূষিত করেন।

নির্দ্বিধায় উল্লেখ করা যায় যে, দঃ দিনাজপুরের বদলপুরে সাদরি নাটকের জোর মহড়া চলছে। এর নেতৃত্বে পুশনো ওরাওঁ ( বর্তমানে হাইস্কুলের শিক্ষক)। তিনি একাধিক সাদরি নাটক রচনা করে চলেছেন। কয়েকটি মঞ্চ স্থও করেছেন। তার রচিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম (১) ছোটকা ভাইকের সংসার (২) টুয়ার বেটা। এগুলো অপ্রকাশিত। মানিকোরের বাবুরাম ওরাওঁ, বদলপুরের সুনীল বাখোয়ার সাদরি কবিতা চর্চা করছেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, সাদরি সাহিত্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য 'সাদরি সাহিত্য একাডেমী' একান্তই প্রয়োজন। অন্যদিকে সাঁওতাল বুদ্ধিজীবিরা 'সাঁওতালী সাহিত্য একাডেমী' গঠনের জন্য সরকার বাহাদুরের কাছে দাবী করছেন, বৈঠক করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সাদরি ভাষী গোষ্ঠীগুলোকে সাদরি সাহিত্য একাডেমী' গঠনের উদ্দেশ্যে সরকারের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শসহ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।



একবার এক ব্যক্তি মৃতা স্ত্রীর অস্থি-ভষ্ম তার পিত্রালয়ে দিতে যায়। ঐ দিনেই গ্রামে এক বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল। অস্থি-ভষ্ম গ্রহণ করলেই সমগ্র গ্রাম অপবিত্র হবে এবং বিবাহ অনুষ্ঠান আটকে থাকবে বলে গ্রামের কিছু লোক মেয়ের বাবাকে সেদিন অস্থি-ভষ্ম গ্রহণ করতে নিষেধ করল। মেয়ের বাবা তাদের কথামত অস্থি-ভষ্ম না নিয়ে জামাইকে অন্য একদিন আসতে বলল। জামাই এতে অপমানিত বোধ করল এবং মেয়ের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি শুরু হল। শেষে সে রাগ করে সেখানেই অস্থি-ভষ্ম রেখে নিজের গ্রামে ফিরে গেল। মেয়ের বাবা ও ভাইরা রেগে অস্থি-ভষ্মের আধারটা পাশের নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই মিটল না। গ্রামে দুটো দল দেখা দিল। কিছু লোক মেয়ের বাবাকে আর কিছু লোক জামাইকে সমর্থন জানাতে লাগল। একদল বলতে লাগল যে অস্থি-ভষ্ম গ্রহণে বাধ্য করে গ্রামবাসীদের অপমান করার অধিকার জামাইয়ের নেই। অন্যদল বলতে লাগল, অস্থি-ভষ্ম গ্রহণ না করে মেয়ের বাবা নীতি বিরুদ্ধ কাজ করেছে। শেষে দু'দলের মধ্যে বিবাদের মাত্রা এত বেড়ে গেল যে কথাটা দেশের আদিবাসী রাজা সান্তার কানে গিয়ে পৌঁছাল। খেরওয়াল রাজা সান্তা বিরোধ মেটাবার জন্য নদীর ধারে এক বিরাট সভার আয়োজন করে সমস্ত খেরওয়াল গোষ্ঠীকে সেই সভায় ডাকলেন। রাজা সান্তা সেই সভায় বললেন যে, অস্থি-ভষ্ম সমাহিত করার অনুষ্ঠান (জাঙ তপা) নিয়ে সারা দেশে প্রবল অশান্তি দেখা দিয়েছে। সেজন্য তিনি এটা অবিলম্বে মিটিয়ে ফেলতে চান। সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকটি সমস্যারও সমাধান করতে চান। প্রথমতঃ, বিবাহের পণের টাকা খুশীমত নেওয়া হচ্ছে বলে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছে। এমনকি এই পণের টাকা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ, জাঙ তপা অনুষ্ঠানে কোন আত্মীয় যদি কোন কারণবশতঃ উপস্থিত হতে না পারে, তাহলে তার প্রতি নানারকমের অশালীন মন্তব্য করা হয়। এ নিয়েও প্রায়ই কলহ-বিবাদ দেখা দিচ্ছে। তাই তিনি পুরাতন রীতিনীতির বদলে নতুন কয়েকটি নিয়ম চালু করতে চান। সেগুলি হল—বিবাহে পণের টাকা নির্দিষ্ট করা হবে। বিবাহিত স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংস্কার একমাত্র স্বামীর পরিবারই করবে। আর “জাঙ তপা” অনুষ্ঠান বলে কোন অনুষ্ঠান থাকবে না। অস্থি-ভষ্ম দামোদরে বিসর্জন দেওয়া হবে। কিন্তু অনেকেই পুরাতন প্রথা তুলে দিয়ে নতুন প্রথা চালু করতে রাজী হল না। রাজা তখন দুপক্ষের মত নিতে চাইলেন। এদিকে দুপুর পেরিয়ে গেছে, প্রত্যেকের বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। রাজা সান্তা বললেন, যারা তাঁর নতুন বিধান গ্রহণ করতে চায় তারা শালপাতায় (সারজম সাকাম) এবং অন্যরা শিয়াড় পাতায় (লাড় সাকাম) খাবার খাবে। খেরওয়ালরা দু'দলে বিভক্ত হয়ে খাওয়া দাওয়া শুরু করল। দেখা গেল দু'দলেই সমান। সুতরাং নতুন বিধান জোর করে চাপানো গেল না। কিন্তু খেরওয়াল সমাজ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। যারা রাজা সান্তার নতুন বিধান মানতে লাগল তারা সান্তাড় বা সান্তাল নামে পরিচিত হল। অন্যরা লাড় পাতায় খাবার খেয়েছিল বলে “লাড়কা” আখ্যা পেল। এই লাড়কাদেরই ‘হো’ বলা হয়। পরবর্তীকালে লাড়কাদের সঙ্গে সাঁওতালদের বহুদিন ধরে যুদ্ধ চলেছিল।

সাঁওতালি পুরাণ সংগ্রাহক রেভাঃ স্ট্রেস্ রুড মনে করেন সাঁওতাল শব্দটি ‘সাঁওনতর' শব্দের অপভ্রংশ। মেদিনীপুর জেলার এক অংশকে ‘সাওন্ত' বা সামন্তভূমি বলা হত। এই এলাকাতে কয়েক পুরুষ ধরে বাস করে আসছে বলে এদের সাঁওতাল বলা হয় । আচাৰ্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে সাঁওতাল শব্দটি এসেছে সামস্তপাল’ থেকে। সামন্তপাল অর্থাৎ ‘সীমান্ত রক্ষক'। মধ্যযুগে এই সামন্তপাল কথাটিই সামন্ত আল’ ও পরে ‘সাঁওতাল'-এ পরিণত হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন সাঁওতাল শব্দটি শ্যামের তাল থেকে এসেছে। শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণ। কৃষ্ণের তাল বোঝাতে কৃষ্ণ যেমন তার গোপীনিদের নিয়ে সারারাত তালে তালে নাচ গান করেন, সে রকম এরাও সারারাত ধামসা মাদলের তালে নাচ গান করে। অর্থাৎ শ্যামেরই তালের লোক মনে করে এদের শ্যাম তাল, পরে সাঁওতাল বলা হয়। এরকম সাঁওতাল শব্দের উদ্ভব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে।

উল্লেখিত মতগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি। রেভাঃ স্ক্রেফ রুড এর মত অনুযায়ী সাওন্ত বা সামন্তভূমি এলাকাতে বাস করার জন্য এদেরকে সাঁওতাল বলা হত। কিন্তু ঐ এলাকাতে এই জনগোষ্ঠী ছাড়া আরো বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল তাদেরকে সাঁওতাল বলা হল না কেন? আচার্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত অনুযায়ী সামন্তপাল বা সীমান্ত রক্ষক থেকে সাঁওতাল হয়েছে। শব্দের অপভ্রংশ বা পরিবর্তনের ধারা অনুযায়ী সামন্ত আল থেকে সাঁওতাল হলেও এরকম সীমান্ত রক্ষক হিসাবে কোন প্রমাণযোগ্য যুক্তি বা নজির নেই। এছাড়া সাঁওতালি পুরাণ, কাহিনী, কিংবদন্তী বা গানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাঁওতালরা সাহসী, শিকারী হলেও সীমান্তরক্ষী বা যোদ্ধা হিসাবে এদের আলাদাভাবে ভারতবর্ষে পদমর্যাদা হয় না। যেমন, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিৰ্ভীক সাহসী যোদ্ধাজাতি হিসাবে গোর্খা রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট ইত্যাদি আছে সেভাবে সাঁওতাল বা আদিবাসীদের আলাদাভাবে কোন রেজিমেন্ট নেই। আবার শ্যাম বা কৃষ্ণের বাঁশি, নুপুর, নৃত্য, গীত তালের সঙ্গে মিল থাকলেও আবেগ প্রবণভাবে জাতির নাম ভাবা যায় না। আমার মনে হয় উল্লেখিত সাঁওতাল লোককথাটি অনেক গ্রহণযোগ্য । ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ ইত্যাদি, আদিবাসীরা ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই আন্দোলন করে শহীদ হয়েও তাদের যোগাযোগকারী সাদরি ভাষায় পঠন-পাঠন ও ভাষাকে উন্নতি করতে স্বদেশী সরকারের স্বীকৃতি না পেয়ে আজও তারা বঞ্চিত। আজও আদিবাসী ইতিহাস লেখা হল না। অল ইণ্ডিয়া বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী কলকাতা 

Manjihas Lands-A certain portion of the best land in every village is set apart and called Manjihas. This land is the right of the immediate head of the village, and kept for his cultivation.If unable or unwilling cultivate it himself, the headman (Whether farmar, Jagirdar, mudkarraridar, or whatever his tenure, temporary or parmanent may be) may lease it to the rayats, but the rayats can never acquire a right of occupaney in Manjihas land, it is intended for the private use of the propritor or his representative. The cultivation of this land is moreover carried out entirely by the labour of the villagers, for which no payment is made, the owner of the villagers, for which no payments is made, the owner of the manjihas having only to supply the seed and a lightmeal termed Kuraibhoja composed generally of makai, janira on the days the villagers are working on the land. It is however, but seldom that the manjihas land is leased out, and then only at a rate much higher than is generally prevalent in the village. ( Statisticl Account of Hazaribag District-1872) The Munda and their country বই-এ শরৎচন্দ্র রায় দেখিয়েছেন— মুণ্ডাদের মধ্যে জমি পুনর্বন্টনের ব্যবস্থা ছিল যাতে পরিবারগুলোর মধ্যে সমতা বজায় থাকে। মারে হাপড়ামকো রেয়াক কাথায় (১৮৮৭) গুরু কোলেয়ানের বিবরণ থেকে জানা যায় মাঘসিম উৎসবের সময় সাঁওতালরা মাঝিকে জমি ফেরৎ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতো। মাঘ সিম বোঙগারে মীজিয়ে মেনাঃ দে বাবা নক' অয় মাঘ মাস মুডীরে, কোমবড়ো, রেয়াক, হুঁ মাঘ মাস, চাসা রেয়াঙ হুঁ মাঘ মাস, মীজি পারানিক রেয়াঙ হ মাঘ মাস, গুতি কীড়মি রেয়াঙ হুঁ মাঘ মাস, আদো সানামকো রেয়াঙগে হোয়েন তাবোনা মাঘ মাস, দে অকয়পে মাঝিক্ তাবোন খান, ইঞ ঞ জবাবেদা মাঘ মাসরে।

পারানিক, জগ মাঝি, গোডেৎ নায়কে আর কুডাম নায়কে হুঁ অনকাগে কো রড়া, মেতাক' মে আলে হুঁ বাবালে চালাও মকঞজএনা। উনরে রায়ত কো মেনা— আলে হুঁ বাবালে মকঞ্জ এনা, জায়গা কোলে জিমাআম কানা, মাঝি বাবা সেতোঙদিন ভোর একেন মারে ডিনডীলে দখল ইদিয়া, ওনা দ বালে জিমী আম কানা, আর কুবী হলে দহ ইদিগেয়া। মাঝিয়ে রড় রুয়ীড়া আদো পে জবাবে‍ খান ইঞ দঞ অকাতেক্ আ— মিনীঞগেয়া। তবে চালাক্ কো দাবো ইদি হটোকাকোওয়া, হিজুক কো দবো অণ্ড কোওয়া। মাঘসিম পরবে গ্রামের মোড়ল বলেন- বাপুহে মাঘ মাসের শেষ, চোরদেরও মাঘ মাস অর্থাৎ চুরি শেষ, চাষাদেরও মাঘ মাস, আমাদের পারানিকদেরও মাঘ মাস, চাকর চাকরানীদেরও মাঘ মাস, আমাদের সকলের মাঘ মাস অর্থাৎ মেয়াদ পূর্ণ, এসো কেউ যদি মাঁঝি অর্থাৎ মোড়ল হতে চাও আমি জবাব অর্থাৎ ইস্তফা দিচ্ছি এই মাঘ মাসে। পারানিক, গোডেৎ, নায়কে (পুরোহিত) এবং কুডীম নায়কেরাও একে একে একই ভাবে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। তখন বায়তেরা বলেন- বাপধন, আমরাও জমি জিরেত চষতে চষতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরাও জমি জায়গা সব মাঝি বাবার জিম্মায় রেখে দিচ্ছি। তখন প্রত্যুত্তরে মাঝি বলেন তবে তোমরা সব জবাব দিলে আমি আর যাই কোথায়— আমি আছিই। তাহলে যারা যাবার তাদের আমরা বিদায় জানাব, যারা আসার তাদের স্বাগত।

একটি গ্রামে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং চাষযোগ্য জমির অভাব দেখা দিলে আদিবাসীরা বেরিয়ে পড়ত জঙ্গলে আর একটা জায়গার সন্ধানে। জায়গা পছন্দ হলে দিনক্ষণ দেখে তাদের রীতি অনুযায়ী আর একটা গ্রাম গড়ে তুলত। গ্রামের সকলে মিলে জঙ্গল হাসিল করত, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেতি বানাত, ফসল ফলাত, সোনার ফসল। খেয়ে পরে রাজা-রাণীর মতো থাকত।

বির বাড়গে নোওয়া ওড়াক’কক আলাঙ রাজারীনি ননডে আলাঙ কক্ আলাঙ রেঙগেচ্ জালা দলাঙ এড়ের গিডিয়া সেরমা রেয়াক সুকলাঙ ভুঞজীউ সুকজঙ আ।'

অর্থাৎ- এই বনভূমিতে আমরা ঘরবাড়ি তৈরী করব, রাজারানী হয়ে আমরা থাকব, জগতের দুঃখ কষ্ট আমরা ভুলে যাব, স্বর্গীয় আনন্দ আমরা উপভোগ করব। ( সংগ্রহ ও অনুবাদ— ধীরেন্দ্রনাথ বাসকে)।

ভারতবর্ষে প্রথম কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে খেরোয়াল জন গোষ্টির মানুষ। সম্ভবত যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ১৫০০ বছর পূর্বে, যে সময়ে বর্বর আর্যজাতি ভারত নামক দেশে আসতে শুরু করে-By the early part of the first millennium B. C. they had developed weapons made by iron, probably smelted locally alongside copper, Rather than permanent field agriculture, which would come later, those people apper to have practiced shifting cultivation, having burred patches of forcet; they prepared the soil with hoes seeded dry rice and small millets by boardcast or with dibbling sticks and harvested crop with stone blands which have been found at excavated sites. These 

communities could very well have been spakers of Proto Munda' the Austroasiatic ances fors of the modern Munda languages for there is linguistic evidence that at least as early as 1500 B.C. Proto-Munda spakers had evolved a subsistence agriculture which produced or at least knew grain in particular rice, two or three millets and at least three legumes. (R. K. Zide and Norman H. Zide Proto Munda cultural vocabulary. Hunululu University Press Hawii-1976)

খেরোওয়ালী ভাষায় দেড় শতাধিকেরও বেশী জাতের ধানের নাম, কত রকম খাদ্যশস্য যেমন ইড়ি এরাবা, জোনার, বাজরা, জানহে, সায়ো, কদে গুদলি ইত্যাদি ফসলের নাম পাই। তার উপর আছে বনে-জঙ্গলে কত রকমের ফলমূল, শাকপাতা।

প্রকৃতির সাথে খেরোওয়ালদের একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। প্রকৃতিভিত্তিক খেরোয়াল জীবন এবং কৃষি ভিত্তিক খেরোয়াল সমাজ। প্রকৃতির রূপ, রঙ-এর পরিবর্তনের সাথে সাথে খেরোয়াল মানুষের পালা পার্বন, মনন ও চিন্তনের পরিবর্তন হয়। আজও অশ্বত্থ গাছের ডগায় বসে তুপাখি জানিয়ে দেয় পৃথিবী ঘুরছে—“হেসাক্’ মা চটেরে জা গঁসায় তুদে দয় রাগে কান.........জা সায় দেস চ নীচুরেন, জা গঁসায় দিসম চ বিহুরেন।” অরণ্যাসৃত মানুষদের প্রকৃতিই নির্দিষ্ট করে দেয়, কখন, কোন্ সময় কী শস্য বুনতে হবে। বনে বনে যখন লতানে গাছ সেরকায় থোকা থোকা সাদা সাদা ফুলে ভরে যায় তখন হো সম্প্রদায়ের মানুষেরা বুঝতে পারেন—গুঁদলি বোনার সময় এসেছে, গাছে গাছে বনকুল যখন পাকতে আরম্ভ করে তখন লাড়কা কোলেরা বেডা জমিতে হামাল বাবা ( ভারী ধান) বুনতে আরম্ভ করেন।

খেরোওয়ালদের জমি তাদের মা, জঙ্গল তাদের কাকিমা, ফুল উৎসব দিয়ে তাদের বছর শুরু, ফল উৎসব দিয়ে তাদের বছরের সমাপ্তি। জমির সাথে আছে তাদের বংশ পরম্পরাগত আত্মিক বন্ধন। Mathew Areeparamhil এর মতে - The Adibasis have a special relationship to then land they hold, To them land is not simply the factor of production as for other people but a source of spirituality as well. The land provides assurance for their continued survival. It is the land more than anything else that gives life and meaning to their being, for it is in their land that their history and identity contained. The traditional land base holds important symbiolic and emotional meaning for them as the repository of ancesstral remains (Sasans) clan origin sites and sacred features important to their religions system. Regarding ownership of land the Adivasis have different concepts, ofter incomprehesive to out sides. In the first place, ownership of Isnd is vested in the community. The community is the trustee of the land it occuoies. The community includes not only the living members but also tothe ancestors and future generations. This is why for the Adivasis culture, religion, identity and their very exitence are intimately linked to the land they hold, To seperate the Adivasis from their land is tantamount to tearing them apart from their life giving source. (Struggl for Swaraj P-7).

প্রায় ৬৪ অব্দে মাদরা মুণ্ডার পালিত পুত্র ফনী মুকুট রায়কে মুণ্ডারা প্রথমে মহারাজ নির্বাচিত করেন। মুণ্ডারা মহারাজার কাছে মানকিদের মারফৎ ইচ্ছামত কিছু নজরাণা পাঠাতেন। রাজাও সন্তুষ্ট থাকতেন। কালক্রমে নির্বাচিত রাজার নিকট সকল মুণ্ডা, পাহান মানকিরা বশ্যতা স্বীকার করলেন। ধীরে ধীরে রাজা নির্বাচিত হওয়ার বদলে বংশগত রূপ নিল। আড়ম্বরপূর্ণ জীবন শুরু করল। অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দের জন্য খাজনা প্রথার প্রবর্তন হলো। বাইরের রাজারা ছোট নাগপুর রাজার কাছে দামী দামী ঘোড়া, শাল ইত্যাদি ভেট পাঠাতে আরম্ভ করল। রাজপুত বংশের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হলো। রাজকার্য পরিচালনার জন্য বিহার ও মধ্যপ্রদেশ থেকে লোক আনানো শুরু হলো। পাহানদের বদলে ব্রাহ্ম ণদের দিয়ে মুণ্ডাদের প্রধান দেবতা সিঞ বোঙগার পূজা অর্চনা করানো হলো। ভিন দেশী কর্মচারীরা জায়গীরদার ঠিকাদার এবং মহাজনে পরিণত হলো। জায়গীরদারেরা অধিক হারে স্থানীয় রায়তদের উপর কর চাপাতে আরম্ভ করল। এদের অত্যাচারে মুণ্ডাদের সমাজ জীবনে নেমে এল গভীর দুর্দশা। যারা নির্বাচিত প্রথায় রাজা নির্বাচন করেছিল সেই বিষ বীজ তাদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মুণ্ডারা এই আত্মঘাতী প্রথাকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বিপদ বুঝে মহারাজ সৈন্যদল বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হলেন। ভিনদেশী ছত্রীক, বরাহক এবং রেতিয়া জাতিভুক্ত লোকেদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করা হল। মুণ্ডাদের পরম্পরাগত ভূমি সংক্রান্ত নীতি ওলট-পালট হতে আরম্ভ হল।

Tarikh-i-Firuz Shahi, Bibilotheca Indica থেকে জানা যায়- The Accession of Akbar to the throne of Delhi in 1556 A. D. in a land mark in the history of Jharkhand of jungle country. To the mughals it was known as kukrah. It excited the cupidity of the Mughal Emperors by the resone of the report 

mingling of their on the road, the misrable provision of sleeping where they chance to labour being herded together here and there, amongest constant changing companions without any restraints of village organisations to which they have been accustomed or rapidly lowering down their morals of the community. Moreover this wandering life rapidly destroys any inclination they have towards patient industry. It is a feast or a famine It lessons their love for home. It tends to increase petty wayside thefts or crimes. The mortality among the wanders is very great and greater among the infants and children who perish for deseases due to exposure. Those who retain their lands are still under a cloud. No one knows how soon he may be dispossed. The encoragement to improve is absent. The better a mans land is sooner some Bengali will covet it and oust him from it. (Report on the condition of the santhals in the district of Birbhum, Bankura, Midnapore and North Balassore. M. C. Mcalpin.)

একদা দিকুদের কাছে ছোটনাগপুর মালভূমি ছিল Land of Tibet, দীর্ঘকাল শাসন ও নিষ্পেষণে ছোটনাগপুর Land of Coolie-তে পরিণত হয়। ঝাড়খণ্ডী মানুষদের সাথে যাঁরা দীর্ঘদিন সহাবস্থান করেছেন, যাঁরা ঝাড়খণ্ডী মানুষদের সুখ-দুঃখের শরিক এবং একই ভাবে জীবনযাপন করেন, যেমন— কামার, কুমোর গোয়ালা, তাঁতি, পেঁড়ে, লোহার, মোমিন প্রভৃতি লোকেদের আদিবাসীরা দিকু বলেন না, দিকু তাদেরই বলা হয় যারা বহিরাগত, শোষক এবং প্রবঞ্চ ক।

ভেরিয়ার এলউইনের মতে ১৯২১ সালের মধ্যে ২/৩ অংশ ঝাড়খণ্ডী মানুষকে উৎখাত করা হয়েছিল—গিরমিট (Agreement) করে, চালান দেওয়া হয়েছিল নীল চাষ করতে, আসাম এবং উত্তর বঙ্গের চা বাগানে, মরিসাসে, ক্রেওলে কিংবা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। যাদেরকে চালান দেওয়া হলো না তাদের আসতে হলো পরিযায়ী দেশান্তরিত কৃষি শ্রমিক হিসাবে।

নামাল কথার অর্থ পাহাড় নয়, নিচু অথবা সমতল জায়গা; সাঁওতালী ‘ইয়া’ প্রত্যয় যোগে নামালিয়ী। ঝাড়খণ্ডীদের যেটুকু অনুর্বর জমি ছিল সেটুকু প্রকৃতির দানে কোনরকমে রোপণ করে কিংবা বাড়ীতে বাড়তি লোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে আষাঢ় শ্রাবণে কিংবা ধান কাটার মরসুমে পিড়ি, পটলা, বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় নামাল খাটতে। কষ্ট দিয়ে জীবন শুরু সমাপ্তিও সেখানে। গানে গানে লেখা হয় তাদের জীবন লেখা-

“বাসাঝুর টুসু চিপলি টাকা লুভে নামাল চলিল। সিকি দিয়া রেলে চাপিল।

আকুপর মাঠে বীচ ভাঙ্গিতে পারে নাই। রেগয়া লাতে জানে নাই,

টুসু চিপলি হিড়ে বসি কাঁদি লাগিল।

ঝাড়খণ্ডী ছেলে-মেয়েদের এভাবেই আরম্ভ হয় বেদিয়া জীবন। নামালিয়াদের ছেলে এভাবেই বড় হয়। রাস্তায় জীবন শুরু, শেষ হয় রাস্তাতেই। ধান লাগাবার কাজ শেষ হলে সামান্য কিছু অর্জিত টাকা ট্যাকে গুঁজে আবার ফিরে যায় দেশে। ধান কাটার মরশুম পড়লে আবার আসার পালা। আবার গান—

আঁড়ি ঝামাল কামি, হুগলি জিলা নামাল কামি মুরেয়াক মনের মুদীম মসৎ রুক্। জাতিঞ উহরিতে জিউই চালাক'

জিউইঞ উইহাঁরতে জাঁতি চালাক'।

অর্থাৎ ভীষণ ঝামেলার কাজ হুগলী জেলা নামালের কাজ, নাকের সখের নাকছাবিটিও খসে পড়ে। জাতের কথা ভাবতে গেলে জীবন চলে যায়, জীবনের কথা ভাবতে গেলে জাত হারায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সুন্দরবন সাফাইয়ের কাজে ঝাড়খণ্ডীদের সুন্দরবন অঞ্চ লে নিয়ে আসা হয়। জঙ্গল সাফ করে নোনা জমিকে কৃষিযোগ্য করে তোলে। ড. নির্মলেন্দু দাসের মতে— সাঁওতালরাই সুন্দরবন অঞ্চলে কুলি হিসাবে প্রথম আসে, পরে গোসাবা, সাগরদ্বীপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বাংলাদেশে সাঁওতালদের সর্বশেষে উপনিবেশ হচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলে। চবিবশ পরগণার সাঁওতালেরা প্রায় সব হাজারীবাগ থেকে এসেছে বলে থীয়ারসন মন্তব্য করেছেন। সুন্দরবনের সুন্দরী, গরাণের জঙ্গলে সুন্দরবনের বাঘ, বিদ্যাধরী, চুর্নী এবং মালা নদীর জলে কুমীর এবং কামেটের বাস। এদের সাথে লড়াই করে টিকে থেকে ঝাড়খণ্ডীরা সুন্দরবন অঞ্চলকে আবাদী কৃষিযোগ্য করে তোলে। কিন্তু পরিণাম একই—

বন জঙ্গল কাটিকুটি ভেড়িয়ানে দিসি মাটি

এই বনের মাটিরে হলাক খাঁটি

রে বুনুয়া জাতি।


এই বন কাটালি বাঘ হরিং কুদালি

ঘর দুরা বাঁধলি

কিছুদিন বসবাস করলি

আধা মুলে লেলায় বাঙালী।

আসামের চা বাগিচার ঝাড়খণ্ডী জীবনও শোষণ, বঞ্চ নার কান্নাঝরা ইতিহাসের জীবন ।

স্বাধীনোত্তর ভারতে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের উন্নয়নের নামে আদিবাসী উৎখাতের খেলা চলছে। নীচে ১৯৫০-৯০ সালের আদিবাসী উৎখাতের সারণি দেওয়া হলো- পরিকল্পনা অবশিষ্টাংশ (লাখে) (যাদের কিছুই দেওয়া হয়নি)

উৎখাত

পুনর্বাসন

the concept of tribal development as it is presently n practice. It is all geared towards bringing the tribals into the mainstrem and this mainstream has been defined and set motion by the capitalist dominant class, and is therefore characterised by the capitalist / casteist value systems of the urban educated middle and upper class society, namely to exploit nature and natural resources to the maximum in order to draw the greatest profits at the quickest possible time. (Stan Ludruswamy Jharkhandis claim for Self rule.)

ভারতবর্ষের আদিবাসী মানুষদের জমির ইতিহাস, জিরেতের ইতিহাস, জীবনের ইতিহাস, জীবনধারা পরিবর্তনের ইতিহাস মানবিক এবং সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে আজও লেখা হলো না । আজও আদিবাসী এবং দেশজ মানুষকে সংস্কৃতায়ন এবং নির্বাকায়নের কানাগলিতে আনার সুকৌশল অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে।

এখন ঝাড়খণ্ডের মানুষ স্লোগান তুলেছেন – “জান দেঙ্গে, লেকিন জমিন নেহি দেঙ্গে”। সমতলের বাবুরা ইংরেজদের থেকেও সুকৌশলে ঝাড়খণ্ডের মানুষ, ঝাড়খণ্ডের জমি, ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদ শোষণের অভিনব প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন — But their histiry has been one of exploitation subjugations and marginalisation. As the tribals settled in the forest established a symbiotic relationship with nature and built up their sicoal econimic and religious lives the plains men through deceit, fraud and force took away years of hard labour, induvidual colletcive fiol and dispossesed the tribals of their livelihood, culture and religious (Parkas Louis, Marginalisation of Tribals. EPW.No. 18-21-200 Vol. XXXV No 47).

ঝাড়খণ্ডের উন্নয়নের পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডী মানুষদের মূল স্রোতের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডীদের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা চলছে।



































































Post a Comment

0 Comments