মেঘনাদ সাহা
মেঘনাদ সাহা ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর ঢাকা জেলার শ্যাওড়াতলী গ্রামে (অধুনা বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন। মেঘনাদ সাহা তাঁর পিতামাতার পঞ্চম সন্তান ছিলেন। মেঘনাদ সাহা যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন সেই মুহূর্তটি ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ—ঝড়বৃষ্টির রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে ঠাকুমা ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করে এই নাতির নাম রেখেছিলেন ‘মেঘনাথ'। পরবর্তীকালে এই ‘মেঘনাথ' নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘মেঘনাদ'। মেঘনাদ সাহার বাবার নাম জগন্নাথ সাহা এবং মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী।
জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদী। শ্যাওড়াতলী গ্রাম থেকে কিছু দূরে বলিয়াদি বাজারে জগন্নাথ সাহার মুদির দোকান ছিল। তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে ছিল তার পরিবার--মুদির দোকান চালিয়ে কোনও রকমে দিন কাটাতেন তিনি। ছেলেমেয়েদের বড়ো করে তুলবার জন্য, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার জন্য জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবী কঠোর পরিশ্রম করতেন। ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন শান্ত ও বুদ্ধিমতী। ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। বালক মেঘনাদ তাঁর মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
বড় ছেলে জয়নাথের পড়াশোনার লেখাপড়ার ব্যাপারে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি জগন্নাথ। বড় ছেলের পড়াশোনার জন্য তিনি সাধ্যমত পয়সা খরচও করেছিলেন। কিন্তু জয়নাথ তখনকার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। সেজন্য জগন্নাথ সাহা প্রথমে ভেবেছিলেন যে তিনি তার অন্য ছেলেদেরকেও লেখাপড়া শেখাবেন না। কিন্তু প্রতিভা থাকলে তার তো স্ফুরণ হবেই। বালক মেঘনাদকে প্রথমে ভর্তি করে দেওয়া হল গাঁয়ের পাঠশালায়। বাল্যকালেই মেঘনাদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও তার প্রতিভা পাঠশালায় মাস্টারমশায়দের বিস্মিত করল। এই পাঠশালারই দুই শিক্ষক শশীভূষণ চক্রবর্তী ও যতীন চক্রবর্তীরও বালক মেঘনাদের পড়াশোনার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি ছিল। সেই সময় মেঘনাদদের পরিবারিক আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। এই আর্থিক অনটনের জন্য বালক মেঘনাদের যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয়ে যায় সে ব্যাপারে খুবই সজাগ ছিলেন এই দুই মাস্টারমশায়। মেঘনাদের দাদা জয়নাথেরও আশানুরূপ লেখাপড়া না হওয়ায় তিনিও উদ্যোগী হয়েছিলেন তার প্রতিভাবান ভাইয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে। তবুও বালক মেঘনাদকে লেখাপড়া ছাড়াও অবসর সময়ে পারিবারিক কিছু কাজও করতে হত। সেজন্য তাকে বাবার মুদীর দোকানেও মাঝে মাঝে বসতে হত, বাবাকে দোকান চালানোর ব্যাপারে সাহায্য করবার জন্য। তবে ছোটবেলা থেকেই মেঘনাদ সাহা ছিলেন সুস্থ ও সবল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা তো কম নয় ৷ সেজন্য সে ছোটবেলা থেকেই অন্যান্য বন্ধুদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতে ও নৌকা চালাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। পাঠশালাতে পড়বার সময়ই মেঘনাদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই ভাল অভ্যেস গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় সূর্য ওঠার আগেই সে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসত। শুধু তাই নয়, যদি কোনওদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙাতে দেরি হত তাহলে পড়াশোনা হয়নি বলে কাঁদতে শুরু করে দিত। সেজন্য বাড়ীর অন্যান্যরা তাঁকে ‘কাঁদুনে ছেলে' নামেও ডাকত।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর মেঘনাদ কোথায় কোন হাইস্কুলে পড়বে সে ব্যাপারে পরিবারের সকলের ভাবনা চিন্তা শুরু হয়ে গেল। সেই সময় শ্যাওড়াতলী গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়াতে একটি ইংরাজী স্কুল ছিল। কিন্তু নিজের গ্রাম থেকে প্রতিদিন কুড়ি কিলোমিটার যাওয়া আসা করে ওই স্কুলে পড়া তার পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য
হয়ে দাঁড়াল। ভাইয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে দাদা জয়নাথ তখন খুবই চেষ্টা করতে লাগল। শিমুলিয়ার ডাক্তারবাবু অনন্ত কুমার দাস ছিলেন জয়নাথের খুবই পরিচিত। সেই ডাক্তারবাবুই শিমুলিয়াতে মেঘনাদের পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তারবাবু নিজের বাড়ীতেই রেখে দিলেন মেঘনাদকে। ভালই হল মেঘনাদের—সেখানে তার বিনে পয়সায় খাওয়া থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। তবে অবসর সময়ে কিছু কাজকর্মও করে দিতে হত। পরবর্তীকালে মেঘনাদ সাহা যখন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী হিসেবে সম্মান অর্জন করেছেন তখন তিনি তার বাল্যকালের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে শিমুলিয়ার এই ডাক্তারবাবুর সাহায্য না পেলে তিনি কখনোই বড়ো বিজ্ঞানী হতে পারতেন না। শিমুলিয়ার ওই স্কুল থেকে মাত্র বারো বছর বয়সে ঢাকা বিভাগ থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হলেন এবং মাসিক চার টাকা করে বৃত্তিও লাভ করলেন। শিমুলিয়ার পড়া শেষ করে ছাত্র মেঘনাদ এবার দাদা জয়নাথের সাথে এলেন ঢাকা শহরে। মেঘনাদ ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। সেইসময় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ছিল সরকারী স্কুল এবং খুবই নামকরা স্কুল। এই স্কুলে পড়াশোনার সময় মেঘনাদের প্রতিমাসে খরচ হত এগারো টাকা। তিনি নিজে চার টাকা বৃত্তি পেতেন। দাদা জয়নাথ দিতেন পাঁচ টাকা। এছাড়া বৈশ্য সমিতিও মেঘনাদকে প্রতি মাসে দু টাকা করে বৃত্তি দিতেন। এইভাবে প্রতি মাসে মোট এগারো টাকা পাওয়া যেত। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েই মেঘনাদ লেখাপড়ার এক বৃহত্তর জগতের সাথে পরিচিত হলেন এবং তিনি ভাল ভাল ছাত্র ও ভাল ভাল শিক্ষকের সংস্পর্শ লাভ করলেন। এই স্কুলেই তিনি নিখিলরঞ্জন সেনকে সহপাঠীবন্ধু রূপে পেয়েছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতের অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
মেঘনাদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে। ১৯০৫ সালটি অবিভক্ত দুই বাংলার ক্ষেত্রে ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। সেই সময় ভারতের বড়লার্ট ছিলেন লর্ড কার্জন এবং তখন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবিভক্ত বাংলা সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। সেজন্য এই অবিভক্ত বাংলাকে দু ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন। লর্ড কার্জনের এই বাংলা ভাগ করার চক্রান্তে সারা অবিভক্ত বাংলা গর্জে উঠল—শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ইংরেজ বিরোধী সভা, মিটিং মিছিল ইত্যাদি। ছাত্রসমাজেও এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছিল। কলকাতা ও ঢাকা এই দুই শহর ছিল এই আন্দোলনের প্রধানকেন্দ্র। ঠিক এই সময়েই ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন গভর্নর স্যার বাম্পফিল্ড ফুলার। সেইদিন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা ঠিক করলেন যে ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে তারা ফুলার সাহেবের স্কুল পরিদর্শনের দিন খালি পায়ে স্কুলে আসবেন। এইসব প্রতিবাদী ছাত্রদের আন্দোলনে ছাত্র মেঘনাদ সাহাও সামিল হয়েছিলেন। ফুলার সাহেব ওই স্কুলে আসার দিন খালি পায়ে স্কুল আসার অপরাধে অভিযুক্ত সব ছাত্রকেই স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল । এই তাড়িয়ে দেওয়া ছাত্রদের দলে মেঘনাদ সাহাও ছিলেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে মেঘনাদ সাহার পড়া বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয় মেঘনাদ সাহা ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে গভর্নমেন্ট থেকে প্রতি মাসে যে চার টাকা করে বৃত্তি পেতেন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তবে এই ঘটনায় মেঘনাদ সাহার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল না। ভাল ছাত্র তখন ঢাকা শহরে মেঘনাদ সাহার সুখ্যাতি ছিল। তখন ঢাকার কোন ভাল বেসরকারী স্কুল ছিল-কিশোরীলাল জুবিলী স্কুল। এই স্কুলের শিক্ষকরা দেশপ্রেমী ছাত্র মেঘনাদ সাহাকে তাদের স্কুলে ভর্তি করে নিল এবং মেঘনাদ সাহা ঠিকমত যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন সেজন্য তাঁকে আর্থিক সাহায্যও দিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে এই জুবিলী স্কুল থেকে মেঘনাদ সাহা এনট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন এবং পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এবার তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পালা। পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজ থেকে আই এস সি এবং প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে এই জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞানী দেশ বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রে গবেষণা আন্তজার্তিক খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।
0 Comments