বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরই

বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরই 




জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক টীকা আবিষ্কার করেন। ছাত্রজীবনে লুই প্রথমে খুবই সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন। লুই-এর বাবা অর্থাৎ যোসেফ পাস্তুর তাঁর ছাত্রজীবনে পড়াশোনার সুযোগ খুব একটা পাননি সেজন্য তাঁর ইচ্ছা ছিল যে লুই ভালভাবে লেখাপড়া শিখে একজন স্কুল শিক্ষক হোক। কিন্তু লুইয়ের ছাত্রজীবনের প্রথমদিকে লেখাপড়ায় লুইয়ের বিশেষ কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু পরে লুই-এর মনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে এবং তিনি তাঁর বাবার ইচ্ছামত নিজেকে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। এই সময় লুই-এর শিক্ষক মঁসিয়ে রোমানেট লুইকে লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। তিনি একদিন লুইকে প্যারিস শহরের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ইকোল নর্মালে পড়াশোনার জন্য উৎসাহিত করেন। কিন্তু নিজের শহর থেকে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার দূরে মাত্র পনের বছরের একজন ছাত্র থাকতে পারবে কি না সে ব্যাপারে লুই-এর বাবা মা খুবই চিন্তিত ছিলেন। এই সময় লুই-এর বাবার এক বন্ধু ক্যাপটেন বাবিয়ার প্যারিস শহরে লুই-এর পড়াশোনার ব্যাপারে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। তবে প্যারিস শহরে পড়তে লুই একা গেলেন না—তার সঙ্গে তার বন্ধু জুলে ভার্সেলও প্যারিস শহরে গেলেন। ইকোল নর্মালে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না—কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নর্মাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত। সেই সময় নিজের খরচ চালানোর জন্য সে এক স্কুলে ফিজিক্স ও অঙ্ক পড়ানোর কাজ নিয়েছিল। তাই কঠোর পরিশ্রম করে লুই নর্মালে ভর্তির জন্য পড়াশোনা ও অন্য স্কুলে পড়ানোর কাজ একই সাথে চালিয়ে যেতে লাগল। 1843 খ্রীস্টাব্দে তিনি ইকোল নর্মালে ভর্তির জন্য যোগ্য হন। তারপর লুই পাস্তুরের এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।

এখানেই লুই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও নিষ্ঠার জন্য শিক্ষকদের অতি প্রিয় হয়ে উঠলেন। ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দে তিনি ‘মাস্টার অফ সায়েন্স' উপাধি লাভ করেন। ইকোল নর্মালের ছাত্রাবস্থায় তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত বিখ্যাত রসায়ন অধ্যাপকদের সংস্পর্শে আসেন এবং তখন থেকেই রসায়ন শাস্ত্রে গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহর সৃষ্টি হয়। এই সময় কেলাসবিজ্ঞানী ডেলাফস রসায়ন বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য লুইকে অনুপ্রাণিত করেন। বিজ্ঞানী ডেলাফসের অনুপ্রেরণায় লুই রাসায়নিক যৌগের গঠন ও কেলাসের গঠন বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই সময় তিনি কেলাসের মধ্য দিয়ে আলোর সমবর্তনের ফলে গতিপথ বিষয়ে গবেষণা করেন এবং মিসচারলিখের রিডল' সমাধান করেন। এর ফলে লুই বিজ্ঞানী মহলে খ্যাতি অর্জন করেন। গবেষণায় এই সাফল্যের জন্য তিনি লিল্লের বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

পরবর্তীকালেও এই ছাত্রের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল হবে। সেই সময় অ্যাপেলড্রন শহরে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। রন্টজেনের বাবা ফ্রেডরিক বালক রন্টজেনকে অ্যাপেলড্রনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় মার্টিনাস হারমান ভ্যানড্ররনে ভর্তি করে দেন। আর এই স্কুলের পিছনে একটি বিশাল বড় খাল ছিল—সেই খালে ভাসমান নৌকায় তরি তরকারী, ফুল এবং আরও নানান জিনিষপত্র বিক্রি করত অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা। ওইসব শিশুদের জীবনযাপনের চিত্র বালক রন্টজেনের মনে খুবই প্রভাব বিস্তার করত। অ্যাপেলড্রনের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রত্যেক ছাত্রকেই ফরাসী ও ওলন্দাজ ভাষা শিখতে হত। এই বিদ্যালয়ে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা শেখানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ ছিল এবং তখনকার ভাল ভাল পুস্তকগুলি এই দুই ভাষায় রচিত থাকত। ছাত্রজীবনে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা শিখতে না পারার জন্য রন্টজেনকে ভবিষ্যৎ জীবনে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ফরাসী ও ওলন্দাজ ভাষা ছাড়াও ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভূগোল এবং ওলন্দাজ জাতির ইতিহাস শেখাও প্রত্যেক ছাত্রর কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। তবে ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ছিল খুবই উন্নতমানের।

প্রত্যেক ছাত্রকে ছোটবেলা থেকেই অধ্যাবসায়ী ও পাঠক্রমে আগ্রহী করার ব্যাপারে শিক্ষকরা সচেষ্ট ছিলেন। বিজ্ঞানী রন্টজেন তার বাল্য জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনও একটি ক্লাসে ছয় জনের বেশী ছাত্র নেওয়া হত না এবং প্রতিটি ছাত্রকে আলাদা আলাদাভাবে বাড়ীর পাঠ দেওয়া হত। রন্টজেন বলেছেন যে, তিনি ছাত্রজীবনে ধীরগতির ছাত্ররূপেই পরিচিত ছিলেন এবং তখন তার পড়াশোনার মান খুব বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল না, অর্থাৎ ছাত্র হিসেবে বালক রন্টজেনের কোনও সুনাম ছিল না। তবে অ্যাপেলড্রনের এই স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতে বালক রন্টজেনের প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা গভীর হয়। ছাত্র রন্টজেন অবসর পেলেই অন্যান্য বন্ধুদের সাথে অ্যাপেলড্রনের বিভিন্ন বাগানে ও নিকটবর্তী বনে ঘুরে বেড়াতে খুবই ভালবাসতেন। অ্যাপেলড্রনের এই নামী প্ৰাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করার পর বালক রন্টজেন উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য উট্রেক্টের এক জিমন্যাসিয়মে ভর্তি হন এবং সেখানে তাঁর বাবার বন্ধুতুল্য ছিলেন রসায়নবিদ গানিং।

ছাত্র রন্টজেন এই গানিং পরিবারের সাথে ‘পেয়িং গেস্ট' হয়ে থাকতে শুরু করেন। সেই সময়ে নিয়ম ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে হলে প্রত্যেক ছাত্রকে জিমন্যাসিয়মে পড়তে হবে। সেইজন্য যে সব ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চাইত, সেইসব প্রতিটি ছাত্রকে প্রায় বারো বছর বয়স থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত জিমনাসিয়মে পড়তে হবে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যই রন্টজেন সেই সময়ে জিমন্যাসিয়মে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন উট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা খুবই কঠিন ও ভীতিপ্রদ ছিল এবং খুব কম সংখ্যক ছাত্রই সসম্মানে ওই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হত। কিশোর রন্টজেনের যখন ষোলো বছর বয়স তখন তার জীবনে আকস্মিক এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি এইরূপ—

একদিন সকালে কিশোর রন্টজেন বই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে স্কুলে পৌঁছে, স্কুলের বারান্দা দিয়ে ক্লাসঘরের দিকে যাচ্ছিলেন এবং যাবার সময় লক্ষ্য করলেন যে তার সহপাঠী এক বন্ধু বারান্দার জানলার এক পর্দায় চক দিয়ে কিছু একটা আঁকছে। ওই স্কুলের এক শিক্ষক, যিনি ধর্মবিষয়ক ক্লাস নিতেন, তিনি ছাত্রদের কাছে খুবই অপ্রিয় ছিলেন। রন্টজেন বারান্দার ওই পর্দার কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন যে সহপাঠী বন্ধুটি ওই পর্দায় চক দিয়ে সেই অপ্রিয় ধর্মশিক্ষকের ব্যঙ্গচিত্র আঁকছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে রন্টজেন ওই ছবিটি দেখতে থাকেন। ছবিটির কাজ যখন প্রায় শেষ হতে চলেছে সেই সময়ে সেই কঠোর ও অপ্রিয় ধর্মশিক্ষক ওই বারান্দা দিয়েই হেঁটে আসছিলেন। ওই শিক্ষককে দেখে অন্য ছাত্ররা দ্রুত তাদের নিজের নিজের ক্লাসে চলে গেলেও রন্টজেন তখনও তন্ময় হয়ে সেই ছবিটি দেখছিলেন। বলা বাহুল্য সেই ধর্মশিক্ষক কিশোর রন্টজেনকেই এই ঘটনার প্রধান দোষী বলে সাব্যস্ত করলেন।

তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে রন্টজেনের বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন। নির্দোষ করেন। এক্সরশ্মি আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। নোবেল পুরস্কার থেকে পাওয়া সব অর্থই তিনি উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যান। তিনি যদি মনে করতেন তাহলে তিনি তাঁর এই এক্স রশ্মি আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই মানব জাতির সম্পদ–কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। সেই সময় অনেক বিজ্ঞানী চেয়েছিলেন যে এক্স রশ্মির নাম রন্টজেন রশ্মি হোক। কিন্তু বিজ্ঞানী রন্টজেন এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। রন্টজেন আবিষ্কৃত এক্স রশ্মি আজ চিকিৎসা জগতের এক অমূল্য সম্পদ এবং পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান চর্চার এক অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। ১৯২৩ সালে আটাত্তর বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ।


Post a Comment

0 Comments