ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা




ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা 

কোনো কাজ করতে গিয়ে যখন কেউ কোনো ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে বসেন, তখন সেই ধরনের প্রতিজ্ঞাকে বলা হয় 'ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা'। প্রতিজ্ঞাটির তাৎপর্য এমনই যে, এটি বাংলা সাহিত্যে একটি কালজয়ী প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই প্রতিজ্ঞার উৎস কী ?

আমরা সকলে মহাভারতের অন্যতম একটি উজ্জ্বল চরিত্র ভীষ্ম সম্পর্কে পরিচিতি আছি । তিনি একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি কখনো বিবাহ করবেন না। অর্থাৎ চিরকুমার থাকবেন। বলাবাহুল্য, ভীষ্মের এই প্রতিজ্ঞাটি সাধারণের বিচারে এমন একটি ঘোষণা যা, পালন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ভীষ্ম কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞার মর্যাদা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অটুট রেখেছিলেন। সেই থেকে ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা” কথাটি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এখন আলোচনা করা যাক কখন, কী পরিস্থিতিতে ভীষ্ম এই প্রতিজ্ঞাটি করেছিলেন।

একদিন ভরতবংশীয় পুরুরাজ শান্তনু যমুনা তীরে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় তিনি আচমকা উৎকৃষ্ট একটি সুগন্ধ অনুভব করেন। সেই সুগন্ধের উৎস কী ? রাজা তার সন্ধান শুরু করলেন। এমন সময় নিষাদদের মতো দেখতে এক পরমা সুন্দরীকে তিনি দেখতে পেলেন । রাজা জিজ্ঞাসা করলেন— “কল্যাণী, কে তুমি ? কোথা থেকে এসেছো ?”

জবাবে কন্যা বললেন- “হে রাজন! আমি নিষাদ কন্যা! পিতার ইচ্ছানুসারে নৌকা চালাই।”

বলাবাহুল্য, রাজা শান্তনু প্রথম দর্শনেই নিষাদ কন্যার রূপে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে বিবাহ করতে উৎসুক হন। তিনি সত্ত্বর নিষাদরাজের কাছে গেলেন এবং বললেন— “মহাশয়! আমি আপনার কন্যার পাণিগ্রহণ করতে চাই!”

প্রত্যুত্তরে নিষাদরাজ বললেন- “হে রাজন! যেদিন থেকে এই কন্যাটিকে আমি পেয়েছি সেদিন থেকেই আমি এর বিবাহের জন্য চিন্তিত আছি। তবে এ প্রসঙ্গে আমার একটি সুপ্ত বাসনা আছে। যদি আপনি এই কন্যাকে সহধর্মিণী হিসাবে গ্রহণ করেন তাহলে আপনাকে কথা দিতে হবে যে, আপনি আমার মনোবাসনাটি পূরণ করবেন। আমি জানি, আপনি একজন আদর্শনিষ্ঠ মহান রাজা। আপনার মতো পাত্র পাওয়া যে কোন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছে পরম সৌভাগ্যের।”

রাজা শান্তনু বললেন— “আপনি আগে শর্তটি প্রকাশ করুন। আমার সাধ্যাতীত না হলে, তা অবশ্যই পূরণ করবো।”

নিষাদরাজ তখন সামন্য ইতস্তত ভাবটি দূর করে বললেন- “হে রাজন! আমার সাধ হলো এই যে, আমার কন্যার গর্ভজাত সন্তান ভবিষ্যতে রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে আপনার অন্য কোন পুত্র সিংহাসনের দাবীদার হতে পারবেন না।”

রাজা শান্তনু সেই সময় কন্যাটিকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এবং বিবাহের জন্য বিশেষ আগ্রহী হলেও নিষাদরাজের শর্তটি তাঁর কাছে অত্যন্ত কঠিন এবং দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে হয়েছিল। তাই অনন্যোপায় হয়ে শুধু কন্যাটির কথা চিন্তা করতে করতে সেদিন তিনি রাজগৃহে ফিরে এলেন। কিন্তু রাজা সেই থেকে মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও আনমনা হয়ে পড়লেন ।

তবে রাজার এই মনমরা ভাবটি পুত্র দেবব্রতের নজর এড়ায়নি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন— “পিতা জগতের সব কিছু আপনার করায়ত্ত, তবুও আপনাকে এতো চিন্তিত দেখি কেন ? কারোর সঙ্গে এমন কি, আমার সঙ্গেও আপনি ভালো করে কথা বলছেন না। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেও বেরোচ্ছেন না। আপনার স্বাস্থ্যহানি ঘটছে । আপনি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। দয়া করে আমাকে সব কিছু খুলে বলুন। মনের কথা নিজের মধ্যে আর্টকে রাখবেন না।”

শান্তনু পুত্রের কথায় অনেকটা সহজ বোধ করলেন এবং বললেন— “পুত্র! আমি সত্য গোপন করবো না। সত্যি আমি চিন্তিত। আমার এই গৌরবোজ্জ্বল বংশে তুমিই একমাত্র উত্তরাধিকারী। তুমি সব সময় বীরের মতো নানা বিপদে, আপদে, রাজ্যের স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমি তোমাকে নিয়ে খুব ভয় পাই। কখনো যদি তোমার কোনো ভালোমন্দ হয়ে যায়, তখন তো আমার বংশ লোপ পাবে। তাই বলে এই নয় যে, আবার বিবাহ করতে মনস্থ করেছি। কিন্তু বংশ পরম্পরা রক্ষা করতে চিন্তা তো করতেই হয়।'

দেবব্রত তখন পিতার মনোকষ্টের কারণ বুঝতে পারলেন। এবং আর কালবিলম্ব

না করে প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে নিষাদ রাজের কাছে গেলেন। সেখানে কোনো রকম ভণিতা না করে তাঁর পিতার জন্য নিষাদ কন্যাকে প্রার্থনা করলেন।

নিষাদরাজ অত্যন্ত সমাদর করে দেবব্রত এবং তাঁর সঙ্গীদের আপ্যায়ন করে বললেন- “হে ভরতবংশ গৌরব! রাজা শান্তনুর বংশ রক্ষার জন্য পুত্র দেবব্রত খুবই সুযোগ্য এবং পারঙ্গম। তবে এটাও ঠিক যে, কন্যার পিতা হিসাবে এমন সম্বন্ধ আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এমন বিবাহ প্রস্তাব ভেঙে গেলে স্বয়ং ইন্দ্ৰও অনুতাপ করবেন। এই কন্যা উচ্চবংশীয়া এবং আপনাদের সমমর্যাদা-সম্পন্না। তাঁর পিতা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন রাজা শান্তনুর সঙ্গে কন্যা সত্যবতীর বিবাহ দিই। এই কন্যাকে আমি পালন পোষণ করে বড়ো করেছি। আমি এর পালক-পিতা। এই বিবাহে আমার একটাই আশঙ্কা । সত্যবতীর পুত্রকে একদিন না একদিন প্রবল শত্রুতার মুখোমুখি হতে হবে। যুবরাজ! এটা তো ঠিক যে, আপনি যার শত্রু হবেন সে যতই পরাক্রমশালী হোক, সে পরাভূত হবেই। একথা চিন্তা করে আমি আপনার পিতাকে এই কন্যাদানে সম্মত হইনি।”

গঙ্গা-পুত্র দেবব্রত নিষাদরাজের কথায় খুবই আঘাত পেলেন এবং সর্বসমক্ষে তখন ঘোষণা করলেন— “আমি শপথ করছি যে, ভরতবংশের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হবে এই কন্যারই গর্ভস্থ সন্তান। আমার বিশ্বাস, এই প্রতিজ্ঞা অভূতপূর্ব, যা আমি আমৃত্যু পালন করব।”

এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় নিষাদরাজ অত্যন্ত পুলকিত হলেও তাঁর চাওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল। তিনি বললেন— “যুবরাজ! সত্যবতীর জন্য এইমাত্র আপনি যা ঘোষণা করলেন তা আপনার দ্বারাই সম্ভব। তবে আমার আরও একটি চিন্তা সত্যবাতীকে নিয়ে রয়েই গেছে । আপনি ভবিষ্যতে সিংহাসন দাবী করলেন না ঠিকই, কিন্তু আপনার কোনো সন্তান যদি সেই দাবী কোনদিন করে বসে ?”

দেবব্রত পিতার ইচ্ছাপূরণে ছিলেন অবিচল ও বদ্ধপরিকর। তখন সেই ভরা সভায় তিনি পুনরায় ঘোষণা করলেন— “আমি আমার পিতার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ভবিষ্যতে রাজ্যের দাবী ত্যাগ করছি। সেই সঙ্গে আরও ঘোষণা করছি যে, আমি আজীবন অখণ্ড ব্রহ্মচর্য ধারণ করবো। সন্তান না হলেও আমি অক্ষরধাম লাভ করবো।”

পিতার ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য গঙ্গানন্দন দেবব্রতের এই ঘোষণা এককথায় অভূতপূর্ব! অশ্রুতপূর্ব! নিষাদরাজ ভাবতেই পারেননি যে, এমন প্রতিজ্ঞা কেউ কোনদিন ঘোষণা করতে পারেন। তিনি সেই মুহূর্তে ঘোষণা করলেন— “আমি রাজর্ষি শান্তনুকে

আমার কন্যা সানন্দে সমর্পণ করছি। রাজর্ষিকে অবিলম্বে এই সংবাদ পাঠানো হোক।”

স্বর্গ থেকে অপ্সরা ও দেবতাগণ, নরলোক থেকে নর ও ঋষিগণ এই ঘোষণায় বিস্মিত হলেন। তাঁরা পুষ্পবৃষ্টি করে দেবব্রতকে অভিনন্দিত করলেন। সকলে একটা কথাই বলতে লাগলেন— 'এমন প্রতিজ্ঞা কোনদিন কেউ করতে পারেনি। এমন ব্যক্তির আত্মজ্ঞান, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসংযম অসাধারণ। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞাকারীর নাম 'ভীর' হওয়া উচিত।'

এরপর গঙ্গানন্দন কন্যা সত্যবতীকে রথে বসিয়ে হস্তিনাপুর গেলেন। সেখানে পৌঁছে পিতার হাতে মাতা সত্যবতীকে অর্পণ করলেন। দেবব্রতের এই আত্মত্যাগ লোকমুখে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো। তখন তিনি আর দেবব্রত নন, ভীষ্ম নামেই পরিচিত হলেন। পুত্রের এমন আত্মবলিদান পিতা শান্তনুকে এতখানি আনন্দ দান করল যে, তিনি পুত্রকে বর দিয়ে বললেন- “তুমি যতদিন বাঁচতে চাও, ততদিন বাঁচবে, মৃত্যু তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। তুমি ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী হবে। জগতে তোমার এই প্রতিজ্ঞা চিরকাল অমর ও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।


Post a Comment

0 Comments