মার্কণ্ডেয় মুনির দর্শনে সহস্র যুগের শেষে ভাবী প্রলয়ের বর্ণনা
বৈশম্পায়ন বললেন, মৎসোপাখ্যান শোনার পর যুধিষ্ঠির পুনরায় মহামুনি মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করলেন— “হে মহাতপা! আপনি হাজার হাজার বছর ধরে চলা কালপ্রবাহ দেখেছেন । প্রত্যক্ষ করেছেন কত অত্যাশ্চার্য কত মহাপ্রলয়। শুনেছি মহাপ্রলয়ের পর সমগ্র ভূমণ্ডলে দেব-দানব-মানব সহ অন্যান্য সকল প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রলয় শেষ হলে আপনি দীর্ঘকালব্যাপী ব্রহ্মার উপাসনা করেছিলেন। পরিণাম স্বরূপ, ব্ৰহ্মা তখন কৃপা করে যেভাবে প্রথমে বাতাস, তারপর জল এবং শেষে প্রাণ সঞ্চার ঘটিয়ে সৃষ্টির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন; তা আপনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আপনি দেখেছিলেন ভগবান পিতামহ সৃষ্টির কারণে কিভাবে সকলের পিতামহ, সাক্ষাৎ বিধাতা ভগবানের আরাধনা করেছিলেন।
আমি জানি, আপনি ভগবান নারায়ণের একজন পরম ভক্ত। আপনার গুণগান ভূলোক সহ অন্য লোকগুলিতে গীত হয়। আপনি ব্রহ্ম উপলব্ধির স্থান থেকে উৎপন্ন হৃদয় কমল কর্ণিকাকে যোগকলার দ্বারা সক্রিয় করে তুলেছিলেন। তারপর বৈরাগ্য ও অভ্যাসের দ্বারা প্রাপ্ত দিব্যদৃষ্টি অনুভূতির সাহায্যে বিশ্বস্রষ্টা পরম ব্রহ্মকে অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ব্রহ্মার অসীম কৃপায় আপনি ধন্য। জরা ও মৃত্যু আপনার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি, একারণেই। বিপ্রবর! জগতের সকল ভাঙা-গড়ার সাক্ষী হলেন আপনি। আমি সেই অমৃতকথা আপনার মুখে শুনতে চাই।”
মার্কন্ডেয় বললেন— “রাজন! শ্বাশ্বত, অব্যক্ত, অব্যয়, অতিসূক্ষ্ম, গুণ-স্বরূপ নির্গুণ প্রাণ পুরুষ স্বয়ম্ভূকে প্রণাম করে তোমার সামনে তাঁর গুণকীর্তন করছি। তিনি পীতাম্বরধারী জনার্দন, সকলের কর্তা, বিধাতা। সকল ভূতের আত্মা তিনি। আশ্চর্য, মহৎ এবং পবিত্র। তিনি অনাদিনিধন, বিশ্বব্যাপী অব্যয় ও অক্ষয়। তিনি স্বয়ং কর্তা। তিনি কখনোই কার্য নন। বরং সকল পুরুষের কারণ। তিনি সকলকে জানেন। কিন্তু আমরা তাঁকে জানি না, এমন কি দেবতারাও এঁকে জানেন না। সমস্ত জগতের প্রলয় হওয়ার পরেও এই আদিভূত পরমেশ্বর থেকেই সম্পূর্ণ আশ্চর্যময় জগৎ মায়াজালের ন্যায় পুনরায় সৃষ্টি করেছে।
হে পান্ডুনন্দন, প্রলয়কালে জগতের সকল কিছু বিনষ্ট হলে পরমাত্মা ভগবান পুনরায় জগৎ সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টির প্রথম পর্ব এসেছিল সত্যযুগের হাত ধরে। তার স্থায়িত্ব ছিল চার হাজার দিব্য-বর্ষ। সেই যুগের সন্ধ্যাকাল এবং সন্ধ্যাংশ ছিল উভয় ক্ষেত্রে আরও চারশত বছর জুড়ে। ফলে ঐ যুগের মোট বিস্তৃতি ছিল চার হাজার আটশত দিব্য-বছর। এর পরে এসেছিল ত্রেতা যুগ । যার বিস্তৃতি ছিল তিন হাজার দিব্য বৎসর। এবং সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ছিল যথাক্রমে আরও তিনশত বৎসর। অর্থাৎ মোট তিনহাজার ছ’শত দিব্য-বৎসর ব্যাপী ত্রেতাযুগ স্থায়ী ছিল। তারপরে এসেছিল দ্বাপর যুগ। এটি স্থায়ী ছিল দু'হাজার দিব্য-বছর, তার সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ প্রত্যেকটি ছিল দু’শত বছ জুড়ে। অন্যদিকে সবশেষে এসেছিল কলি যুগ। এটি এক হাজার দিব্য- বৎসর জুড়ে স্থায়ী, এই যুগের সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যাংশ, প্রত্যেকটি একশত বৎসর জুড়ে বিস্তৃত। হে রাজন! কলি যুগ শেষ হলে আবার সত্যযুগ ফিরে আসবে। এভাবে মোট বারো হাজার দিব্য বৎসর জুড়ে এই যুগচক্র বা চতুর্যুগ আবর্তিত হচ্ছে।”
প্রসঙ্গত একহাজার চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন হয়, সমস্ত জগৎ ব্রহ্মার একদিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। দিন শেষ হলে রাত্রি আসে । তাকেই বলে বিশ্বপ্রলয় ।
“হে নরপতি! কলিযুগ যখন অন্তিম পর্বে, তখন মানুষেরা বেশিরভাগই মিথ্যাবাদী হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণদের আচরণ শুদ্রের মতো হয়। শূদ্রেরা তখন অর্থোপার্জন-সহ ক্ষত্রিয়ের নানান জীবিকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণগণ পড়াশুনা, বেদ অধ্যয়ন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে বিচারবোধ হারিয়ে, আগ্রাসী ও নিলর্জ্জ প্রবৃত্তি ধারণ করতে শুরু করে। অন্যদিকে, শুদ্রেরা জপ-তপ ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করতে থাকে। এভাবে বর্ণাশ্রমের বিপরীতমুখী উত্থান প্রলয়ের পূর্ব লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। বাস্তবে পৃথিবীতে তখন ম্লেচ্ছদের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা বিপরীত জীবিকায় নিযুক্ত হতে থাকে। সার্বিকভাবে মানুষেরা স্বপ্নায়ু, হীনবল, খর্বাকার এবং সামান্য সত্যভাষী বা অধিকাংশ মিথ্যাভাষী হয়ে পড়ে। ঈশ্বর ভাবনা বা ধর্মাচরণ মেকি ও কপটতায় ভরে যায়। জনপদগুলি প্রায় জনশূন্য এবং চতুর্দিকে মৃগ ও হিংস্র জন্তুদের দৌরাত্মে ভরে যায়।
শুদ্রগণ ব্রাহ্মদের ‘ভো’ বলে সম্বোধন করে আবার ব্রাহ্মাণগণ শূদ্রদের ‘আর্য’ বলে মান্যতা দেয়। সুগন্ধি দ্রব্যগুলির গন্ধ লোপ পায়। সুস্বাদু বস্তুগুলির মিষ্টতা বা স্বাদ হ্রাস পেতে থাকে। গাভীগুলির দুগ্ধ দান করার ক্ষমতা কমে যায়। বৃক্ষাদিতে ফলমূল
কমে যায়। পাখিদের কলতান কদাচিৎ শোনা যেতে থাকে। সমাজে সদাচার সেইভাবে কিছুই থাকে না। মানুষদের নৈতিক চরিত্রের ভীষণভাবে অবনমন ঘটতে থাকে। নারীরা দৈহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দে আকৃষ্ট হয়। অনেকে আবার গণিকাবৃত্তিকে সাগ্রহে বেছে নেয়। ব্রাহ্মণরা ধর্মের রক্ষা না করে ধর্মের কারবারি হয়ে ওঠে। গৃহস্থেরা ভোগ ও লালসার বশবর্তী হয়ে অন্যায়ভাবে সম্পদ আহরণে মন দেয়। ব্রাহ্মণেরা ভেকধারী হয়ে বৈশ্যদের মতো জীবিকা উপার্জনে প্রয়াসী হন। মদ্যপান, ব্যাভিচার সহ অন্যান্য পাপাচার সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করতে শুরু করে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, দুর্যোগ, মহামারী, জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে থাকে। ব্যবসায়ীরা ধূর্ত, ছল ও কপট হয়ে ওঠে। পারস্পরিক সদ্বিশ্বাস সমাজ থেকে মুছে যায়। বা বিলুপ্ত হতে থাকে। মাংসাশী হিংস্র জন্তুর দৌরাত্মে মাঠ-ঘাট ভরে যায়। নারীরা সাত আট বছর থেকে যৌন ক্রিয়ায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। পুরুষেরা দশ-বারো বছর বয়স থেকে পিতা হওয়ার কাজে লিপ্ত হয়। তাদের অকাল বার্ধক্য নেমে আসে এবং তারা স্বল্পায়ু হতে থাকে। বালকেরা বৃদ্ধদের মতো এবং বৃদ্ধরা বালকদের মতো বিপরীতধর্মী আচরণ করতে শুরু করে। নারীরা নিজেদের স্বামীদের অগোচরে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়।
এভাবে কলিযুগের অবক্ষয় চলতে চলতে তা এক সময় অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রাণীদের আয়ু কমতে কমতে জীবনের নিয়ম যখন একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন ঘটে দীর্ঘকাল-ব্যাপী অনাবৃষ্টি। অন্নের অভাব বা খাদ্যদ্রব্যের অভাবের কারণে বহু মানুষ মারা যায়। গোটা পৃথিবী জুড়ে তাপপ্রবাহ এমনভাবে বাড়তে থাকে, যার ফলে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপর ‘সংবর্তক' নামে প্রলয়কালীন অগ্নি বায়ুর সাহায্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন মর্ত্যলোক ভেদ করে পাতাল লোকে আঘাত হানতে শুরু করে। ফলে দেবতা, দানব, যক্ষ সকলে মহা ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ক্রমে তা প্রথমে নাগলোককে বিনষ্ট করে এবং সবশেষে গোটা পাতালপুরীকে ভস্মীভূত করতে থাকে।
তারপর আবার দেখা যায় আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা। ভীষণ গর্জন সহকারে বিদ্যুৎ চমক দেখা দেয় । তারপর শুরু হয় একটানা বৃষ্টি। সেই অবিশ্রান্ত বর্ষণে প্রলয়ের আগুন নিভে যায়। এভাবে অবিরাম বর্ষণ যা, বারো বছর ধরে চলতে থাকে। তাতে সমুদ্র সলিল পূর্ণ হয়ে ওঠে। পাথরে যান্ত্রিক বিকার ঘটতে থাকে। পৃথিবী জলমগ্ন হয়। তারপর শুরু হয় তীব্র বাতাস। তাতে মেঘের আস্তরণ সরে যায়। তখন ব্রহ্মা সেই প্রচন্ড প্লাবনকে পান করে একার্ণবের জলে শায়ন করেন। সেই সময় দেব, অসুর, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর সকল প্রাণী বিনষ্ট হয়। শুধু আমি একমাত্র প্রাণী যে, একার্ণবের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই।”
0 Comments