উপমন্যুর গুরুভক্তির উপাখ্যান
মহাভারতে বর্ণিত 'আরুণির উপাখ্যান' গল্পটি এই গ্রন্থেই আলোচিত হয়েছে। ঐ গল্পে গুরু মাহাত্ম্য এবং গুরুকৃপা লাভ সমৃদ্ধ এমন উজ্জ্বল আলোচনা আমাদের সকলকে বিস্মিত করে। আরুণি ছাড়া ঋষি আয়ুদধৌম্যের আরও দুজন যশস্বী শিষ্য ছিলেন- ‘উপমন্যু' এবং 'বেদ'। আরুণির মতো তাঁদেরও গুরুভক্তি ছিল প্রবল। গুরুর আদেশকে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ঈশ্বরাদেশ জ্ঞানে। তাই এই দুজনের ব্রহ্মচর্য জীবনও আরুণির মতোই ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং মনোগ্রাহী। মহাভারতের আদি পর্বে (তৃতীয় অধ্যায়) বর্ণিত আয়ুদধৌম্য ও উপমন্যুর কাহিনীটি এবার আলোচনা করা যাক ।
আচার্য আয়ুদধৌম্য শিষ্য উপমন্যুকে একদিন আদেশ করলেন— “পুত্র! যাও, গোরুগুলি দেখাশোনা কর।”
গুরুর আদেশ পেয়ে শিষ্য উপমন্যু গোচারণ ও গো-সেবায় নিযুক্ত হলেন। কয়েকদিন পর সন্ধ্যাকালে গুরু-শিষ্যের সাক্ষাৎ হলো। উপমন্যু গুরুকে প্রণাম করলেন।
আচার্য শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন- “বৎস! তোমাকে তো বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছে। তুমি এখন কী খাওয়া দাওয়া করছো ?”
শিষ্য করজোড়ে বললেন— “গুরুদেব আমি ভিক্ষান্ন দ্বারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করছি।” আচার্য তা শুনে বললেন- “ওহে। এটি ঠিক হচ্ছে না। আমাকে নিবেদন না করে তোমার এভাবে অন্ন গ্রহণ করা সমীচিন নয়।”
গুরুভক্তিতে অটল উপমন্যু গুরুর এই নির্দেশ অম্লান বদনে মেনে নিলেন। এবং সেইদিন থেকে সংগৃহীত ভিক্ষান্ন গুরুর চরণে অর্পণ করতে লাগলেন। গুরু আবার সেই ভিক্ষান্ন পুরোটাই নিজের কাছে রেখে দিতে লাগলেন। শিষ্যকে কিছুই দিলেন না।
এভাবে কিছুদিন চলার পর পুনরায় একদিন গুরু-শিষ্যের দেখা হলো। গুরু কুশল বিনিময়ের পরে জানতে চাইলেন— “পুত্র! আমি তোমার সমস্ত ভিক্ষান্ন রেখে দিচ্ছি। তুমি এখন কী খাওয়া-দাওয়া করছো ?”
গুরুকে প্রণাম করে শিষ্য উপমন্যু বললেন— “ভগবান! আমি প্রথমে ভিক্ষা করে যা পাই তা আপনাকে নিবেদন করি। পরে আবার ভিক্ষা করে যা পাই, তা নিজে ভোজন করি।”
আচার্য তা শুনে বললেন— “না, না, তোমার এ কাজটিও ঠিক হচ্ছে না। গুরুগৃহে থাকা ব্রহ্মচারীর এভাবে অন্যের জীবিকাতে ভাগ বসানো মোটেই সমর্থনযোগ্য নয় । তাছাড়া এর দ্বারা তোমার লোভও প্রকাশিত হচ্ছে। তুমি এ কাজ আর কোরো না । ”
উপমন্যু গুরুর ইচ্ছা বুঝতে পারলেন এবং তাঁর দেওয়া বিধান সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিলেন। আগের মতো গো-সেবায় মনোনিবেশ করলেন। কিছুদিন পর পুনরায় এক গোধূলি বেলায় গুরু-শিষ্য উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। উপমন্যু ভক্তিভরে গুরুকে প্রণাম নিবেদন করলেন ।
আচার্য প্রশ্ন করলেন— “তুমি আগের মতো দ্বিতীয়বার আর ভিক্ষা করছো না । কিন্তু তোমার শরীর ও স্বাস্থ্য অটুট দেখছি। তুমি এখন কী খেয়ে দিনাতিপাত করছো ?' শিষ্য হাতজোড় করে বললেন— “গুরুদেব! আমি এখন গোদুগ্ধ পান করে শরীর ধর্ম পালন করছি।”
আচার্য বললেন- “না, না! আমার অনুমতি না নিয়ে তোমার গোদুগ্ধ পান করা যথার্থ কাজ হয়নি।”
উপমন্যু গুরুর ইচ্ছা বুঝতে পারলেন এবং তখন থেকে গোদুগ্ধ পান করাও বন্ধ করে দিলেন।
আবার কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় উপমন্যু গুরুর সমীপে এলেন। আচার্য জিজ্ঞাসা করলেন— “আমার নির্দেশ অনুসারে তুমি ভিক্ষান্ন নিচ্ছো না। গোদুগ্ধ পান বন্ধ করে দিয়েছো। তাহলে কী খাচ্ছ এখন ?”
উপমন্যু গুরুকে প্রণাম করে বললেন- “প্রভু, গো-বৎসেরা গোদুগ্ধ পান করার পর তাদের মুখে যে ফেনা লেগে থাকে, আমি তা পান করে ক্ষুধা নিবারণ করছি।”
আচার্য তা শুনে বললেন— “আহা! ছোট ছোট বাছুরগুলি তোমার কথা ভেবে বেশি করে ফেনা নিঃসরণ করছে। তোমার জন্য তাদের পেট ভরে দুগ্ধ পান হচ্ছে না। এভাবে তাদের খাদ্য পানীয় খেয়ে তোমার উদরপূর্তি করা, ঠিক কাজ হচ্ছে না।'
গুরুর প্রতি স্থির-বিশ্বাসী শিষ্য উপমন্যু গুরুর এই আদেশটিও বিনা বাক্য-ব্যয়ে মেনে নিলেন। বাস্তবে তার কাছে খাদ্য সংগ্রহের সকল পথ তখন থেকে বন্ধ হয়ে গেলো। ক্ষুধায় ব্যাকুল উপমন্যু এরপর কিছু না পেয়ে আখের পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে লাগলেন। এভাবে কয়েকদিন চলার পর আখের ধারালো পাতায় তার জিভ কেটে গেল এবং ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল । একদিন তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হলো।
এরপর একদিন হঠাৎ পথভ্রষ্ট হয়ে উপমন্যু একটি কুয়োয় পড়ে গেলেন। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে । অন্যান্য শিষ্যরা নিজ নিজ কাজ সেরে গুরুগৃহে ফিরে এসেছে। কিন্তু উপমন্যুর দেখা নেই। সে গেল কোথায় ? আচার্য তখন সকল শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন— “উপমন্যু কোথায় গেল ? সে ফিরে আসছে না কেন ? কেউ কি তাকে দেখেছো ?”
শিষ্যেরা একটি কথাই বললো— “উপমন্যু গোচারণে গিয়েছে। তারপর তাকে আর কেউ দেখতে পায় নি।”
আচার্য বললেন— “আমি ওর খাওয়া দাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। তাই হয়তো ও রাগ করেছে। চলো দেখি, আমরা তার সন্ধান করি।”
এরপর শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে আচার্য বনাভিমুখে গেলেন এবং ‘উপমন্যু তুমি কোথায় ?’–বলে তারস্বরে ডাকতে লাগলেন। সামান্য পরে গুরুর ডাক শুনতে পেয়ে উপমন্যু সাড়া দিয়ে বললেন— “গুরুদেব আমি এখানে, একটা কুয়োতে পড়ে গেছি।” আচার্য পুনরায় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলেন— “তুমি কুয়োতে পড়লে কীভাবে ?” শিষ্য উত্তরে বললো— “গুরুদেব! আমি ইদানিং আখের পাতা খেয়ে শরীর ধারণ করছি এবং তার ফলে অন্ধ হয়ে গেছি। তাই পথ চলতে গিয়ে ভুল করে কুয়োয় পড়ে গেছি।”
আচার্য বললেন— “ভয় পেয়ো না, বৎস। তুমি অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ধ্যান করো। তাঁরা তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবেন।”
গুরুর নির্দেশ পেয়ে উপমন্যু তখনই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বেদোক্ত মন্ত্র আবৃত্তি করলেন। উপমন্যুর স্তুতিতে অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রসন্ন হলেন এবং সেখানে উপস্থিত হলেন। উপমন্যুকে তাঁরা বললেন— “এই পরমান্ন তুমি গ্রহণ করো। তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে।”
উপমন্যু বললেন— “হে দেবগণ! আপনাদের দর্শন পেয়ে আমার জীবন ধন্য হলো। কিন্তু ঐ পরমান্ন আমার গুরুদেবকে নিবেদন না করে আমি তা গ্রহণ করতে পারি না।”
অশ্বিনীকুমারদ্বয় বললেন— “তোমার গুরুদেবও একসময় তোমার মতো আমাদের বন্দনা করেছিলেন। এবং আমরাও তাঁকে এইভাবে পরমান্ন দিয়েছিলাম। সেই সময় তিনি তাঁর গুরুদেবকে নিবেদন না করেই পরমান্ন গ্রহণ করেছিলেন। তাই তুমি নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় এই পরমান্ন গ্রহণ করতে পার।”
উপমন্যু পুনরায় করজোড়ে বললেন— “হে দেববর, অপরাধ নেবেন না। গুরুর উপস্থিতিতে তাঁকে নিবেদন না করে আমি এই পরমান্ন কিছুতেই মুখে তুলতে পারবো না।”
উপমন্যুর এই গুরুভক্তি অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে মুগ্ধ করলো। তাঁরা উপমন্যুকে আশীর্বাদ করে বললেন— “আমরা তোমার গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। তোমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছি। তুমি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। তোমার সোনার দাঁত হবে। তুমি ঈশ্বরের অশেষ করুণা লাভ করবে।” –এই বলে তাঁরা অন্তর্হিত হলেন।
উপমন্যু এরপর কুয়া থেকে উঠে গুরুর সামনে এলেন। গুরুকে প্রণাম করে সমস্ত ঘটনার বর্ণনা পেশ করলেন। আচার্য আয়ুদধৌম্য অত্যন্ত খুশি। তিনি বিস্মিত হলেন শিষ্যের গুরুভক্তি, আত্মসম্মান জ্ঞান ও বিচারবোধ দেখে। তিনি তখন উপমন্যুকে আশীর্বাদ করে বললেন- “অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের আশীর্বাদ তোমার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হবে। তুমি ঈশ্বরের কৃপার এক দিব্য জীবন লাভ করবে। বেদ সহ সমস্ত ধর্মশাস্ত্রগুলি তোমার স্মৃতিতে চিরকাল সজীব থাকবে।”
0 Comments