ধুন্ধুমার অসুরের উপাখ্যান




ধুন্ধুমার অসুরের উপাখ্যান 

আমাদের চারপশে বড় কিছু গোলমাল, ভয়ঙ্কর লণ্ডভন্ড বা ঐ ধরনের এলোমেলো কিছু ঘটতে দেখলে আমরা বলি 'ধুন্ধুমার কাণ্ড'। এই শব্দটির ব্যবহার আমরা মহাভারতে পাই। 'বনপর্বের ১৯১-২০২ তম অধ্যারে ধুন্ধুমার উপাখ্যান ও যুদ্ধ বধের বিবরণ আছে। সেই বিবরণটি ‘ধুন্ধুমার কাণ্ডের' সঙ্গে বেশ মেলানো যায়। আলোচ্য গল্পটি এই উদ্দেশ্যে সংকলিত হলো।

যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয় মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে ধর্মর। আপনি দেব, দানব, রাক্ষস, গন্ধর্ব, মানুষ, যক্ষ, কিন্নর, বিভিন্ন রাজা, ঝবি এমন কি, অপরাদের বহু কাহিনী সম্পর্কেও অবগত আছেন। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা কুবলাহ" এক সময় 'যুদ্ধমার' নামটি লাভ করেছিলেন। সে বিষয়ে আপনি দয়া করে আমাকে বলুন। আমি তা শুনতে বিশেষ আগ্রহী।”

মার্কণ্ডেয় বললেন- “ধর্মরাজ! প্রাচীনকালে উত্তর নামে একজন বশী কৰি ছিলেন। এক মনোরম পরিবেশে মরুধন্ব প্রদেশে ছিল তাঁর আশ্রম। ভগবান বিষ্ণুর কৃপালাভের আশায় তিনি বহু বছর ধরে কৃচ্ছসাধন সহ তপস্যা করেছিলেন। সেই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু একদিন তাঁর মানসচক্ষে আবির্ভূত হলেন। উতঙ্ক মুনি তাঁকে দেখা মাত্র তাঁর স্তব-গান পরিবেশন করলেন। হৃষিকেশ মহাত্মা উত্তস্কের স্তবে সম্ভষ্ট হয়ে বললেন- “আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। তুমি মনোমত বর প্রার্থনা করো।”

উতঙ্ক বললেন- “হে দেব! আপনি জগতের স্রষ্টা, সনাতন পুরুষ। আপনার দর্শন পেয়েছি। তাতেই আমি ধন্য। আমার আপনার কাছে বিশেষ কোনো বরের প্রত্যাশা নেই।”

ভগবান বিষ্ণু বললেন- “আমি তোমার ধৈর্য ও ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তোমাকে তাই বর চাইতেই হবে।”

উতঙ্ক তখন হাত জোড় করে বললেন- “হে রাজীবলোচন! যদি সত্যিই আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তাহলে এই বর দিন যে, আমার বুদ্ধি যেন সব সময় সত্য, ধর্ম

ও ইন্দ্রিয় নিগ্রহে নিযুক্ত থাকে এবং ভক্তির প্রাবল্যে আমি যেন আজীবন আপনার সান্নিধ্য লাভ করতে পারি।”

বিষ্ণু বললেন— “বিপ্রবর! আমার প্রসাদে তোমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। তোমার যোগ সাধনা এতটাই ফলপ্রসূ ও উজ্জল হবে যে, তুমি তার সাহায্যে ত্রিলোক এবং দেবতাদের অসামান্য উপকার করতে পারবে। হে দ্বিজ! ‘ধুন্ধু’ নামে এক অসুর ত্রিলোকে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ঘোর তপস্যা করবে। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা বৃহদন্দ্বের পুত্র কুবলাই একজন কীর্তিমান শ্রদ্ধাশীল রাজা যে, আমার দেওয়া যোগবলের সাহায্যে তোমার নির্দেশে তাকে বিনাশ করবে। তারপর সে ধুন্ধুমার নামে প্রসিদ্ধ হবে।”

এই বলে ভগবান বিষ্ণু সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলেন।

মার্কণ্ডেয় ঋষি পুনরায় বললেন— “যুধিষ্ঠির! মহারাজ ইক্ষ্বাকু লোকন্তরিত হলে তাঁর পুত্র শশাদ রাজা হলেন। এরপর অযোধ্যার সিংহাসনে আসীন হলেন শশাদপুত্র কুকুৎস্থ, তারপর কুকুৎস্থের পুত্র অনো, এরপর বংশ পরম্পরা অনুসারে অযোধ্যার রাজা হয়েছিলেন যথাক্রমে পৃথু, বিশ্বগশ্ব, আদ্রি, যুবনাশ্ব, শ্রাব ও শ্রাবস্তক— যিনি শ্রাবন্তী নগরী নির্মাণ করেছিলেন। তারপর মহাবল বৃহদশ্ব এবং বৃহদশ্ব পুত্র কুবলাশ্ব । কুবলাশ্বের মোট একুশ হাজার সন্তান ছিল। যাঁরা সকলেই বিদ্বান, বলবান ও তেজস্বী ছিলেন।

কুবলাশ্বের খ্যাতি ও গরিমা তাঁর পিতার গৌরবকেও অতিক্রম করেছিল। পিতা বৃহদহ যখন দেখলেন যে, পুত্র কুবলাই রাজ্যভার নিতে সক্ষম, তখন রাজ্যপাট পুত্রের হাতে তুলে দিয়ে তিনি বাণপ্রস্থে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বৃহদহ বনবাসে যাচ্ছেন এই খবর শুনে মহর্ষি উতঙ্ক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বললেন— 'মহারাজ! রাজার কাজ প্রজাপালন করা। আমরা আপনার সুশাসনে বেশ নির্বিঘ্নে দিন কাটাচ্ছি। এখন আপনি এভাবে হঠাৎ বনে যাওয়ার সংকল্প নিলে প্রজাদের দুর্দশার শেষ থাকবে না। তাই আমার অনুরোধ আপনি বাণপ্রস্থে যাওয়ার বাসনা প্রত্যাহার করুন। নাহলে আমরা নিশ্চিন্ত মনে আমাদের জপ-তপ-সাধনা করতে পারব না।

হে রাজা! মরুদন্ন প্রদেশে আমার আশ্রমের সামান্য দূরে বহু যোজন বিস্তীর্ণ বালুকারাশিতে পরিপূর্ণ একটি সমুদ্র আছে। অসুর মধুকৈটবের পুত্র মহাসুর ধুন্ধু ঐ

স্থানে বালির নীচে বাস করে। সেই অসুর ব্রহ্মার বরে দেব, দানব, নাগ, যক্ষ, রাক্ষস ও গন্ধর্বদের অবধ্য হয়ে উঠেছে। তাকে নিহত না করে আপনার বনচারী হওয়া ঠিক

নয়।

সে সারা বছর বালির তলায় ঘুমিয়ে থাকে। বছরে একবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তার নিঃশ্বাসের গতি এত প্রবল যে, তার ফলে পর্বত ও বনজঙ্গল সমগ্র পৃথিবী দুলতে থাকে। নিঃশ্বাসের বেগে এমন ঝড় তৈরি হয় যে, তাতে একটানা সাতদিন সূর্য, ধোঁয়া বালিও আগুনের শিখায় ঢাকা পড়ে যায়। তাই রাজন! আমার অনুরোধ মানুষের কল্যাণের জন্য আপনি ঐ দৈত্যকে বধ করুন। তার আগে বাণপ্রস্থে যাওয়ার উদ্যোগ নেবেন না।”

রাজা বৃহদশ্ব করজোড়ে বললেন- “হে মুনিবর! আপনি যে কারণে এখানে এসেছেন, তা বৃথা যাবে না। ধুন্ধু বিনাশ হবেই। আমি ইতিমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করেছি। তাই আমি নয়, আমার পুত্র কুবলাশ্ব এই অভিযান সম্পন্ন করবে। সে শুধু একাই বীর যোদ্ধা বা কুশলী সেনানায়ক নয়, তার একুশ হাজার সুযোগ্য পুত্র রয়েছে। যাদের মিলিত প্রয়াসে এই অসুর অচিরেই বিনষ্ট হবে।”

উতঙ্ক বললেন- “তাই হোক মহারাজ।”

এরপর রাজা বৃহদশ্ব মুনির অনুমোদন পেয়ে পুত্র কুবলাশ্বকে রাজভার এবং ধুন্ধুবরের গুরু দায়িত্ব দিয়ে বনে চলে গেলেন।

রাজা যুধিষ্ঠির পুনরায় মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করলেন— “ভগবন! এই শক্তিশালী দৈত্য কে ? কি তার পরিচয় ? এমন শক্তিশালী দৈত্যের কথা আমি আগে কখনো শুনিনি । দয়া করে তার বিষয়ে সবিস্তারে বলুন।”

মার্কণ্ডেয় বললেন- “পাণ্ডু নন্দন! পরাক্রান্ত ধুন্ধু আসলে দৈত্য মধুকৈটভের পুত্র! সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে ব্রহ্মার বরলাভের আশায় কঠোর তপস্যা করেছিল। একসময় ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বরদানে ইচ্ছা প্রকাশ করলে সে বলল-

'ভগবান! দেব, দানব, যক্ষ, সর্প, গন্ধর্ব, ও রাক্ষসগণ যেন আমাকে হত্যা করতে না

পারে। এমন বর আমাকে দিন'।”

পিতামহ ব্রহ্মা বললেন- “তাই হবে।”

এরপর ধুন্ধু পিতামহের পদধূলি নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। ধুন্ধু এভাবে দৈববলে বলীয়ান হয়ে ক্ষমতার আস্ফালন দেখানোর জন্য নির্বিচারে সবার ওপর অত্যাচার, উৎপীড়ন শুরু করলো। তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিষ্ণু ও অন্যান্য দেবতা সহ গন্ধর্বদের পরাজিত করলো। তারপর বালুকাপূর্ণ উজ্জালক সমুদ্রে এসে বালুকার গভীরে প্রবেশ করে বসবাস করতে লাগল। সামান্য দূরেই উতঙ্ক মুনির আশ্রম। এর ফলে তপোধন ও তার আশ্রমে তখন ভীতির পরিবেশ তৈরি হলো। সব সময় একটাই আশঙ্কা, এই বুঝি ধুন্ধু এসে সব কিছু শেষ করে দেবে ? এমন সময় মহারাজ কুবলাশ্ব এলেন সেই উজ্জালক সমুদ্রের নিকটে। সঙ্গে এলেন মহাতপা উতঙ্ক সহ কুবলাশ্বের একুশ হাজার পুত্র। তাদের বাহন ও অন্যান্য লোক- লস্কর সমূহ। ভগবান বিষ্ণু জগতের কল্যাণ কামনায় কুবলাশ্বের শরীরে তাঁর তেজঃপ্রভা দিয়ে দিলেন। আকাশে ঘোষিত হলো— “শ্রীমান অবধ্য কুবলাশ্ব ধুন্ধুমার নামে বিখ্যাত হবেন।” দেবগণ চারদিক থেকে পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগলেন। বেজে উঠলো রণদুন্দুভি ও বিজয় ডঙ্কা। দেবরাজ ইন্দ্র পৃথিবীকে ধূলি-শূন্য করার জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। দেবতা, গন্ধর্ব, মুনি-ঋষিগণ এই ভয়ংকর যুদ্ধ দেখার জন্য সমবেত হলেন। অন্তরীক্ষে তাঁদের বিমানগুলির আনাগোনা সকলের চোখে পড়লো।

কুবলাই বিষ্ণুতেজে বলীয়ান হয়ে পুত্রদের নির্দেশ করলেন— “যাও, উজ্জালক সাগর চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে তা খনন করা শুরু করো।” এরপর এক সপ্তাহ খনন করার পর বালুকার অভ্যন্তরে মহাবলী ধুন্ধুকে দেখতে পাওয়া গেল। বালির ভিতর তার ভয়ানক শরীর সূর্যের মতো দীপ্যমান হয়ে উঠলো। কুবলাশ্বের পুত্রগণ তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে তীক্ষ্ণ, মুষল, পারশ, পাশ ও খড়্গা ইত্যাদি দিয়ে তীব্র আক্রমণ করলো।

মহাবলী ধুন্ধু এই সব অম্লগুলি এক নিমেষে খেয়ে ফেলল। তার মুখ থেকে তখন ভয়ংকর সংবর্তক অগ্নির মতো লেলিহান আগুনের শিখা নির্গত হলো। সেই আগুনে কুবলাশ্বের সকল পুত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেল। যেভাবে বহুকাল আগে মহাত্মা কপিল সগর পুত্রদের দগ্ধ করেছিলেন সকল রাজকুমার ধুন্ধুর ক্রোধানলে পুড়ে মারা গেল। সেই অতিকায় দৈত্য দ্বিতীয় কুম্ভকর্ণের মতো সন্তর্পণে জেগে রইলো । মহাতেজা কুবলায় তখন তার দিকে এগিয়ে এলেন। তাঁর শরীর থেকে রাশি রাশি জল নির্গত হতে লাগলো। রাজা কুবলায় সেই জল দিয়ে ধুন্ধুর মুখ থেকে নির্গত হওয়া আগুন নিভিয়ে দিলেন। তারপর ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে সেই ভয়ংকর দৈত্যকে ভস্মীভূত করলেন।

এই দৃশ্য দেখে দেবতা ও ঋষিগণ অত্যন্ত খুশী হলেন। তাঁরা বললেন- “কুবলায়!

তুমি বর গ্রহণ করো।”

কুবলাশ্ব তখন আনন্দিত মনে বললেন- “হে দেবগণ। আমি যেন ব্রাহ্মণদের দান করতে পারি। শত্রুদের দমন করতে পারি। ভগবান নারায়ণের সঙ্গে যেন আমার সখ্য হয়। আমি যেন ধর্মানুরাগী হই। অন্তঃকরণ যেন আমার নির্মল হয়। আমি যেন স্বর্গলোকে স্থান পাই।”

মার্কণ্ডেয় সব শেষে বললেন- “যুধিষ্ঠির। রাজা কুবলাশ্ব এভাবে ধুন্ধুমার' নামে জগৎ বিখ্যাত হয়েছিলেন।”

এই যুদ্ধে কুবলাশ্বের মাত্র তিন জন পুত্র বেঁচে ছিলেন। তাঁরা হলেন দৃঢ়াশ্ব, কপিলাহ ও চন্দ্রাশ্ব। এঁদের সাহায্যে ইক্ষাকু বংশের পরম্পরা এগিয়ে চলেছিল।


Post a Comment

0 Comments