বিঞ্জানী মাদাম কুরীর শৈশব

বিঞ্জানী মাদাম কুরীর শৈশব 



বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মহিলা বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুবই অল্প। যে কয়েকজন মহিলাবিজ্ঞানী বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য অমর হয়ে আছেন তাদের অন্যতম হলেন মাদাম কুরী। মাদাম কুরী দুবার নোবেল পুরস্কার লাভ করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি একবার পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান এবং আর একবার রসায়ন বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিজ্ঞানী মাদাম কুরীর আসল নাম –মেরী সক্লোদভস্কা কুরী। তিনি ইউরোপের পোলান্ড দেশে ১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দের ৭ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ যেমন একসময় ইংরেজদের পরাধীন ছিল ঠিক তেমনি পোলান্ড দেশটিও সেই সময় রাশিয়ার পরাধীন ছিল। তখন রাশিয়ার শাসক অত্যাচারী জারের অত্যাচারে পোলান্ড দেশের সাধারণ লোকেদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মাদাম কুরী যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সেই পরিবার শিক্ষায় দীক্ষায় খুবই উন্নত ছিল। শুধু তাই নয় তাদের পরিবার ছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। মাদাম কুরীর বাবা ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং তাঁর মা ছিলেন এক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মাদাম কুরীর বাবা খুবই স্বাধীনচেতা পুরুষ ছিলেন। মাদাম কুরীর বাবা শিক্ষক ও মা শিক্ষিকা হলেও তাদের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। কারণ পরাধীন পোলান্ডবাসীদের বেতন খুব একটা বেশী ছিল না। তার উপর তখনকার পোলান্ডে রাশিয়ার জারের অনুমোদিত শিক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল সেজন্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের জীবনে প্রতি পদে পদে বিপদের ঝুঁকি থাকত। জারের আনুগত্য মেনে না নেওয়ায় মাদাম কুরীর বাবাকেও খুব হেনস্তা করা হয়েছিল সেজন্য কুরী পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে মাদাম কুরী ছিলেন সবার ছোটো। ছেলেবেলায় তার ডাক নাম ছিল মানিয়া - আবার অনেকে তাকে মার্জা বলেও ডাকত। মানিয়ার শৈশবকাল মোটেই সুখের ছিল না। মানিয়ার মা প্রায় সবসময়ই অসুস্থ থাকতেন। তার উপর মানিয়ার জন্মের কিছুদিন পরই যক্ষারোগে আক্রান্ত হন তিনি। সেই সময় যক্ষা রোগ প্রতিকারের জন্য কোনও ভাল ওষুধপত্র ও ছিল না। সেজন্য এই যক্ষারোগেই মানিয়ার মা মারা যান। অতি অল্প বয়সে চোখের সামনে মাকে ক্ষয়রোগে মৃত্যুবরণ করতে দেখেও মানসিকভাবে কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে এই মৃত্যুই তাঁকে মানসিকভাবে আরও কঠোর ও দৃঢ় করে তুলেছিল। মায়ের মৃত্যুর পর মানিয়ার অভিভাবক ও বন্ধুর ভূমিকা পালন করতে লাগল তার দিদি ব্রনিয়া। আর্থিক দিক দিয়ে চরম দুর্দশার সম্মুখীন হওয়ার ফলে কুরী পরিবারে শুরু হল কঠোর জীবন সংগ্রাম। এই দুর্দশার দিনে স্বদেশভূমি পোলান্ডের প্রতি দেশপ্রেম তাদের জীবনে আলোর পথ দেখাত। অভাব অনটন সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এই শিক্ষক পরিবার তাঁদের আদর্শকে নষ্ট হতে দেননি। মানিয়া বা মাদাম কুরীর জীবনেও ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছিল এই দেশপ্রেমের আদর্শ। মানিয়া তখন ওয়ারশ শহরের এক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। সেই সময় পোলান্ড দেশটি ছিল রাশিয়ার অধীন। সেজন্য পোলান্ডের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় রুশ ভাষা শেখা ছিল বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, পোলান্ডের সব ছাত্রছাত্রীদেরকে রাশিয়ার শাসক জারের গুনগান গাইতে বাধ্য করা হত। এই সময় মানিয়াদের স্কুলে এক স্কুল ইনস্পেকটর এসেছেন স্কুল পরিদর্শন করতে—পোলান্ডের সব শিশুর মনে রাশিয়ার জারের প্রতি গুনগান করতে শেখানো হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেই এসেছেন এই স্কুল ইনসপেকটর। আবার পোলান্ডের এই সব ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের মনে স্বাধীন হবার ইচ্ছাটাও যাতে না জন্মায় সে ব্যাপারেও দেখতে এসেছেন রাশিয়ার সম্রাট জারের প্রতিনিধি এই স্কুল ইনসপেকটর। মানিয়াদের ক্লাসেও এলেন ওই ইনস্পেকটর সাহেব। শিক্ষিকা এবং সব ছাত্রছাত্রীই চুপচাপ এবং সকলের মনেই কমবেশী উত্তেজনা। শিক্ষিকার মনে চিন্তাটা বেশী। কারণ ইনসপেকটর সাহেব কোন ছাত্রছাত্রীকে কি প্রশ্ন করবেন—তারা কেমন উত্তর দিতে পারবে—সেই সব নিয়েই তিনি ভাবছেন। ছাত্রছাত্রীরা সব ভয়ে ভয়ে আছে—মানিয়াও ভয়ে ভয়ে আছে আর ভাবছে ইনসপেকটর মশাই তাকে যেন কোনও কিছু জিজ্ঞাসা না করেন। কিন্তু তা হল না। ইনসপেকটর সাহেব প্রথমেই মানিয়াকে প্রশ্ন করল—“আচ্ছা তুমি বল তো বর্তমানে যে মহান সম্রাট রাশিয়া শাসন করছেন তার নাম কি?”

প্রশ্ন শুনে দিদিমণির চিন্তা একটু বেড়ে গেল। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর সব ছাত্রছাত্রীরই জানা। কিন্তু কেউ বলতে না পারলে দিদিমণির চাকরিও চলে যেতে পারে।

ইনসপেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মানিয়া উত্তর দিল—“আমাদের মহান সম্রাট জার।” জার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মোটেই মহান সম্রাট ছিলেন না—তিনি ছিলেন অত্যাচারী।

তারপর সেই ইনসপেক্টর মশায় মানিয়াকে জারের প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। মানিয়াও সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল। সঠিক উত্তর সে তো দেবেই—কারণ দিদিমণিও তো নিজের মানমর্যাদা ও প্রাণের ভয়ে সমস্ত কিছু পাখীদের বুলির মতো সবাইকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। দিদিমণি এবং ইনসপেক্টর ছোট্ট মানিয়ার কাছ থেকে সমস্ত সঠিক উত্তর পেয়ে খুশী হলেও মানিয়া কিন্তু খুশী হতে পারেনি। স্কুল থেকে ফিরে গিয়ে মা বাবার সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল ছোট মানিয়া। মা বাবা মানিয়ার কাছে কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে স্কুলে ইনসপেক্টরের প্রশ্ন ও তাঁর উত্তরের কথা বলল। অতি অল্প বয়স থেকেই ছোট্ট মানিয়া মা বাবার কাছ থেকে পোলান্ডবাসীর ওপর রাশিয়ার অত্যাচারী সম্রাট জারের অত্যাচারের কথা শুনেছে। জারের জন্যই যে পোলান্ডবাসীর এত দুঃখকষ্ট সে কথাও ছোট হলেও সে জানে। কিন্তু দিদিমণির ভয়ে মন না চাইলেও সে আজ ইনসপেক্টরের সামনে অত্যাচারীর জারকে নিজেদের সম্রাট বলে মেনে নিয়েছে, জারের গুণগান করেছে-অত্যাচারী _জারকে পোলান্ডের শত্রু বলে বলতে পারেনি—এই আত্মগ্লানিতেই মানিয়া আজ ঘরে ফিরে এসে কাঁদছে। মানিয়ার বাবা ও মা ছোট মানিয়ার মনের ব্যথা বুঝতে পারলেন—তারা বুঝতে পারলেন যে ছোট মানিয়ার মনে এখন থেকে দেশপ্রেমের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে তা ভবিষ্যতে মহীরুহে পরিণত হবে। তারা এটাও বুঝতে পারলেন যে—তাদের শিশুকন্যার অন্তরের দেশপ্রেমই তাকে বড় হবার রাস্তা দেখাবে এবং ভবিষ্যতে সে সারা পোলান্ডের মুখ উজ্জ্বল করবে। বাবা মায়ের এই ইচ্ছা সত্যিই বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। ছোটবেলার সেই মানিয়া ভবিষ্যতে যিনি সারা বিশ্বে মাদাম কুরী নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। মাদাম কুরী 1898 খ্রীস্টাব্দে এক নতুন মৌল আবিষ্কার করেন এবং তার প্রিয় স্বদেশভূমি পোলান্ডের নাম অনুসারে সেই মৌলের নাম দিয়েছিলেন পোলোনিয়াম ।

বাল্যকালে স্কুলে পড়াশোনা করার সময়ও মাদাম কুরীকে ঝড়ঝাপটা কম সহ্য করতে হয়নি। একে তো মানিয়ার বয়স যখন মাত্র এগার বছর তখন তার মা যক্ষারোগে মারা যান, তার উপর রাশিয়ার সম্রাট জারের বিরাগভাজন হওয়ায় কুরী পরিবার পোলান্ড ছাড়তে বাধ্য হন। এত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও মানিয়া যখন হাইস্কুল থেকে পাশ করেন তখন তিনি তার দিদি ব্রনিয়া এবং দাদা থোজিও-র মত গোল্ড মেডেল পুরস্কার পান। কুরী পরিবার পোলান্ড দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় মানিয়া এবং তার দিদি ব্রনিয়া উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে যেতে মনস্থ করেন। কিন্তু দুই মেয়ের পড়াশোনা চালানোর খরচ যোগানোর অবস্থা তার বাবার ছিল না। সেজন্য ব্রনিয়া ও মানিয়া ঠিক করেন যে ফ্রান্সে ব্রনিয়া যখন ডাক্তারী পড়বে তখন মানিয়া ছোটখাটো কাজ করে তার খরচ চালাবেন এবং পরে দিদি ব্রনিয়া ডাক্তারী পাশ করার পর তার পড়াশোনার খরচ চালাবেন। মানিয়া অর্থাৎ মাদাম কুরী 1891 খ্রীস্টাব্দে প্যারিস যান এবং সেখানকার সরবোন কলেজে থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক হন। পরবর্তীকালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর তিনি “তেজস্ক্রিয়তা” বিষয়ে গবেষণা করেন। 1903 খ্রীস্টাব্দে তিনি গবেষণার জন্য ফ্রান্সের প্রথম মহিলা হিসেবে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি দুবার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি 1903 খ্রীস্টাব্দে পদার্থ বিজ্ঞানে এবং 1911 খ্রীস্টাব্দে রসায়নে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।


Post a Comment

0 Comments