বিঞ্জানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের শৈশব
পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টির বিষয়ে কোনও কিছু বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম মনে চলে আসে তিনি হলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি গতিবিষয়ক তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন—এই সূত্র তিনটি নিউটনের গতিসূত্র নামে পরিচিত এবং এই সূত্রগুলি পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ।
“প্রিন্সিপিয়া” গ্রন্থে এই সূত্রগুলি বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে।
ইংল্যান্ডের উলসথর্প গ্রামে সামান্য কৃষক পরিবারে ১৬৪২ খ্রীস্টাব্দে আইজ্যাক নিউটন জন্মগ্রহণ করছেন। কিন্তু আইজ্যাকের এমনই দুর্ভাগ্য যে তার জন্মের কয়েক মাস আগেই তার বাবা মারা যান। আবার এই ঘটনার দু বছর পরেই আইজ্যাকের মা মিস্টার স্মিথকে বিয়ে করে উলসথর্প গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যান। সেজন্য শৈশবে আইজ্যাক বাবা ও মায়ের স্নেহ ভালবাসা পাননি। ঠাকুমার কাছেই তার শৈশবকাল কেটেছে। মা, বাবা, ভাই, বোন না থাকায় আইজ্যাক শৈশবকাল থেকেই প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। ঠাকুমাই ছিল তার একমাত্র বন্ধু। সেজন্য ঠাকুমার কাছ থেকে তিনি যে কেবল স্নেহ ভালবাসা বা আদর পেয়েছিলেন তাই নয়, প্রশ্রয়ও পেয়েছিলেন। তবে শিশু আইজ্যাক নিউটন উলসথর্প গ্রামের চারপাশের সবুজ পরিবেশেও একা একা ঘুরে বেরিয়েও শৈশবের অনেক সময় অতিবাহিত করতেন।
চার বছর বয়সেই আইজ্যাককে গাঁয়েরই এক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এই বয়সে পড়াশোনায় তাঁর খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও ছোটোখাটো যন্ত্রপাতি, মডেল, খেলনাতে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ঠাকুমার কাছে নানান রূপকথা ও দৈত্যদানবের গল্প শোনার ব্যাপারেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল।
বারো বছর বয়সে গাঁয়ের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে আইজ্যাক ভর্তি হলেন গ্রান্টহামের কিংস স্কুলে। উলসথর্প থেকে গ্রান্টহ্যামের দূরত্ব ছিল প্রায় দশ কিলোমিটার। বারো বছরের বালক আইজ্যাকের পক্ষে প্রতিদিন এই দূরত্ব আসা যাওয়া করে স্কুল করা সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব একটা উন্নত ছিল না। কাজেই বাধ্য হয়ে বালক আইজ্যাকে গ্র্যান্টহামে থাকতে হল। আইজ্যাকের মায়ের এক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছিল গ্র্যান্টহামে—তাঁর স্বামীর নাম ছিল মিস্টার ক্লার্ক। মিস্টার ক্লার্ক ওষুধের ব্যবসা করতেন। এই মিস্টার ক্লার্কের বাড়িতে থেকেই বালক আইজ্যাক কিংস স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিংস স্কুলে পড়ার সময়ই আইজ্যাকের দারুণ মানসিক পরিবর্তন হয়-এই সময় থেকে বালক আইজ্যাক পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী হন। মিস্টার ক্লার্কেরও নানান ধরনের বই পড়ার অভ্যেস ছিল। তাঁর বাড়িতে বেশ কয়েকটা আলমারীতে নানান ধরণের বই ছিল। আইজ্যাক সময় পেলেই মিস্টার ক্লার্কের সেইসব বই পাঠ করে সময় কাটাতেন। এইসব বই পড়েই আইজ্যাকের নানা বিষয়ে জানবার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হল। কিংস স্কুলে পড়বার সময় আইজ্যাক বাতাস চালিত হাওয়াকল দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, গতিশীল হাওয়া বা বাতাসের সাহায্যে হাওয়াকলের বড় বড় ব্লেডগুলি ঘোরা ও তার সাহায্যে কুয়ো থেকে জল তোলার ব্যবস্থা আইজ্যাককে হতবাক করে দিত। শুধু তাই নয় হাওয়াকল দেখে বালক নিউটন এতই মুগ্ধ হয়ে গেছিল যে কয়েকদিনের মধ্যেই সে হাওয়াকলের একটা মডেলও বানিয়ে ফেলল। হাতে কলমে কোনও জিনিস তৈরী করার ক্ষমতা দেখে মিস্টার ক্লার্ক ও পাড়ার লোকজনেরাও অবাক। এই হাওয়াকলে একটা মজার ঘটনাও ঘটেছিল। বালক আইজ্যাক ওই হাওয়াকল চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিল এক নেংটি ইঁদুরকে। নেংটি ইঁদুরটিকে ওই হাওয়াকলের ভিতর বন্দী করে রেখে সেখানে কতগুলি গমের দানা দেওয়া হয়েছিল। ক্ষিধের চোটে ওই নেংটি ইঁদুর যখনই নড়াচড়া করত তখনই তার দেহের চাপে ওই হাওয়াকল ঘুরতে শুরু করত। সত্যি বলতে কি, বালক আইজ্যাকের ছেলেবেলা ছিল নি:সঙ্গতায় ভরা। এই নি:সঙ্গতা কাটানোর জন্যই বালক আইজ্যাক বিভিন্ন জিনিষপত্র ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ঠুকঠাক করে নানান জিনিষপত্র বানাতেন। আবার মিস্টার ও মিসেস ক্লার্কও আইজ্যাককে বিভিন্ন রকমের মডেল বানানোর কাজে উৎসাহও দিতেন। এই সময় আইজ্যাক একটা সূর্যঘড়িও বানিয়েছিলেন। একথা জানা যে আলো অস্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। আলোর সামনে কোনও অস্বচ্ছ বস্তু রাখলে ওই বস্তুর পিছনে একটা ছায়ার সৃষ্টি হয়। এই ছায়াসৃষ্টির ঘটনাকেই কাজে লাগিয়ে বালক আইজ্যাক একটি সূর্য ঘড়ি বানিয়ে ছিলেন। সূর্যোদয় থেকে ও সূর্যাস্ত পর্যন্ত সবসময়ই সূর্যকে আমরা একজায়গায় দেখতে পাই না। সকালে সূর্য থাকে পূর্বদিকে, বিকেলে পশ্চিমদিকে আর ঠিক দুপুর বারোটার সময় সূর্য আমাদের মাথার ওপরে থাকে। সেই কারণে কোনও স্থির উঁচু বস্তুর ছায়ার দৈর্ঘ্য সমস্ত দিনে এক হয় না-যত বেলা বাড়ে ছায়ার দৈর্ঘ্যেরও তত পরিবর্তন হয়। ছায়ার এই দৈর্ঘ্য পরিবর্তনকে লক্ষ্য করেই বালক আইজ্যাক একটি সূর্যঘড়ি বানিয়েছিলেন। আইজ্যাক একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে একটা ছোট লাঠি পুঁতে দিল। তারপর সেই লাঠিকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্ত এঁকে দিল। তারপর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতি এক ঘন্টা অন্তর অন্তর ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে সেখানে দাগ কেটে দিল ও তখনকার সময় ওই চিহ্নিত দাগের পাশে লিখে রাখল – ব্যাস হয়ে গেল সূৰ্য্যঘড়ি। আইজ্যাকের এই উদ্ভাবনী শক্তি দেখে বলা বাহুল্য সবাই তারিফ করতে লাগল।
এরপর বালক আইজ্যাক নিউটন যে মডেলটি তৈরি করে পাড়া প্রতিবেশীর সবাইকে চমকে দিয়েছিল সেটি হল ঘুড়ি। অল্প বয়সী ছেলেরা কাগজের ঘুড়ি তৈরি করে আকাশে ওড়ায়—এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আইজ্যাক করল কি–একদিন রাত্রিবেলায় ঘোর অন্ধকারে চার চারটে বড় ঘুড়িকে একসাথে বেঁধে তাতে একটা ছোট জ্বলন্ত প্রদীপকে সাবধানে রেখে দিল—তারপর প্রদীপসহ সেই ঘুড়িকে অতি সাবধানে আকাশে ওড়াতে লাগল। রাত্রিবেলায় অন্ধকারে আকাশে জলন্ত এক বস্তু দেখে পাড়া প্রতিবেশীর মনে নানান প্রশ্নও উদয় হল। সেই আলোকিত ঘুড়ি দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করল—ভূত, কেউবা বলল ধূমকেতু, আবার কেউবা ভাবল অন্যকিছু। তবে কিছুক্ষণ পর পাড়ার লোকেরা জানতে পারলো যে এটা বালক নিউটনের কাজ। এইসব ঘটনায় আইজ্যাক পাড়ার লোকেদের কাছে খুবই পরিচিত হয়ে উঠল।
স্কুলে নিউটন অন্যান্য ছেলেদের সাথে তেমন মেলামেশা করত না । সেজন্য বন্ধুমহলে নিউটন জনপ্রিয় ছিল না। তাছাড়া শারীরিকভাবেও সে ছিল। খুব দুর্বল আর আচার ব্যবহারে খুবই নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির। স্কুলের পড়াশোনাতে তার প্রতিভার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। সেজন্য তাঁর শিক্ষকরা মনে করতেন যে, নিউটন ভবিষ্যতে খুবই সাধারণ মানের ছাত্র হবেন। আর সহপাঠীরা তো তাকে একান্তই অসামাজিক ছাত্র বলে মনে করত। সেজন্য বালক নিউটনের সহপাঠী বন্ধুরা তার উপর মাঝে মাঝে খুবই উৎপাত করত—একটা ষণ্ডা মার্কা বন্ধু এই উৎপাতে নেতৃত্ব দিত—অন্যান্য বন্ধুরা এইসব উৎপাত দেখে খুবই মজা পেত এবং আনন্দ উপভোগ করত। কথায় আছে ধৈর্য্যেরও একটা সীমা আছে। একদিন বালক নিউটন রেগে গিয়ে ওই যা গোছের বন্ধুটিকে কুস্তির লড়াইয়ে হারিয়ে দিল। উপস্থিত সব বন্ধুরা এই লড়াইয়ে নিউটনের জয় দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর থেকে নিউটনের উপর তার বন্ধুদের অত্যাচার বন্ধ হয়ে গেল। এই জয়ের ঘটনা বালক নিউটনের মনে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এনে দিল।
এই ঘটনা বালক নিউটনের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এনে দিল। আইজ্যাক বুঝতে পারল যে সে চেষ্টা করলে পড়াশোনাতেও অন্যান্য সহপাঠীদের হারাতে পারবে। সত্যি সত্যিই সে অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠল ক্লাসের সেরা ছাত্র। এতকিছু সত্ত্বেও নিউটনের পড়াশোনায় আবার অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হল। আইজ্যাকের বাবার মৃত্যুর পর তার মা দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করেছিলেন তাঁর নাম ছিল মিস্টার স্মিথ। এই সময় মিস্টার স্মিথ মারা গেলে আইজ্যাকের মা, বালক আইজ্যাককে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে চাষবাস দেখাশোনার কাজে লাগানোর কথা ভাবতে লাগলেন। সেজন্য বাধ্য হয়েই আইজ্যাক একইসঙ্গে চাষবাস দেখাশোনা করা, খামারবাড়ির কাজ করা ও পড়াশোনা চালায়ে যেতে লাগলেন। এই সময় হেনরি স্টোক্স নামে আইজ্যাকের এক শিক্ষক পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আইজ্যাককে খুবই সাহায্য করেছিলেন। পড়াশোনার ব্যাপারে বেশী মনোযোগী হওয়ার জন্য স্বাভাবিক কারণেই চাষবাসের ক্ষতি হতে লাগলো। সেজন্য আইজ্যাকের মা বাধ্য হয়ে আইজ্যাককে চাষবাস বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বললেন। এইবার নিউটন তার পড়াশোনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন। আর পঠন পাঠনে ক্লাসের সবাইকে টেক্কা দিতে লাগলেন—ইংরাজী, ল্যাটিন, ইতিহাস, জ্যামিতি সব বিষয়েই ক্লাসের সেরা ছাত্র হিসেবে পরিগণিত হলেন আইজ্যাক নিউটন।
কেম্ব্রিজে আইজাক নিউটন বিখ্যাত গণিত অধ্যাপক ব্যারোর সংস্পর্শে আসেন। কথায় আছে রতনে রতন চেনে। নিউটনের গণিতশাস্ত্রে ও পদার্থ বিজ্ঞানে প্রতিভায় অধ্যাপক ব্যারো মুগ্ধ হন। অধ্যাপক ব্যারোর সংস্পর্শে এসেই গণিত ও বিজ্ঞানে নিউটনের চিন্তাধারা নতুন রূপ পায়। তারপর নিউটনের আবিষ্কারের ইতিহাস। পদার্থ বিজ্ঞানের ও গণিতের বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করে এবং নতুন নতুন সূত্র আবিষ্কার করে স্যার আইজাক নিউটন হয়ে উঠলেন পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী।
আনুষ্ঠানিক ছবিসহ তার খাতায় লিখে রাখলেন। শুধু তাই নয় মাইকেল বিজ্ঞানী ডেভির ওই বক্তৃতার সারাংশগুলি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেন সেই সময়কার রয়েল সোসাইটির সভাপতি স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কয়ের কাছে। সেইসঙ্গে মাইকেল তাঁকে অনুরোধও করলেন যে তিনি বিজ্ঞানে গবেষণা করতে চান। কিন্তু মাইকেল ফ্যারাডেকে তখন কে চেনে। অখ্যাত অপরিচিত নাইকেলের ওই চিঠির কোনও উত্তরই দিলেন না রয়েল সোসাইটির সভাপতি। রয়েল সোসাইটি থেকে কোনও চিঠি না পেলেও কিন্তু হাল ছাড়লেন না মাইকেল ফ্যারাডে। তিনি এবার হামফ্রে ডেভির ঠিকানা যোগাড় করলেন এবং সরাসরি তাঁকেই চিঠি লিখলেন। মাইকেল ফ্যারাডের এই চিঠি পেয়ে ডেভি সরাসরি সশরীরে একদিন হাজির ফ্যারাডের বাসভবনে। ডেভি বুঝতে পারলেন গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য ফ্যারাডেকে ঠিকমত সুযোগ দিলে সে বিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করবে এবং বিশ্বজোড়া খ্যাতিও অর্জন করবে। ডেভির এই অনুমান ব্যর্থ হয়নি—বই বাঁধানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে ডেভির গবেষণাগারে সহায়ক হিসাবে নিযুক্ত হলেন। গবেষণা করার সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ পেয়ে রসায়ন বিজ্ঞানে ডেভির সঙ্গে গবেষণা করতে শুরু করলেন ফ্যারাডে। তারপর ফ্যারাডের শুরু হল নতুন নতুন আবিষ্কার। বলা বাহুল্য মাইকেল ফ্যারাডে একজন পরিণত যুবকে পরিণত হয়েছেন। এরপর তিনি আলাদাভাবে নিজের গবেষণাগার গড়ে শুধু রসায়ন বিজ্ঞান নয় পদার্থ বিজ্ঞানেও অনেক নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ফ্যারাডের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলিকে কাজে লাগিয়ে অনেক অনেক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মহাবিজ্ঞানী তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সেজন্য মাইকেল ফ্যারাডে সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্যার হ্যামফ্রে ডেভি একবার বলেছিলেন যে “ফ্যারাডেই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।”
0 Comments