‘চড়াই-উতরাই’ : নরেন্দ্রনাথ মিত্র
সমাজকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় না। তাই সাহিত্যিক মাত্রেই সমাজ সচেতন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রর ছোট গল্পে সমাজের বিধিবদ্ধতায় কোন আঘাত হানার প্রবনতা নেই, সমাজ সম্পর্কিত কোন আলোড়ন আনার প্রয়াস নেই, সমাজ সংস্কারের কোন দাবী নেই, মানব মনের অন্ধকার ও চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বে ঘেরা ঘাত প্রতিঘাতের মর্মান্তিক আলোড়নকে তুলে ধরার কোন বাসনা নেই। তাঁর ছোট গল্প আন্দোলিত হয়েছে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে স্নেহ প্রেম মায়া মমতার এবং কর্তব্যবোধের টানাপোড়েনে। জীবনে রুক্ষতা যেমন আছে, হৃদয়ের আর্দ্রতাও তেমনই আছে। এই দুইয়ের মধ্যেই জীবন এবং সেই জীবনের অভিজ্ঞতাই নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোট গল্পের বিষয়।
এই গল্পে আছে তিনটি সামাজিক স্তরের বিন্যাস—উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্ত অর্থাৎ যারা সাধারণতঃ দারিদ্র্য লাতি কৃষিমজদুর ও শ্রমিক, তাদের কোন ভূমিকা এ গল্পে নেই। ব্যারিষ্টার অসিত মজুমদার উচ্চবিত্ত শ্রেণীর, গল্প কথক কল্যান এবং মল্লিকা যথাক্রমে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। জীবন অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ, হৃদয়ের টানা পোড়েন ও আকর্ষণ বিকর্ষণের সুক্ষাতিসুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে গল্পটি শিল্পদ্যুতিতে উত্তরিত। মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি কল্যানের চোখে উচ্চবিত্তের কৃত্রিমতা ও ভণ্ডামি এবং সর্ব বিষয়ে অহংভাব যেমন পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত মল্লিকার আত্মসম্মান হানিকর রুচিবিকৃতি ও কুৎসিৎ মনোবৃত্তির প্রকাশে। এই উভয় স্থান হতেই মধ্যবিত্ত কল্যানকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। সে অনুভব করেছে যে উচ্চবিত্ত সমাজের আদর আপ্যায়ন, আতিথেয়তা, আচার আচরণ এসব কিছুর পিছনে কার্যকরী তাদের স্বার্থবুদ্ধি। তারা গোষ্ঠীগত ঘেরাটোপ হতে বাইরে এসে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে কোন সম্পর্কে সম্পর্কীত হতে চায় না, উপযাচক হয়ে কেউ এগিয়ে এলে এরা তাকে ভাবে করুণাপ্রার্থী। তারাই যে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় শ্রেষ্ঠতর, তারাই যে কলকারখানা শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্যের মালিক এবং অন্যান্যেরা সেখানে তাদেরই নিযুক্ত কর্মচারী বা শ্রমিক—এ কথা তারা কোনোভাবেই তুলতে পারে না।
মধ্যবিত্ত সমাজ জীবন যন্ত্রনার স্বাভাবিক হকদার। এদের শিক্ষা আছে, কিন্তু বিনিময়ে পায় স্বল্প বেতনের কেরানীর পদ। এদের সাধ আছে, কিন্তু তা পুরণের সাধ্য নেই। সংহতিবোধ, সুস্থ শিল্প বিষয়ে পারদর্শিতা, রোমান্টিক প্রবনতা, আত্মমর্যাদাবোধ—এসবই থাকার জন্যে উচ্চ বিত্তের করুণার দ্বারে তারা তেমন প্রার্থী হতে পারে না, তেমনি পারে না রুচিবিকারগ্রস্ত নিম্ন মধ্য বিত্তের সঙ্গে সামাজিক ভাবে মেলামেশা করতে। সীমাবদ্ধতার ঘেরা টোপে তাদের সম্বল শুধু হতাশা আর যন্ত্রনা।
দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে রুচিহীনতা ও দীনতা যেমন প্রকট, তেমনি শিক্ষার গৌরব, সংস্কৃতির মূল্য, শিল্পবোধের সার্বিক উন্নতি এদের কাছে সময়ের অপব্যয়। দিনান্তের আহার সংগ্রহ করাই এদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। এরা মরু বালুকায় উঠের মত মুখ ঢেকে আত্মপ্রবঞ্চনার বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ রাখে ।
কল্যান দুটি চিঠি পেয়েছে—একটি অসিতের বিবাহ উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রন, অপরটি মল্লিকার লেখা কল্যানের স্ত্রী ইন্দিরাকে। দু জায়গায় একদিনে যাওয়ার জন্যে সে সকাল সকাল অফিস হতে বেরিয়ে ফুল সমেত সদানন্দ রোডের বিয়ে বাড়িতে এসেছে। আলোকসজ্জা, বাইরে গাড়ীর ভিড়, অতিথি সমাগম, ঝাঁকে ঝাঁকে সুন্দরী মেয়েদের ইতস্ততঃ বিচরন—এ সবই উচ্চবিত্তের পরিচয় জ্ঞাপক, কিন্তু অসিতের পিতার পরণে খাটো ধুতি ও ফতুয়া দেখে কল্যান বিস্মিত হয়েছে। নববধুর সঙ্গে অসিত কল্যানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লেখক বন্ধু বলে। সবই খুশীর দিক। কিন্তু কল্যানের এই খুশী স্থায়ী হয়নি। এলিট সমাজের নিয়ম অনুযায়ী প্রীতিভোজটাই বাতিল। এটা এই সমাজের কাছে অপব্যয়। কল্যান একটা আইসক্রিম ও কফি খেয়ে বিদায় নিয়েছে। আসার সময় অসিত দুটো টাকা তার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে উপদেশ দিয়েছে, "Be worldly my friend, be Practical." প্রীতিভোজের পরিবর্তে উপদেশ শুনে কল্যান বিরক্তি নিয়ে স্থান ত্যাগ করেছে। আশেপাশে কোন ভিখারীর সন্ধান মেলে নি যাকে অসিতের দেওয়া দুই টাকা অর্পণ করতে পারে। এরপরেই কল্যাণের মল্লিকাদের বাড়ি আগমন। সদর দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও সে দরজার কড়া নাড়ে। বেরিয়ে আসে মল্লিকার দুটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। বাটনা বাটা ফেলে রেখে মল্লিকাও এসে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। একটা মাত্র ঘর। তক্তপোষের উপর ঢালাই বিছানা, তার তলায় যাবতীয় সংসার। কথায় কথায় বিয়ে বাড়ির বিষয়টা জেনে মল্লিকা ছেলেকে দোকানে পাঠিয়ে ময়দা মাখতে বসে। যতীনের চোখের অসুখের কথা তুললেও মল্লিকা যেন এড়িয়ে যায়। দেওয়ালে টাঙ্গানো মল্লিকার হাতের সূচী শিল্পের মধ্যে দুই পংক্তির একটি পদ্য কল্যানের চোখে পড়ল।
“সতীত্ব সোনার নিধি বিধিদত্তধন, কাঙালিনী পেলে রানী এ হেন রতন।” কল্যান ভাবতে থাকে। মল্লিকার মধ্যে এখনও কি প্রেম প্রেম খেলার জের চলছে। নইলে বিবাহিত হিন্দুনারীর যেটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা এভাবে দেওয়ালে লটকে রাখার কোন অর্থ হয় না।
লুচি তরকারী কল্যান খুব কমই খেল। এর পরে বিদায়ের পালা। কল্যানের সঙ্গে বাইরে আসে মল্লিকার দুই ছেলে মেয়ে ননী ও ময়না। কাকাবাবু তাদের জন্য কিছু আনেনি—এমনতর অভিযোগ জানিয়েই ননী তার পকেট হতে অসিতের প্রদত্ত টাকা দুটো তুলে নিয়ে পালায়। ময়নাও অন্য পকেটের খুচরোগুলো তুলে নেয়। বিস্মিত কল্যান একটা সিগারেট ধরায়। ননী ফিরে এসে জানায় যে মল্লিকা টাকা দুটো কেড়ে নিয়েছে। মল্লিকা বেরিয়ে এসে বলে যে এ কাল সকালে মুড়ি মুড়কিতে খরচ হবে। কল্যান মল্লিকার আচরণে বিস্মিত হয়। কিন্তু বিস্ময়ের পরেই সে ভীত হয়ে ওঠে যখন মল্লিকা তাকে নাইট শোতে সিনেমা দেখার আহ্বান জানায়। ননীর মতই ভীত কল্যানও ছুটতে ছুটতে গলি পার হয়ে উন্মুক্ত রাজপথে এসে দাঁড়ায়।” মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আত্মমর্যাদা যেমন উচ্চবিত্তের বিলাস বৈভবেও মেকি আড়ম্বরে ক্ষুন্ন হয়ে চড়াই-এ ওঠার আকাঙ্ক্ষাকে বিনষ্ট করেছে তেমনই উতরাই এ নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রুচিহীনতা ও মানসিক কদর্যতা মধ্যবিত্ত সমাজকে আঘাত করেছে। চড়াই বা উৎরাই উভয় পরিক্রমনই কল্যানের ব্যর্থ হয়েছে।
0 Comments