নিশীথে' : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


‘নিশীথে' : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অতিপ্রাকৃত বা ‘supernatural theme' এর বিশ্বাস মানুষের রক্তে, তার দেহ কোষের প্রতি অনু পরমাণুতে। যুক্তি দিয়ে যা মুহূর্তের মধ্যে নস্যাৎ করা যায়, সেটাই যখন চিরন্তনী হয়ে আদিম বিশ্বাসে শিকড় ছড়ায় তখন হ্যামলেটের মত অতিপ্রাকৃতের ভাবনা ভাবিত না হয়ে মানুষের আর উপায় থাকে না। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন যে মানুষ ভয় পেতে ভালবাসে বলেই অতিপ্রাকৃতে সে বিশ্বাস করে। ভার্জিনিয়া উলফ একেই বলেছেন “strange human Craving for feeling afraid". অতিপ্রাকৃতের আলোচনা পাশ্চাত্যেও চলেছে বহুকাল ধরে। গ্রীসের নাটকে সঙ্কট মোচনে অতিপ্রাকৃত শক্তির আবির্ভাব দেখা যায়। Webster ও Tourneur এ যদিও তা Crude এবং horrible, শেক্সপীয়রের হাতে হয়ে উঠেছে নতুন এক Art form। কোলরিজের Ancient mariner-এ অতিপ্রাকৃত অনুভূতি স্তরে, যদিও lady of shalott-এ ভূত সীমার মধ্যে দৃশ্যমান। Walter de la mere এ অশরীরী আত্মার উপস্থিতি অনুভূতি সাপেক্ষ। সমুদ্রের ভয়ালশক্তি অতিপ্রাকৃতের রূপ ধরে এসেছে Synge এর Riders to the sea' তে। Ibsen এবং বার্নার্ড শা ভাগ্যের পরিণতিকে অতিপ্রাকৃত স্তরে নিয়ে গেছেন। ‘নিশীথে' গল্পে ভূতের কোন উপস্থিতি নেই, অথচ সমগ্র গল্পে ভৌতিক পরিবেশ বা অতিপ্রাকৃতের অনুভূতি বিদ্যমান। অতিপ্রাকৃতের পরিচিতি রাবীন্দ্রিক শিল্পরূপে এ গল্পে বিদ্যমান। এ গল্প আদ্য-মধ্য-অন্তযুক্ত কোন কাহিনী নয়, দ্বন্দ্বমূলক কোন রেখাচিত্রও নয়, অতিপ্রাকৃত গল্পের শিল্প কাঠামোয় গল্পের নায়কের বিবেক জর্জরিত অর্ন্তলোকের বহিঃপ্রকাশ। ভূতহীন এই ভূতের গল্পে অতিপ্রাকৃতের ছায়ালোকে গল্প কথনের মূল লক্ষ্যটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক। চার বছরের প্রলম্বিত কালসীমাই এ গল্পের দৃঢ় বদ্ধ কালসংহতি। রবীন্দ্রনাথ এ গল্পে দ্বিনারীতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। প্রিয়া ও মাতা নারীত্বের দুই ভিন্ন রূপ। যারা প্রিয়া হওয়ার জন্য জন্মায়, তারা কখনই সুমাতা হতে পারে না, আবার যারা স্বভাবতই মাতৃপ্রবন প্রিয়ার যোগ্যতায় তারা ব্যর্থ। দক্ষিনাচরণের প্রথমা স্ত্রী এই কল্যানী মূর্তি—। তিনি শুধুই গৃহিনী। ললিত কলাবিধির কোন উপদেশ, বা সখীভাবে প্রণয় সম্ভাষনে তিনি উচ্চ হাস্যে জল ঢেলে দিতেন। দক্ষিণাচরণ মৃত্যুরূপী কালব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্ত্রীর অক্লান্ত সেবায় যমদূতকেও পিছু হটতে হয়েছিল। এ সেবা সেবাপরায়না মাতার।

কিন্তু দক্ষিনাচরণ সেবা পরায়না কল্যানী স্ত্রীকে চিনতে পারেন নি। তিনি প্রেয়সীকে পেতে চান। ক্লান্তিহীন আপ্রাণ প্রচেষ্টায় স্বামীকে ফিরিয়ে এনে স্ত্রী নিজেই এবার শয্যাশায়ী হলেন। স্বামী তার সেবা করতে পারলেন না, তিনিও স্বামীর সেবা গ্রহন করলেন না। বায়ু পরিবর্তনের জন্যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে এলাহাবাদে এলেন এবং সেখানেই স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে তৃতীয় জনের অনুপ্রবেশ ঘটল। এই তৃতীয় জন হলেন হারান ডাক্তারের কন্যা মনোরমা।

স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যই হারান ডাক্তারের আগমন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জানা হয়ে যায় যে এ রোগ অরোগ্যের অতীত। দক্ষিণাচরণ স্ত্রীর সেবা না করার কথা ভাবতেই পারেন না, অথচ জানেন এ সবই বৃথা। এমন সময় পরিচয় ঘটল মনোরমার সঙ্গে। মনোরমার সান্নিধ্য তাকে ব্যাকুল করে তুলল। স্ত্রীর ঘর হয়ে উঠল রোগীর ঘর এবং মনোরমার সান্নিধ্যে তার সময় ক্ষেপন দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে থাকল। অসুস্থা স্ত্রী সবই বুঝলেন। একের আগমন ত্বরান্বিত করতে আর একজনকে সরে যেতেই হবে। পাশের ঘর হতে দক্ষিণাচরণ শুনলেন যে স্ত্রী হারান ডাক্তারকে সেই কথা বলছে।

হারান ডাক্তারের প্রদত্ত বিষ খেয়ে প্রথমা স্ত্রী আত্মহত্যা করার পরই মনোরমার সঙ্গে দক্ষিণা চরনের বিবাহ হল। কিন্তু বিবাহের পর মনোরমা তাকে কোনদিন বিশ্বাস করেনি। যে স্বামী চিত্তের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে স্ত্রীর আত্মহত্যার সুযোগ করে দেয়, মনোরমা সেই স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারেনি।

গল্পের পরের অংশ অতিপ্রাকৃত পটভূমিকায় পূর্ণ। অন্ধকার ঝাউগাছের শিখর দেশে আগুনের রক্তরেখা, অন্যদিকে কৃষ্ণপক্ষের প্রান্তক্ষয়ী চাঁদ উঠে আসছে ঝাউগাছের মাথা ছাড়িয়ে। সাদা শাড়ি পরে সাদা পাথরে শায়িত মনোরমার শ্রান্তদেহে এসে পড়ছে চন্দ্রালোকের শুভ্রতা- সাদায় সাদায় মনোরমার অস্তিত্ব যেন সাদার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাচরন ধৈর্যহীন হয়ে মনোরমার হাত ধরে বলল,“মনোরমা, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালবাসি। তোমাকে আমি

কোন কালে ভুলিতে পারিব না।”

কথাটি বলেই দক্ষিণাচরণের মনে পড়ল এই কথাটি তিনি এর পূর্বে আর একজনকে বলেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা হা হা হাসির শব্দ ঝাউগাছের মাথার উপর দিয়ে, জীর্ণ শান্ত চাঁদের নীচে দিয়ে, গঙ্গার পাড় অতিক্রম করে সুদূরে মিলিয়ে গেল। দক্ষিণাচরণ মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। এটাই প্রথম, কিন্তু শেষ নয়। এই মর্মভেদী হাসি আসলে উড্ডীয়মান হংস শ্রেণীর পাখার শব্দ। দক্ষিণাচরণকে তা বলা হয়েছে, তিনি নিজেও সেটা জানেন না তা নয়। কিন্তু যেই অন্ধকার নেমে আসে তার মনে হয় ; অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে জমাট বাঁধা হাসি, সামান্য একটা উপলক্ষ্য পেলেই অন্ধকার বিদীর্ণ করে অট্টহাস্যে সবদিক পরিব্যাপ্ত করবে। এ তার নিশাসত্তা, এ সত্তা যুক্তিবোধ হতে বহুদূরে।

দক্ষিণাচরণ এর পর থেকে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু নিজের কাছ হতে তিনি কি পালাতে পেরেছিলেন? একদিন পদ্মা তীরে ঘুরে বেড়ানোর সময় শুভ্র চন্দ্রের আলোর আভাসে রমনীয়া মনোরমাকে চুম্বনে অভিষিক্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনবার যেন অশুভ সংকেত ধ্বনিত হল 'ওকে? ও কে? ও কে গো?' যুক্তি দিয়ে উভয়েই বুঝল এটা জলচর কোন পাখির ডাক। কিন্তু দক্ষিণাচরণের নিশাসত্তায় সেই একই ধ্বনি বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। বাড়ি ফিরে মনোরমা ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুমনেই দক্ষিনাচরণের। অবরুদ্ধ সেই ডাক যেন ধ্বনিত হল মশারির বাইরে, বক্ষ স্পন্দনেও সেই একই শব্দ, ক্রমশঃ গোলাকার বৃত্তের মধ্যে ঘড়ির কাঁটা দুটো যেন আবর্তিত হতে হতে বলে উঠল 'ও কে - ও- কে, ও কে গো ।

বাইরে পাখীর ডাক। দক্ষিণাচরণের দিবাসত্তা জেগে উঠছে, ঘুমিয়ে পড়ছে নিশাসত্তা। মাথা তুলছে তার অহংবাদ। ডাক্তারের উপর তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তার মনে হল ডাক্তার যেন তাকে বাধ্য করেছে অন্তরাত্মার উন্মোচনে।

আবার নিশায় জেগে ওঠে তার নিশাসত্তা—এ তার প্রেত সত্তাও। এর হাত হতে তার যেন মুক্তি নেই। দরজায় আঘাত পড়ে। ডাক্তার ডাক্তার।

এ গল্প তাই ভুতের নয়। হা হা হাসি বা ‘ও কে - ও কে - ও কে, ও কে গো' ধ্বনি প্রকৃতি রাজ্যের শিহরন মূলক বাস্তব। তথাপি এই গল্পটি রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃত গল্পধারার অন্যতম নিদর্শন হয়ে রয়েছে শুধু এই কারণে যে এর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে weirdness যার সন্ধান পাওয়া যায় 'কঙ্কাল' ও 'জীবিত মৃত' গল্পে।






Post a Comment

0 Comments