অস্ট্রিক থেকে সাঁওতালি

অস্ট্রিক থেকে সাঁওতালি



ভারতবর্ষের মাটিতে প্রকৃত আদিম অধিবাসী বা আদিবাসী কারা তা জানা যায় না । নৃতাত্ত্বিকদের মতে বর্তমান ভারতের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ প্রত্যেকেই বহিরাগত। তবু প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতভূমিতে আসা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব কোনভাবে এখনও টিকে আছে, তাদেরই আমরা ভারতের আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে সমস্ত মানবগোষ্ঠী ভারতভূমিতে এসেছে, তাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার মাধ্যমে মূল প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে।

(১) নিগ্রিটো বা নিগ্রোবুট। নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে সুদূর আফ্রিকা থেকে জলপথে আরব হয়ে প্রথম এই মানবগোষ্ঠী ভারতভূমিতে আসে। বর্তমানের আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এই নিগ্রোবুট গোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এই মানব গোষ্ঠীর আগে ভারতভূমিতে কারা বসবাস করত তা জানা যায় না।

(২) প্রোটো অস্ট্রালয়েড। নিগ্রিটো বা নিগ্রোবুট নামক মানবগোষ্ঠীর পর ভারত ভূমিতে আসে প্রোটো-অস্টালয়েড নামক মানবগোষ্ঠী। নামকরণে কেউ বলেন, প্রায় অষ্টালয়েড বা অষ্ট্রাল। আবার কেউ কেউ বলেন আদি অস্ট্রাল। অনেকের মতে এই মানবগোষ্ঠীকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলার কারণ হচ্ছে—অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে এদের বৈশিষ্ট্যগত মিল আছে। এই মানবগোষ্ঠী আসে পশ্চিম এশিয়া থেকে। অনেকের মতে আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে। এ নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগত অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায় বর্তমানের 'কোল'-দের মধ্যে। ‘কোল’ বলতে বোঝায় সাঁওতাল, মুণ্ডা, গন্দ, হো প্রভৃতি উপজাতি। সুতরাং এ কথা অবশ্যই বলা যায়, এঁরাই ভারতের আদিবাসী।

(৩) দ্রাবিড়। প্রোটো-অস্টালয়েড মানবগোষ্ঠীর পর ভারতভূমিতে আসে দ্রাবিড় নামক মানবগোষ্ঠী। এরা আসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে তাই এদের ভূমধ্য বা ‘মেডিটেরেনিয়ান’-ও বলা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রোটো অস্ট্রালয়েড ও দ্রাবিড় মানবগোষ্ঠীর অ্যাসিমিলেশন বা সংযুক্তিকরণে গড়ে উঠে অস্ট্রিক সভ্যতা যার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় ।

নারীর ভূমিকা বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করিয়াছি। ওরাঁওদের কারাম পরবে পুরুষেরা ডাল কাটিয়া আনিয়া প্রতিষ্ঠা করে সত্য তবে নারীকে প্রাধান্য দিতে হয়। কুমারী বালিকারাই ভাসানের দিন “দে দে আয়ো তেলা পূর্ণতা সিঁদুর” সাদরি ভাষায় এই গান গাহিতে গাহিতে কারাম ডাল বহন করিয়া আনিয়া জলাশয়ে বিসর্জন দেয়। বিসর্জনের পদ্ধতিও খেরোয়াল গোষ্ঠী হইতে পার্থক্য লক্ষিত হয়। সাঁওতালগণ পেছন করিয়া কারাম ডাল বিসর্জন দেয় (কিন্তু সর্বত্র নহে। দ্রঃ খেরোয়াল বংশা ধরম পুথি।) কিন্তু ওরাঁও কুমারীরা সামনের দিকে মুখ রাখিয়া বিসর্জন দেয়।

ওরাঁও জাতির সহিত কৃষিকর্মের প্রসারের ইতিহাস জড়িত। পালামৌ অঞ্চ লের কিষাণরা মূলতঃ ওরাঁও ছিলেন। পালামৌ নামটি দ্রাবিড় গোষ্ঠীর একটি প্রাচীন শব্দ হইতে আসিয়াছে। ইহার অর্থ হইল প্রান্তর বা বিস্তৃত ক্ষেত্র। যাযাবর কাকমারাদের ভাষায়, পালামু' শব্দের অর্থ হইল field বা মাঠ (Direct Draid Wrokds in Midnapur Dialect, Bulletin, Culture Research Institute, Vol. XV, Number 1 & 3, 1982) ছোটনাগপুরের পাহাড় ঘেরা বিস্তৃত যে সমতল ক্ষেত্র কৃষির উপযুক্ত তাহাই ‘পালা—মু’নামে পরিচিত। ঠিক এমনভাবে খেরোয়াল গোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা রাঁচি শব্দের ব্যবহার হয়। রাঁচি শব্দ মূলতঃ রাচা হইতেই আসিয়াছে। ইহার মৌলিক অর্থ হইল সমতল প্রাঙ্গণ—ছোটনাগপুরের মালভূমি সমতল ক্ষেত্র।


ভারতবর্ষের মাটিতে প্রকৃত আদিম অধিবাসী বা আদিবাসী কারা তা জানা যায় না । নৃতাত্ত্বিকদের মতে বর্তমান ভারতের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ প্রত্যেকেই বহিরাগত। তবু প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতভূমিতে আসা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব কোনভাবে এখনও টিকে আছে, তাদেরই আমরা ভারতের আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে সমস্ত মানবগোষ্ঠী ভারতভূমিতে এসেছে, তাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার মাধ্যমে মূল প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে।

(১) নিগ্রিটো বা নিগ্রোবুট। নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে সুদূর আফ্রিকা থেকে জলপথে আরব হয়ে প্রথম এই মানবগোষ্ঠী ভারতভূমিতে আসে। বর্তমানের আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এই নিগ্রোবুট গোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এই মানব গোষ্ঠীর আগে ভারতভূমিতে কারা বসবাস করত তা জানা যায় না।

(২) প্রোটো অস্ট্রালয়েড। নিগ্রিটো বা নিগ্রোবুট নামক মানবগোষ্ঠীর পর ভারত ভূমিতে আসে প্রোটো-অস্টালয়েড নামক মানবগোষ্ঠী। নামকরণে কেউ বলেন, প্রায় অষ্টালয়েড বা অষ্ট্রাল। আবার কেউ কেউ বলেন আদি অস্ট্রাল। অনেকের মতে এই মানবগোষ্ঠীকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলার কারণ হচ্ছে—অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে এদের বৈশিষ্ট্যগত মিল আছে। এই মানবগোষ্ঠী আসে পশ্চিম এশিয়া থেকে। অনেকের মতে আবার অস্ট্রেলিয়া থেকে। এ নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগত অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায় বর্তমানের 'কোল'-দের মধ্যে। ‘কোল’ বলতে বোঝায় সাঁওতাল, মুণ্ডা, গন্দ, হো প্রভৃতি উপজাতি। সুতরাং এ কথা অবশ্যই বলা যায়, এঁরাই ভারতের আদিবাসী।

(৩) দ্রাবিড়। প্রোটো-অস্টালয়েড মানবগোষ্ঠীর পর ভারতভূমিতে আসে দ্রাবিড় নামক মানবগোষ্ঠী। এরা আসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে তাই এদের ভূমধ্য বা ‘মেডিটেরেনিয়ান’-ও বলা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রোটো অস্ট্রালয়েড ও দ্রাবিড় মানবগোষ্ঠীর অ্যাসিমিলেশন বা সংযুক্তিকরণে গড়ে উঠে অস্ট্রিক সভ্যতা যার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় ।



(৪) আলপীয় নরগোষ্ঠী। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর পর আর্যভাষী এই আলপীয় নরগোষ্ঠী ভারতভূমিতে আসে। অনেকে বলেন এরা ইউরোপের ‘আলপাইন’নরগোষ্ঠীর সমতুল্য। অনেকের মতে, এই নরগোষ্ঠী মেসোপটেমিয়া ও এশিয়া মাইনর থেকে খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতভূমিতে আসে। পণ্ডিতগণ বলেন, অস্ট্রিক-এর সঙ্গে আলপীয় নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালী জাতির উদ্ভব হয়।

(৫) নর্ডিক । আর্য ভাষাভাষী আলপীয় নরগোষ্ঠীর পর এই ভাষাভাষীরই অন্তর্ভুক্ত নর্ডিক মানবগোষ্ঠী ভারতভূমিতে আসে। এই নর্ডিকরা ছিল উত্তর এশিয়ার তৃণভূমির অধিবাসী। খৃষ্টপূর্ব দু'হাজার থেকে এক হাজার বছরের অন্তর্বর্তী কোনও এক সময়ে এদের একটি বড় ধারা স্থলপথে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে হতে এক হাজার পাঁচশত খৃষ্ট-পূর্বাব্দ নাগাদ ভারতের দিকে এগিয়ে আসে এবং পঞ্চ নদের উপত্যকায় পৌঁছে সেখানে বসতি স্থাপন করে।

(৬) মঙ্গোলয়েড। নর্ডিকের পর মঙ্গোলিয়া অঞ্চ ল থেকে আসা এই মানবগোষ্ঠী ভারতের পূর্ব ও উত্তর সীমান্তে হিমালয় পর্বতমালা পেরিয়ে ভারতভূমিতে আসে। এরপর জাতি-ধর্ম অনুযায়ী ভারতভূমিতে ক্রমান্বয়ে আসে শক, হুন, পাঠান, মোঘল, পর্তুগীজ ও সব শেষে ইংরেজ।

এবার মূল প্রসঙ্গের আলোচনায় আসা যাক :—

ডঃ অতুল সুর তাঁর ‘বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, প্ৰাক দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোকেরাই বাংলার প্রকৃত আদিবাসী। তারা (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) যে ভাষায় কথা বলত তাকে ‘অস্ট্রিক’ ভাষা বলা হয়। অস্ট্রিক বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এই ভাষার বিস্তৃতি ছিল পাঞ্জাব থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। সুতরাং একথা বলা যায়, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড মানবগোষ্ঠীর লোকেরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত। ভাষা বিজ্ঞানীগণ অস্ট্রিক ভাষাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন—(১) অস্ট্রোনেশিয়ান এবং (২) অস্ট্রোএশিয়াটিক। অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষাবর্গের তিনটি ভাগ। (১) ইন্দোনেশিয়ান (২) মালনেশিয়ান এবং (৩) পলিনেশিয়ান।

ইন্দোনেশিয়ান : ইন্দোনেশিয়ার সমস্ত ভাষা যেমন মালয়, সুমেত্রা, সুন্দা, জ্যাবোদ্বীপ, মাদুরী, বালীদ্বীপ, লম্বোদ্বীপ, সেলেবেস, ফিলিপাইন, মাদাগারকার ইত্যাদির ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

মালেনেশিয়ান ঃ ফিজি, ভিটি, নিউ সেলেডোনিয়ান, নিউ হেব্রিডিয়ান, সোলোথন ইত্যাদি দ্বীপের ভাষা মালেনেশিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

পলিনেশিয়ান : সামোয়া, টঙ্গা, মারকিউশাস, পাউমতু, মাউরি, নিউজিল্যাণ্ডের ভাষাসমূহ এবং হাওয়াই দ্বীপের ভাষাসমূহ পলিনেশিয়ান ভাষাবর্গের অন্তর্ভুক্ত। অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষার পাঁচটি যেমন— (১) চাম্ (২) খাসিয়া (৩) নিকোবরী (৪) মনখমের এবং (৫) মুণ্ডারী (কোল)।

চাম

: প্রাচীন চীনের এক বিশেষ অঞ্চ লের প্রাচীন ভাষা হল চাম। অনেকে একে ‘চাম্পা' ভাষা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। খাসিয়া : অনাম ও তোংকিন-এর ভাষা। নিকোবরী : নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ভাষা।

মন্‌খমের : এই ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলি হল- (১) আসামের খাসিয়া ভাষা।

(২) দক্ষিণ বর্মা ও দক্ষিণ শ্যামমোন-এর ভাষা। (৩) উত্তর বার্মার পোলোং ও ওয়া ভাষা। (৪) কাম্বোজ-এর খোমের ভাষা।

(৫) ইন্দো-চিনের বাহনার ও তিয়েন ভাষা ৷

মুণ্ডারী : একে ‘কোল' ভাষাও বলা হয়। এই ভাষাগোষ্ঠীর দুটি ভাগ। (১) খেরওয়ারী ভাষা এবং (২) অন্যান্য উপভাষা।

অন্যান্য উপভাষার মধ্যে পড়ে খাড়িয়া, শবর, নিহালী, গাদাবা ইত্যাদি ভাষা। খেরওয়াড়ী ভাষা : এই ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলি হল (১) কোরওয়া, (২) অসুর (৩) তুরি (৪) হো (৫) কোড়া (৬) বিরহড় (৭) ভূমিজ (৮) মুণ্ডারী (৯) মাহালী (১০) করমালী এবং (১১) সাঁওতালি।

জনসংখ্যার বিচারে ও বলিষ্ঠতার বিচারে মুণ্ডারী তথা খেরওয়াড়ী ভাষাসমূহের মধ্যে সাঁওতালি সব থেকে উন্নত। সাঁওতালি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ভাষা। সাঁওতাল এবং সাঁওতালি শব্দ দুটি ভাষা ভেদে ও অঞ্চলভেদে বিভিন্নভাবে লেখা হয় ও বলা হয়। যেমন, হিন্দি ভাষীদের কাছে ‘সান্থাল' ও 'সান্থালী'। উত্তরবঙ্গ ও উত্তর ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষজন বলেন – 'সানতাল' ও 'সানতালী'। বাংলা ভাষীদের কাছে ‘সাঁওতাল ও সাঁওতালি'। দক্ষিণবঙ্গ ও উড়িষ্যার সাঁওতাল জনগণ বলেন ‘সান্তাড়’ ও ‘সান্তাড়ী’।

সাঁওতাল নামকরণের উৎপত্তি সম্পর্কে নানারকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন, 


(১) সাঁত দিশম অর্থাৎ সাঁত অঞ্চ লে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরই তাঁদের

নামকরণ হয় সাঁওতাল ।

(২) সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সীমান্তরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হবার পর থেকেই সীমান্ত বা সামন্ত বা সাঁওতাল নামকরণ হয় ।

(৩) পাহাড় জঙ্গলে বসবাসকারী আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষজন যখন সমতলে নেমে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তখন থেকেই তাঁদের নামকরণ হয় সাঁওতাল। 

(৪) সামগানের সঙ্গে যাঁরা 'তাল' বজায় রাখতেন তাঁদের সাঁওতাল নামকরণ করা হয়।

(৫) ‘লাহান্তি' পত্রিকার ৪র্থ বর্ষ, ১৬শ সংখ্যায় সাঁওতাড় কাথা রেনাঃ ভেদ’ নামক সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে শ্রী বায়ার বাসকে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন এইভাবে

অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর জনগোষ্ঠী চীন হয়ে ভারতে আসে। চীন এদের কাছে চাই। চাই অর্থাৎ চীনের যে অঞ্চ লে এদের বসবাস ছিল সেই অঞ্চ লের নাম ছিল 'খিউথিচ্’। এই জনগোষ্ঠীর মানুষ ছোটনাগপুর অঞ্চ লে প্রথম বসবাসকালীন তাঁদের বলা হত ‘চাওথিচ্’নামে। এই ‘চাওথিচ্’ থেকে হয় ‘চাওথিচিয়াল’। এ থেকে হয় ‘চাওথিরাল’। এ থেকে ‘চাওথাল’। চাওথাল থেকে সাঁওতাল। অর্থাৎ, খিউচ্থিচ > চাওথিচ্ > চাওথিচিয়াল > চাওথিরাল > চাওথাল > সাঁওতাল ।

সাঁওতাল নামকরণের উপরোক্ত পাঁচটি কারণের মধ্যে প্রথমটি বাদ দিলে বাকীগুলি কতখানি যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তবু এ নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে।

নামকরণের প্রথম কারণ অর্থাৎ— সাঁত দিশম অর্থাৎ সাঁত অঞ্চ লে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পরই তাঁদের নামকরণ হয় ‘সাঁওতাল'–এর পক্ষে W.B. Oldham -এর বক্তব্য এ রকম— The name (Santal) is an abbreviation of samantwala Saamanta is another name given to Silda Pargana Whence the immigrant Santals, discovered by Mr. Ward in 1878, deposed that they had come. come."

শিলদা পরগণা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছে সাঁতদিশম নামে চিহ্নিত। শিলদা পরগণা এই ভূখণ্ডকে ‘সামন্ত' বলা হয়েছে এবং এখানকার অধিবাসীদের বলা হয়েছে ‘সামন্তওয়ালা’। এই সামন্তওয়ালা থেকে সাঁওতাল নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। D. Barka Kisku তাঁর ‘The santals and their Anncestors' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন -The santals themselves state that they got this name through foreigners commencing to call them so whilst and because they were Living in (১৫০ )

Saont (Sant as they pronounce the name of the country) Which has been indentified with the modern Silda Pargana in Midnapore District.

সুতরাং দেখা যাচ্ছে সান্তাল (সাঁওতাল) নামকরণটি বিদেশীদের কাছে পাওয়া এবং উপরোক্ত যুক্তিকেই সমর্থন করে। Bengal District Gazetters - Santal Parganas

L.S.S.O. Malley উল্লেখ করেছেন— The earliest mention of the name (Santal) appears to be contained an article entitled "Some Extra ordinary Facts, customs and Practices of the Hindus 'By Sir John shore, which was published in the asiatic Researches of 1795, in this articl they were designated 'Soontars 'and described as a rude unlettered Tribe residing in Ramgar (Ramgarh). "

"The first mention of the Santals in this district occurs in Montgomery Martin's Eastern India (Compiled from Buchanan Hamilton's manuscripts Which contains two reffrrence to them, in one of which their name is spelt 'Saungtar 'while in the other a printers error has converted it to "Taungtar."

"The santals and their Ancestors” গ্রন্থে D. Barka Kisku উল্লেখ করেছেন— The name (Santal) was given to them by the Britishers. This the Santals admit to have recieved from the English. When they entered the Damin-i-Koh in the last phase of the 18th and the begining of the 19th Century. "

D. Barka Kisku- এই বক্তব্যের সূত্র ধরে একটা সম্ভাব্য নির্ণয়ে আসা যেতে পারে এ ভাবে— ভাগলপুরের কালেক্টর অগাস্টাস ক্লীবল্যাণ্ড বিদ্রোহী পাহাড়িয়াদের জন্য 1779 সালে উপনিবেশ স্থাপন করেন। নাম দেন ‘দামিন-ই-কোহ’। এখানে পাহাড়িয়ারা থাকতে রাজি হন না। এই সময়ে দামিনের বাইরে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দেলন শুরু হয়। তিলকা মাঝির ফাঁসীর পর শাসকগোষ্ঠীর প্রবল অত্যাচারে ‘হড়’ রা নিজস্ব অঞ্চল ছেড়ে প্রাণ রক্ষার তাগিদে যে যেখানে পারে পালিয়ে যায়। এই সময়েই হয়তো হড়দের 'Soontar' or 'Saungtar'নামে আখ্যা দেওয়া হতে পারে । পরবর্তী সময়ে 1790 সালে দামিন-ই-কোহ-তে 'হড়'-দের প্রবেশ করতে দেওয়া হল। 1832-33 সালে দামিন-ই-কোহ-র সীমানা নির্ধারণ করা হল। এর পরই বড়লাট লর্ড বেন্টিকের আদেশ অনুযায়ী রাজমহলের পশ্চিমদিকের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাসের 

জন্য পুনরায় হড়দের আহ্বান জানানো হল। তখন দলে দলে 'হড়' কটক, ধলভূম, মানভূম, বরাভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চ ল থেকে দামিন-ই-কোহতে বসবাসের জন্য আসতে লাগল। হয়তো এ ভাবেই দামিন-ই-কোহ Last Phase মতে-এ আসে সাঁও বা সামন্ত পরগণার সামস্তওয়ালারা। প্রবেশ পথে বৃটিশ কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্তওয়ালারা সান্তাল বা সাঁওতাল হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য এ নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে।

নামকরণ যে ভাবেই হোক না কেন বা যা-ই নামকরণ হোক না কেন এ কথা সত্যি, সাঁওতালি ভাষা বর্তমানে বলিষ্ঠতার নিদর্শন রেখে চলেছে এবং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ভাষা।

১৯৭১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী সাঁওতালি ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষের সংখ্যা ৩৭,৮৬,৮৯৯ জন । ১৯৮১ সালের আদমসুমারীতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩,৩২,৫১১ জন। এবং ১৯৯১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী সাঁওতালি ভাষীর সংখ্যা ৫২,১৬,৩২৫জন। 1991 সালের লোকগণনায় সাঁওতালির যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে করমালী, মাহলী এবং অন্যান্য ভাষাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন— সাঁওতালী ৪৯,১৫,৮০৮ জন, ফরমালী ২,৩৩,৭৬৬ জন, মাহলী – ১৪,৯৯৫ জন, অন্যান্য ৫১,৭৫৬ জন।

মোট ৫২,১৬,৩২৫ জন।

মোট সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের সর্বত্রই কমবেশী সাঁওতালভাষী মানুষজন রয়েছেন। তবে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও আসাম রাজ্যেই এদের বসবাস বেশী। এ রাজ্যগুলোতে এরা কোথাও বিচ্ছিন্ন ভাবে, আবার কোথাও বিশাল অঞ্চ ল জুড়ে বসবাস করেন। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতবর্ষে সাঁওতালি ভাষার স্থান ত্রয়োদশতম ।

সাঁওতালি যে প্রাচীন ভাষা এ নিয়ে কোন সংশয় নেই। ভাষাবিদগণ প্রমান করেছেন যে সংস্কৃত ভাষার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে সাঁওতালি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং সংস্কৃতজাত ভারতীয় ভাষাগুলির দেশি শব্দের প্রায় ষাট শতাংশ সাঁওতালি শব্দ থেকেই গৃহীত বা উদ্ভুত।

ইদানীংকালে সাঁওতালি ভাষার মৌলিকত্ব নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক দেখা দিয়েছে কেননা বিবর্তনের পথে বিভিন্ন ভাষার শব্দ যেমন সাঁওতালিতে আশ্রয় নিয়েছে তেমনি সাঁওতালিও বহু শব্দ অন্য ভাষাকে দান করেছে। যেমন, যে সমস্ত সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চ লে বাংলা ভাষার প্রাধান্য রয়েছে সেখানে বাংলা শব্দের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপ ভাবে হিন্দি, উড়িয়া, অসমিয়া শব্দের প্রচলন সাঁওতালিতে রয়েছে। তেমনি বহু সাঁওতালি শব্দ অন্য ভাষার মধ্যেও রয়েছে।


মুসলমান রাজত্বে সাঁওতালি ভাষার প্রতি কোনরূপ উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নেবার কথা জানা যায়নি। সাঁওতালি ভাষীদের প্রতি মুঘল সম্রাটদের মানসিকতার পরিচয়ও জানা যায় না। হয়তো মাত্রাতিরিক্ত তাচ্ছিল্যের ভাষা হিসেবে মনে করা হত বলেই এ নিয়ে কেউ উৎসাহ দেখান নি বা গুরুত্ব দেন নি। তবে হিন্দু রাজা বা জমিদারদের সামান্য উৎসাহের ইঙ্গিত কিংবদন্তী থেকে জানা যায়। সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চ লের রাজা বা জমিদার অনেক সময় সাঁওতাল সঙ্গীত শিল্পীদের গান শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। শিল্পীরাও নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র সহ হাজির হতেন সঙ্গীত সভায়। নিজস্ব ভঙ্গী ও শৈলী অনুযায়ী রাজা বা জমিদারকে তাঁরা গান পরিবেশন করে শোনাতেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য রাজা বা জমিদার বাংলা ভাষী (তৎকালীন আঞ্চলিক বাংলা) হওয়াতে সাঁওতাল সঙ্গীত শিল্পীরা রাজা বা জমিদারের বোঝার জন্য সাঁওতালি গানে প্রচুর বাংলা শব্দের ব্যবহার করতেন। এ ভাবেই সাঁওতালি গানে প্রচুর বাংলা শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এখনও বাংলা শব্দ মিশ্রিত প্রচুর সাঁওতালি গান সাঁওতালদের Traditional গান হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। যাইহোক, সাঁওতালি ভাষার প্রতি এর বেশী বদান্যতার কথা জানা যায় না। বড়জোড় রাজা বা জমিদারের পক্ষ থেকে সঙ্গীত শিল্পীদের কিছু পারিতোষিক দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু ভাষার চর্চা বা বিকাশের জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ বা কৃপাদৃষ্টির ইতিহাস জানা যায় না।

সাঁওতালি ভাষার প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হন খ্রীশ্চান মিশনারীগণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বাইবেল প্রচার তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও মিশনারীগণই প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সাঁওতালি ভাষার মধ্যে জীবনীশক্তি রয়েছে, এই শক্তির মৌখিক সাহিত্যের ভাণ্ডার অফুরন্ত, বৈচিত্র্যময় ও একটা জাতির মনঃ চেতনার পরিচয় এর মধ্যে রয়েছে। ফলে অনেক মিশনারীগণ সাঁওতালি ভাষা শিখে এই ভাষার চর্চা ও উন্নয়নমূলক কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। বিনিময়ে কিছু সংখ্যক সাঁওতালকে হয়তো হারাতে হয়েছে নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির মৌলিকত্ব। তবু সাঁওতালি ভাষার ক্ষেত্রে মিশনারীগণই প্রথম আলোকপথের দিশারী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পরও বলা যায় ষাট সত্তর দশক পর্যন্ত অ-সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত মানুষ খ্রীশ্চান ধর্মাবলম্বী সাঁওতালদের যৎসামান্য সমীহের চোখে দেখলেও প্রকৃত সাঁওতালদের তাঁরা মানুষ হিসেবে কোনদিনই গণ্য করেনি। তাই তাঁরা সাঁওতালি ভাষাকে ‘ঠার' বলে ব্যঙ্গ করতেন। 'ঠার' অর্থে জন্তু জানোয়ার, পশুপক্ষীদের

ভাষা।

অ-সাঁওতালদের এই মানসিকতার ছাপ সাঁওতালদের প্রতি আচার-আচরণে, কথাবার্তায় প্রকাশ পেত। ফলে সাঁওতালরা হীনমণ্যতার শিকার হত। অন্যের সামনে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে তারা লজ্জা বোধ করত। তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মোটামুটি ভাবে বলা যায় সত্তর দশক থেকে সাঁওতালি চর্চার জোয়ার শুরু হয়। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় নীরব বিপ্লব ঘটে চলেছে। প্রায় শতাধিক কবি লেখক এই ভাষার সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। অসংখ্য পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রতি বছর গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যাও কম নয় যদিও কোন প্রকাশক সংস্থা এখনও গড়ে ওঠে নি।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য সাঁওতালি সাহিত্যে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ডঃ ডমন সাহু সমীর 'কে কেন্দ্রীয় সাহিত্য একাডেমীর পক্ষ থেকে ১৯৯৮ সালে 'ভাষা সম্মান' পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাঁওতালি চর্চার ক্রমবিকাশে এই পুরস্কার প্রদান অবশ্যই ঐতিহাসিক নজির। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছর সাঁওতালি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় প্রতিযোগিতা, ফেলোশিপ প্রদান ও মূল্যবান গ্রন্থেরও প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি সাহিত্য সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য গুণিজন সংবর্ধনা দেওয়া হত। ২০০২ সাল থেকে ‘সাধু রামচাঁদ মুরমু’ নামাঙ্কিত স্মৃতি-পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে নিয়মিত ভাবে ‘পছিমবাংলা’ নামে সাঁওতালি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে বিহার সরকারের তত্ত্বাবধানে ও আর্থিক সাহায্যে ‘হড় সম্বাদ' নামে পত্রিকা ১৯৪৭ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া বিহারের ভাগলপুর তিলকা মাঝি বিশ্ববিদ্যালয়, ঝাড়খণ্ড দুমকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়-এ স্নাতক, স্নাতকোত্তর বিভাগে সাঁওতালি ভাষার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সাঁওতালি ভাষার ডিপ্লোমা কোর্স। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যশিক্ষা পর্ষদ মাধ্যমিক স্তরে প্রথম ভাষা হিসাবে সাঁওতালিকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেছে।

পাশাপাশি ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কোলকাতার আকাশবাণী ও দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে এবং আকাশবাণী চাঁইবাসা, বারিপাদা থেকে নিয়মিত ভাবে সাঁওতালি ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। অপরদিকে বেসরকারী ভাবে যেমন সংস্থাগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগেও সাঁওতালি চর্চা প্রবল গতিতে এগিয়ে চলেছে।

ভারতবর্ষে ভাষার সংখ্যা হল ১১৪ টি। মাতৃভাষার হিসেব ধরলে দাঁড়ায় ২১৬ টি।

এ পর্যন্ত ১৮টি ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলি হল (১) হিন্দী (২) বাংলা (৩) তেলেগু (৪) মারাঠি (৫) তামিল (৬) উর্দু (৭) গুজরাটি (৮) কন্নড় (৯) মালায়ালাম (১০) ওড়িয়া (১১) পাঞ্জাবি (১২) অসমিয়া (১৩) সিন্ধি (১৪) নেপালি (১৫) কোঙ্কানি (১৬) মণিপুরি (১৭) কাশ্মীরি (১৮) সংস্কৃত।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৯১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ভারতবর্ষে ৫২,১৬,৩২৫ জন মানুষ সাঁওতালি ভাষায় কথা বলেন। এই জনসংখ্যার তুলনায় কমসংখ্যক  

মানুষ কথা বলেন এমন ভাষাকেও সংবিধানের অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন ১৯৯১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী সিন্ধ্রি ভাষায় কথা বলেন ২১,২২,৮৪৮ জন। নেপালি ২০,৭৬,৬৪৫ জন, কোঙ্কানি ১৭,৬০,৬০৭ জন, মণিপুরি ১২,৭০,২১৬ জন, কাশ্মীরি ৫৬,৬৯৩ জন এবং সংস্কৃত ৪৯,৭৩৬ জন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে অষ্টম তফশিলভুক্ত ছাত ভাষার তুলনায় সাঁওতালিতে বেশি সংখ্যক মানুষ কথা বলেন। এহেন প্রাচীন ভাষা, উন্নত ভাষা, বলিষ্ঠ সাহিত্যের ভাষা, ৫২ লাখেরও বেশি সংখ্যক মানুষের ভাষা সাঁওতালিকে স্বাধীনতার এত বছর পরেও সংবিধানের অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এ এক চরম পরিহাস। পরিশেষে, সাঁওতালির অন্তর্নিহিত সংকট সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। সাঁওতালরা দীর্ঘকাল যাবৎ ভারতের প্রধানত পাঁচটি রাজ্যে বসবাস করছেন। স্বভাবতই সাঁওতালি ভাষায় প্রাদেশিক ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার প্রভাব, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে হিন্দি, উড়িষ্যায় ওড়িয়া, অসমে অসমিয়া। সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার কম থাকায় ভাষার মৌলিকতা বিষয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করা হয়নি। ফলে সাঁওতালিতে বাক্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক ভাষার শব্দের বহুল ব্যবহার এসে পড়ে। পরবর্তীকালে, এঁদের মধ্যে শিক্ষার হার ক্রমশঃ বাড়তে শুরু করলেও ততদিনে সাঁওতালরা প্রাদেশিক ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, কারণ অ-সাঁওতালদের সঙ্গে 'লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা' ছিল প্রাদেশিক ভাষা। অবশ্য এই অবস্থা এখনও বর্তমান। দ্বিতীয়তঃ শিক্ষার মাধ্যম হয়ে পড়ে প্রাদেশিক ভাষা। পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালরা বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করার ফলে তাঁরা মাতৃভাষার পাঠ নিয়েছেন বাংলা লিপিতে। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসমের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ভাবে প্রাদেশিক লিপি এসেছে। পরিণাম স্বরূপ সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার যতই বাড়তে লাগল ততই তাঁরা প্রাদেশিক ভাষা ও লিপির দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে লাগলেন। এখনও যাঁরা শিক্ষিত এমনকি অশিক্ষিতরাও নিজস্ব ভাবের প্রকাশে সাঁওতালি ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক ভাষার শব্দের ব্যবহার ছাড়া করতে পারেন না। সাঁওতালি ভাষার উচ্চারণও অঞ্চ লভিত্তিক পৃথক। রাজ্যভিত্তিক উচ্চারণের প্রকৃতি আলাদা। যেমন আতো’- আতু’ (গ্রাম); দারে-দারি (গাছ);হাকো-হাকু(মাছ) ইত্যাদি অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ফলে Standard সাঁওতালি গড়ে ওঠেনি। বাংলা ক্ষেত্রে যে রকম অঞ্চ লভিত্তিক উচ্চারণ শব্দগত প্রভেদ লক্ষ্য করা গেলেও কোলকাতার বাংলাকে Standard বাংলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে একই ভাষার ব্যবহার হয় সাঁওতালির ক্ষেত্রে এমনটি নেই। শব্দগত উচ্চারণগত প্রভেদ থাকার জন্য সাঁওতালি ভাষার সমন্বয় ঘটেনি ফলে সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠেনি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ভিন ভিন রাজ্য বা অঞ্চ লের দু'জন সাঁওতাল আলাপচারিতার সময় ভাবগ্রহণকেই প্রাধান্য দেন, ফলে কথিত বাক্যের অর্থভাবের দ্বারা তাঁদের কাছে পরিষ্কার হওয়ায় শব্দ প্রয়োগের দিকে আর লক্ষ্য রাখা হয়।

এমনকি উচ্চারণগত তারতম্যের দিকেও খেয়াল রাখা হয় না। ফলে ভাষার নির্দিষ্ট Standard গঠনে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। ভাষার এ দিক নিয়ে ভাবনা চিন্তা প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। বাংলায় 'তুমি' সাঁওতালিতে 'আম'। 'আপনি' অর্থে সাঁওতালিতে অনেক দ্বিবাচক ‘আবিন’/ ‘আবেন' শব্দের ব্যবহার করেন। আবার 'আবিন / আবেন' শব্দ বিশেষ সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ বলেন, যে কোন সম্মানীয় ব্যক্তিকে হোক না অপরিচিত আপনি অর্থে ‘আবিন’/‘আবেন’ শব্দে সম্বোধন করা হলে সম্মান জানানো হয়। আবার অনেকে বলেন, ওই সম্মানিত ব্যক্তি বা অপরিচিত ব্যক্তিকে আপনি অর্থে ‘আবিন’ / ‘আবেন’ শব্দে সম্বোধন করা অনুচিত কারণ ওই শব্দের দ্বারা বিশেষ সম্পর্কের আত্মীয় বোঝায়। কেউ বলেছেন, একক ব্যক্তিকে দ্বিবাচক শব্দে সম্বোধন যুক্তিযুক্ত নয়। আবার কেউ কেউ বলছেন, ইংরেজি you শব্দের মত শুধু ‘আম’ শব্দের ব্যবহার হোক। এতেও অনেকের আপত্তি কারণ ‘আম’ শব্দ ‘তুমি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এতে সম্মানীয় ব্যক্তিকে অসম্মান জানানো হয়। আবার অনেকে মনে করেছেন, ইংরেজি you শব্দের ব্যবহারে যেমন কেউ অসম্মান বোধ করেন না তেমনি “আম’ শব্দের ব্যাপক ব্যবহার হলে এতেও কেউ অসম্মান বোধ করবেন না। যাইহোক, এ নিয়ে সাঁওতাল বুদ্ধিজীবি মহলে বিতর্কের শেষ নেই। তবে এর সমাধান অবশ্যই প্রয়োজন কেন না এতে ভাষার ব্যবহারিক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। Standard সাঁওতালি নির্মাণে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হচ্ছে। জীবিকার স্বার্থে প্রচুর সাঁওতাল শহরমুখী হয়েছেন। অনেকে আবার স্থায়ীভাবেও বসবাস করছেন। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের পর থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাঁরা শহরে রয়েছেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা সাঁওতালি শেখা থেকে দূরে থাকছে বা তাদের দূরে রাখা হচ্ছে পরিবেশগত কারণে। প্রাদেশিক ভাষাই এই সব শহুরে ছেলেমেয়েদের কাছে মাতৃভাষার মত। মাতৃভাষা এদের কাছে অপাংক্তেয় ভাষা। এই প্রজন্মের শিশুরা যারা আগামীদিনের ধারক ও বাহক তারা কিন্তু সাঁওতাল সংস্কৃতি তো দূরের ব্যাপার ভাষাটুকুও শিখছে না বা তাদের শেখানো হচ্ছে না। সুতরাং এই প্রজন্মরা বড় হয়ে সাঁওতালি ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হবে কিংবা তাদের মাতৃভাষা বোধ কতটা থাকবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। অপরদিকে গ্রামাঞ্চ লের সাঁওতালরা যারা দু'বেলা দুমুঠো ভাতের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তাঁদের মধ্যেই বা তাঁদের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমেই ভাষার মৌলিকতা বজায় থাকবে। এঁদের কাছে বেঁচে থাকবে অথচ এঁরা ভাষা বিকাশে অক্ষম। সাঁওতালি ভাষা চর্চা ও বিকাশের এই সঙ্কট বিষয়েও ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি Standard নির্মাণ বিষয়েও কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি মহলের সচেতনতার প্রয়োজন আছে।



তথ্যসূত্র :-

(1) Santali : Base of World Language - Parimal Mitra 

(2) The Santals and their Ancestors - D. Barka Kisku - ডঃ অতুল সুর 

(3) বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস

(4) সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – ধীরেন্দ্র নাথ বাসকে

(5) শতাব্দীর সাঁওতাল সম্প্রদায় পরিমল হেমব্রম

(6) সংবাদ প্রতিদিন-এর অতিথি' কলম।

(7) লাহান্তি পত্রিকা ।


আদিবাসী গুরুরাও দুঃখবাদ স্বীকার করেছেন। বেশী করে আদিবাসী গুরুরা বিষাদ যোগী। সাঁওতালদের গুরু স্তব বা স্তুতি থেকে জানা যায় দুঃখ নিবৃত্তির কথা। স্তবে আছে যেখানে হায় আছে সেইখানেই গুরুর নাম উচ্চারণ। তার অর্থ দুঃখ হলেই গুরুর শরণাপন্ন হওয়া, এই কথা বিশেষভাবে ঘোষণা করেছেন। গুরুর শিষ্যের কথপোকথন প্রশ্ন উত্তর ঢং-এ বহু স্তব-স্তুতি আছে। সাঁওতাল গুরুর স্তব-স্তুতিকে দাঁশায় সেরেঞ বলা হয়। দাঁসায় হয়তো দুক ধাসাও অর্থাৎ দুক বা দুঃখ ধ্বংস করার গান। দুঃখ নিবৃত্তির গান। দুখ ধাসাও থেকে দাঁসায় কথা এসেছে বলে মনে হয়।

দাঁসায় গান : হায়রে হায় হায়-

লুগু বুরুরে বিদিম তল কিদিঞ ঘাণ্টা বাড়েরে বিদিম হাড়ি কিদিঞ। চেলে মেনায়তে বিদি তল দয় বাড়ায়া । চেলে মেনায়তে বিদি হাড়ি দয় হঁসরা। মেনায় মেনায় ধরম গুরু হায়তে হায় মেনায় মেনায় ধরম চেলা হায়রে হায়। উনকিন গেচ তল কিন রাড়ায়া হায়রে হায়, উনকিন গেচ হাড়ি কিন হঁসরা হায়রে হায়।

অর্থ : ইহা বিখ্যাত গান। গানে বলা আছে, হে বিদি মানে হে মাকড়সা। তুমি আমায় লুগু বুরুতে বাঁধলে অর্থাৎ সুখে আচ্ছন্ন করে রাখলে। মাকড়সা এখানে মনকে বলা হচ্ছে। হে মন মাকড়সা ঘাণ্টা বাড়িতে অর্থাৎ এই সংসারে আমাকে বন্ধন করলে। কিভাবে বন্ধন সরাব কি ভাবে খুলব। উত্তরে বলা আছে সে তোমার সংসার বন্ধন আলগা করে দেবে বা হসর করে দেবে। হায় হায় ধরম গুরু, ধরম চেলা বন্ধন থেকে মুক্ত করবে।

মর্মার্থ : সুখ ও বন্ধন। সুখে মানুষ আসক্ত হয়, পরিণামে জ্ঞানের লোপ পেতে পেতে দুঃখ আসতে থাকে। সংসারে যাহা চঞ্চল করছে, নানা কামনায় বাসনায় মমতা দিতে বদ্ধ করছে। দুটোই বন্ধন দুঃখেরই হেতু। মনই বন্ধনের কারণ। দুঃখ তা থেকেই আসে।


Post a Comment

0 Comments