ওরাওঁদের কারাম পরব
খেরোয়াল গোষ্ঠীর ধর্মচেতনাব সহিত হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক গভীর। বর্তমানে বাঙ্গায় আগত দ্রাবিড় জাতির প্রধান শাখা ওরাওঁদের কারাম পরব বিষয়ে আলোচনা করব।
দ্রাবিড় গোষ্ঠীর যত প্রকার শাখা প্রশাখা উপজাতি হিসাবে আছে তাদের মধ্যে ওরাওঁরা একক গোষ্ঠী হিসাবে প্রধান। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে ওরাওঁদের সংখ্যা ২,৯১,১৭৩ জন (Das & Saha, West Bengal Scheduled Caste and Scheduled Tribes, ১৮৮৯) এই রাজ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসাবে সাঁওতালদের পরেই ইহাদের স্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয় অতি অল্পই সংখ্যক ওরাওঁ মাতৃভাষা কুরুখ ব্যবহার করেন।
ওরাওঁ শব্দটি প্রাচীন কৃষিজীবি ‘ওড্র’ জাতির আধুনিক নাম। উড়িয়া ভাষার মান শব্দ বহু বচনাত্মক। ওড্রমান অর্থাৎ ওড্রগণ। ওড্রমান পরে ওরাওঁতে পরিণত হয়।
ওঁরাও অতি প্রাচীন ও শক্তিশালী জাতি। সুসভ্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গঠনে এই জাতির অবদান সর্বাধিক। প্রচীন পুস্তকাদিতে ইহারা অড্র নামে খ্যাত। সমগ্র ওড়িষ্যার নাম (ওড্র দেশ : ওড়িশা) ওড্র জাতির সহিত সংযুক্ত। ওড্রগণ কৃষি সম্ভার লইয়া বিহার ও বহু জায়গায় ছড়াইয়া পড়ে এবং দ্রাবিড় ভাষা ভুলিয়া স্থানানুসারী ভাষা গ্রহণে বাধ্য হয়।
অনেকের মতে ঝাড়খণ্ড অঞ্চ লের কিষাণ সম্প্রদায় ওড্রগণেরই সর্বশেষ পরিণতি। Rev. Han's সংগৃহীত Oranon Folk Lore পুস্তকের (Government Printing, Patna 1931) সম্পাদক Rev. Grignard ভূমিকায় বলিয়াছেন— "At some unknown period and from unknown causes, a splite seems to have occured it the tribe, How ever this may be, we are today in presence of three main bodies of Oraons the Nagourias the Kisans and the Dhankas. নাগপুরিয়া ওঁরাওরা ছোটনাগপুরকে কেন্দ্র করিয়া বসবাস করিতেছেন এবং নাগপুরিয়া বা সারি ভাষা বেশি ব্যবহার করেন। কুরুখ অপেক্ষা সারি ঐ অঞ্চ লের নিত্য প্রয়োজনীয় ভাষা— যোগাযোগের ভাষা। গত একশত বৎসর ধরিয়া সুন্দরবনে সর্দার, মোড়ল (মন্ডল) সিং প্রভৃতি উপাধি লইয়া যে সমস্ত ওঁরাও ক্রমাগত জঙ্গল সাফাই কাজে যোগ দিতেছে তাহারা অপরাপর আদিবাসীদের সহিত সম্পর্কের জন্য প্রথম স্তর সদ্দারি বা নাগপুরিয়া ও বর্তমানে বাঙলা ব্যবহার করিতেছেন— ও
বাঙালি কৃষিজীবী সম্প্রদায়ে পরিণত হইয়া যাইতেছেন। আবার উড়িষ্যার ওঁরাওগণ উড়িয়া ও কুরুখ ভাষা ব্যবহার করেন।
Historicity of Lord Jagannath Sushil Mukherjee পুস্তকের লেখক (Calcutta 1889) বলিতেছেন Odisa is the Oriya synonym of Odradesa. The name signifies that the area was inhabited by the oboriginal people know as Odras/Udras, Numerically this Odratribe is almost extinct, they have mostly merged with the Hindu mainstream. A few who still prefer to call themselves Odras are tilling land at Dhankanal and near about pleaces (Pages-4)
আমার মনে হয Rev. A Grignard. Sj. যে তিন প্রকার ওঁরাও কথা বলিতে গিয়া ঢেঙ্কা ওঁরাওদের কথা বলিয়াছেন। তাঁহাদের সহিত ঢেঙ্কানলের ওড্রগণের সম্পর্ক নিশ্চয় রহিয়াছে।
কৃষির উন্নতির সহিত এই ওড্রজাতি আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার চরমে উঠিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রাচীন পুস্তকাদিতে ইহাদের গৌরব গাথা লিখিত আছে। "As this area was known after them, it can be assumed that in accient days they were a powerful tribe”. (উক্ত পুস্তক। পৃঃ-৪)
মনে হয় মেদিনীপুরের কিষাণ বা কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বিরাট একটি অংশ আদিতে ওড্রই (ওরাঁও) ছিল। তাহারা মাহিষ্য, কৈবর্ত, সদগোপ, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয়, নমঃশূদ্র প্রভৃতি জাতির মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া হারাইয়া গিয়াছে। আমি আমার Direct Dravid words in Midnapore Dialect নামক প্রবন্ধে (Oriental Conference, 1980, এ পঠিত, Indian Flok Lore, 83 মাসিক পত্রিকায় এবং Cultural Research Institute এর Bullatin, 83 মুদ্রিত) এই সত্য প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা করিয়াছি।
যাহাই হউক হাজার বছর পূর্বে যে সমস্ত ওঁরাও বাঙলাদেশে আসিয়া আমাদের রক্তে মিশিয়া গিয়াছেন তাহাদের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ওঁরাওর সংখ্যা নিতান্ত কম নহে; সমস্ত ভারতের ওঁরাও জাতির ২০ ভাগের বেশি। বাঙলার কোমল মাটিতে ইহাদের কুরুখ ভাষা আর কত দিন টিকিয়া থাকিবে বলা শক্ত। তবে ইহাদের কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আদিম স্বভাব থাকিয়া গিয়াছে। নীচে ওরাঁওদের কারাম পরব সম্বন্ধে একটি সমীক্ষা দেওয়া গেল। এই বিবরণ হইতে আমাদের হিন্দু সনাতন ধর্মের কোথায় কী সম্পর্ক তাহা সহজে বোঝা যাইবে।
ওরাওঁদের কারাম পরব
আমাদের ওরাঁও বন্ধু মংগরা কুজুরের আহ্বানে তাঁহার গ্রামে কারাম পরবে যোগ দিতে আমি ও শ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিক বন্ধু শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে উপস্থিত হইলাম। রাঁচি হইতে দূরে গুমলার এক পাহাড়ি গ্রাম হইতে ইহারা উঠিয়া আসিয়াছেন।
কারাম পরব ঝাড়খণ্ড অঞ্চ লের প্রধান শস্যোৎসব। সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, খেড়িয়া, কিষাণ, ওরাঁও সমস্ত সম্প্রদায়ই কারাম পরব পালন করে। কারামের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। নেতারহাটের কিষাণদের মতে কারাম হইল তাঁহাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব, আবার ডালটনগঞ্জে চেরোদের গ্রামে কারাম পরবের বাড়াবাড়ি দেখিয়াছি। কিন্তু কারাম লইয়া যে পুরাণ প্রচলিত আছে তাহা সকলের মধ্যে কমবেশি সমান।
যাহাই হউক কুজুর বাবুর পাড়ায় আসিয়া দেখিলাম মহা সমারোহে কারাম ডালকে আহ্বান জানাইতে অসংখ্য স্ত্রী পুরুষ উপস্থিত হইয়াছেন।
পুরুষরা যখন কারাম ডাল আনিলেন ব্রতিনীরা তাহাকে বরণ করিলেন। সুসজ্জিত ডালিতে ঘটি জল, আতপ চাল, শসা (শস্য বা সন্তানের প্রতীক), আম শাখা, সিঁদুর, ধূপ ও প্রজ্জলিত প্রদীপ শোভা পাইতেছে। সুসজ্জিতা রমণীরা বরণ ডালা যেমন হাতে রাখে তেমনি সেই ডালি হাতে রাখিয়াছেন। কারাম পূজার সহিত প্রত্যক্ষভাবে যাঁহারা জড়িত তাঁহারা সকলেই উপবাস দিয়াছেন। পূজার শেষে তাঁহারা খাইবেন।
আমরা অতিথি হিসাবে কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম। কারাম ডালকে মহা সমারোহে মাদল বাজাইতে বাজাইতে মঞ্চে আনিলে আমরা সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলাম। কারাম বরণ করিবার জন্য আমরা পূর্ব হইতে অঙ্কুরিত যবের বীজ হাতে রাখিয়াছিলাম। তাহা দিয়াই কারাম দেবতাকে বরণ করিলাম।
তিনটি করম ডাল আনিয়া পূজার মঞ্চে পোঁতা হইল। পূজার সময় ফুলের ব্যবহার দেখিলাম না। অঙ্কুরত যবের বীজকেই ফুলের মত ব্যবহার করা হয়। ওরাঁওদের দৃষ্টিতে কারাম দেবী বা কারাম মাতা। কিন্তু হো ভাষার একটি গানে কারাম রাজা হিসাবে দেখিয়াছি। প্রতিষ্ঠার পর সারারাত ধরিয়া কারামকে লইয়া গান চলিল ।
সাঁওতালদের কারাম পরবে দেখিয়াছি—পুরুষদেরই প্রাধান্য। এই অনুষ্ঠানে মেয়েদের বিশেষ ভূমিকা নাই। কিন্তু ওরাঁওদের কারাম পরবে রমণীর যথেষ্ট স্থান আছে।
যিনি পুরোহিতের কাজ করিবেন তাঁহার নাম গঁসাই লাকড়া। পূর্ব হইতেই তাঁহার কুটির ছাঁচ দিয়া নিকানো ছিল। তাঁহার বাড়ির দাওয়ায় “ডাণ্ডা কাটনা” অনুষ্ঠান পরের
দিন অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধুবর কুজুরের মতে 'ডাণ্ডা কাটনা কারাম ব্রতের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান এবং সংকেতপূর্ণ।
আতপ চালের সাদা গুঁড়ি, লালমাটি ও কয়লার গুঁড়া দিয়া আল্পনা আঁকিয়া তাহার কেন্দ্র স্থলে একটি ডিম রাখা আছে। একটি ছোট ভেরোয়া গাছের ডাল মাথার দিকে দুইটি শাখা এক সঙ্গে আকর্ষির মত বাহির হইয়া গিয়াছে। দ্বিধা বিভক্ত দুইটি ডালের মধ্যস্থলে অর্থাৎ তেডালের মাথাটি ডিমকে আকর্ষণ করিয়া আছে। গঁসাই লাকড়া, পুরোহিতদের মত অঙ্গভঙ্গী সহকারে সকলের মঙ্গল কামনায় দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচারণ করিলেন। শস্যের জন্য প্রার্থনাই সর্বাধিক।
আমি বন্ধুবর কুজুরকে জিজ্ঞাসা করিলাম এই ডিম ও তেডালা ভেরোয়া ডালের তাৎপর্য কী। তিনি বলিলেন, ঐ ডিম ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক আর ভেরোয়া গাছের পাতা তেতো। ইহাতে সহজে পোকা লাগে না। পোকার দ্বারা আক্রান্ত না হইয়া যাহাতে উৎপাদন অব্যাহত থাকে তাহারই প্রার্থনায় এই প্রতীকোপাসনা ।
পরে কিন্তু আমার এই বিষয়ে অন্য ধারণা জাগে। ঐ তে-ডালের কেন্দ্রস্থল হইল স্ত্রীলিঙ্গের প্রতীক। ঐ ডিম উর্বরা শক্তির প্রধান উৎস। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার উৎসগুলির প্রধান শাখা দ্রাবিড় সংস্কৃতিতে লিঙ্গ পূজার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট পরিমাণ ছিল। মনে হয় সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কৃষিভিত্তিক দ্রাবিড়দের মধ্যে লিঙ্গ ও যোনি পূজা আনেকখানি হ্রাস পায়। কিন্তু উপজাতি গোষ্ঠীর প্রধান দ্রাবিড় শাখা ওরাঁওদের মধ্যে কোথাও কোথাও সেই আদিম চেতনা প্রচ্ছন্নভাবে টিকিয়া আছে। সুন্দরবন অঞ্চ লে যে সমস্ত ওরাঁও দুই তিন পুরুষ বাস করিতেছেন, তাঁহারা কিন্তু ডাণ্ডা কাটানের কিছুই জানেন না। আবার খেরোয়াল গোষ্ঠীর বিচিত্র শাখায় বিশেষতঃ সাঁওতাল, মুণ্ডা হো গণের কারাম পরবে ডাণ্ডা কাটানোর কোনো স্থান নাই।
শিবলিঙ্গ ও শক্তির পূজা fertility cult বা উর্বরা শক্তির পূজার প্রতীক। আমরা অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি—মারাবুরু (মহা+দেব) বা শিবের ধারণা খেরোয়াল গোষ্ঠী হইতে হিন্দু সমাজে আসিলেও লিঙ্গ পূজা সিন্ধু সভ্যতার সময় হইতে উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসাবে দ্রাবিড়ের নিকট হইতেই আসিয়াছে। কি করিয়া এই দুইটি ধারণা হিন্দু মঞ্চে (Platform) আসিয়া একাকার হইয়া গেল সে বিশদ আলোচনার এখানে অবকাশ নাই। শুধু বলা যায় দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রধান শক্তিশালী আদিবাসী শাখা ওরাঁওদের মধ্যে সেই উর্বরাশক্তির প্রতি যে দুর্বলতা প্রবাহিত থাকিবে তাহাতে সন্দেহ নাই।
এই বৎসর ভবিষ্যতে কি রকম চাষবাস হইবে জানিতে চাহিলে, ছোটো পাশাখেলার গুটির মতো তিনটি দ্বিধা বিভক্ত ডাল গঁসাই লাকড়া পাশা খেলার ভঙ্গিতে মাটিতে ফেলিয়া দিল। দুইটি চিৎ ও একটি উপুড় হইয়া পড়িল। গঁসাই লাকড়া কহিলেন, এ বৎসর সমস্ত কিছুই শুভ। আমার মনে হয় ইহার পশ্চাতেও আদিম যুগ হইতে সৃষ্টি বিষয়ক উর্বরা শক্তি চিন্তা বা fertility cult-এর ধারণা লুক্কায়িত আছে। চেরাই টুকরার চিৎ হইয়া পড়াকে যদি মাতৃকাশক্তির প্রতীক ধরা যায় তবে শস্যোৎপাদনের পক্ষে তাহা নিশ্চয়ই শুভ। আমরা অষ্টাক খেলায় বা কড়ি খেলায় জানি, চিৎ হইয়া পড়িলে গুটি প্রতি এক দান ও উপুড় হইয়া পড়িলে গুটি প্রতি দুই দান ধরা হয়। এখানে কিন্তু তাহার বিপরীত হইল।
যাহা হউক, এই ডাণ্ডা কাটান অনুষ্ঠানের সর্বশেষ স্তর হইল ডিমটিকে দা দিয়া ভাঙিয়া ডিমের কুসুম সমেত তরল পদার্থ সেখানে রাখা আতপ চালে ঢালিয়া দিয়া তাহা মাখাইয়া তৈয়ারী করা। মন্ত্রোচ্চারণ করিতে করিতে এক একটি পিণ্ড দলা পাকাইয়া এক একটি শ্লোকের শেষে কারাম দেবতার নামে ঐ আল্পনার কেন্দ্রস্থলে উৎসর্গ করা।
কারাম দেবতাকে বিদায় দিবার মুহূর্ত্তটি বড়ই মর্মস্পর্শী। হিন্দুদের পূজার বিসর্জনের মত। গঁসাই লাকড়া বাসি পূজা সারিয়া কারাম ডালগুলিকে উপড়াইয়া ফেলিলেন। তাহার পর অল্পবয়সী সুসজ্জিতা তিনটি মেয়ের হাতে কারাম সমর্পণ করা হইল। সমবেত মহোদয়রা ও আমরা সকলেই পুরোহিতের পূজা মণ্ডপের দিকে আতপ চাল ছিটাইয়া দিলাম। তাহার পর গ্রামের সকলে দল বাঁধিয়া সমারোহে নিকটবর্তী জলাশয়ের দিকে বিসর্জনের জন্য পুনরায় প্রদীপোজ্জল করিয়া সাজাইলেন । তাহার পর দল বাঁধিয়া সমস্ত গ্রাম মহা সমারোহে নিকটবর্তী জলাশয়ের দিকে বিসর্জনের জন্য চলিলেন। অত্যন্ত ধীর গতিতে অগ্রসর হইয়া মাঝপথে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়া দাঁড়াইল। সেখানে সকলে তাহাদের শেষ প্রার্থনা কারাম দেবতার নিকট চাহিয়া লইলেন। তাহার পর ধীরে ধীরে কারাম ডালগুলিকে জলে বিসর্জন দেওয়া হইল। বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অর্ধেক গ্রাম হুমড়ি খাইয়া জলে পড়িয়া গেল।
কুজুর সাহেবের পাড়ায় আসিয়া দেখি, কাহারো কাহারো বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনেরা বিশেষতঃ ঝিউড়ি মেয়েরা শৈশবের পিতৃগৃহ ছাড়িয়া বাড়ি ফিরিবার জন্য বিজয়ার সুরে প্রস্তুত হইতেছেন। আমরাও সেই মিছিলে যোগ দিলাম।
রাঁচির গুমলা অঞ্চ লের ওরাঁওদের মধ্যে প্রচলিত কারাম পরবের রীতি-নীতি বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। তবুও ঐ ওরাঁওদের মধ্যে কারাম পরব পালনে বাহ্যিক কোনো পার্থক্য আছে কিনা দেখিবার জন্য আমি পুনরায় এই বৎসর (১৯/৯/৯১) কুজুর সাহেবের পাড়ায় যাই। গত বারের তুলনায় সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করিলেও পরবের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কিন্তু এক। বহু অতিথির সহিত Cultural Research
Institute-এর দুই বন্ধু, মিঃ চক্রবর্তী এবং আলোক চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাঁহাদের নিকট পূর্ব হইতেই বলিয়াছিলাম কি ভাবে একটি শস্যোৎসব পুরোহিত চালিত দেবপূজায় পরিণত হইতেছে। এবার দেখিলাম সাজাইবার জন্য ফুলের যথেষ্ট ব্যবহার হইয়াছে। গত বৎসর ফুল ছিল না বটে কিন্তু হিন্দুদের পূজার মত কলাগাছ ছিল। ঘট বা লোটার জলের উপর আম পাতার ডালি দিয়া তাহার উপর ডাব রাখা হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলে জানা গেল পূর্বে ডাবের ব্যবহার ছিল না। ফুল সম্বন্ধে কুজুর সাহেব কহিলেন, জাওয়া পুঁফ্ বা যবের অঙ্কুরিত অবস্থা এই পূজার প্রধান ফুল। শুক্ল পক্ষের তৃতীয়ার দিন যব ভিজাইয়া হাঁড়িতে বালি দিয়া রাখিয়া দিতে হয়—যাহাতে সূর্য কিরণ না লাগে। মাঝে মাঝে হলুদ জল ছিটাইয়া দিতে হয়। জাওয়াঁ পুফ্ ছাড়া অন্য ফুল ব্যবহারে বাধ্য- বাধকতা আছে কিনা জানিতে চাহিলে তিনি একটি পুরাতন গান গাহিলেন—
পুফ্ তখা কেআন্ আয়ো
পুষ্প তুলিতে গিয়াছি মাগো
ঝারিয়া ঝারিয়া কেরা
ঝরনার ঝরনায় গিয়াছি
কুল কিড়া আম অনকা
ক্ষুধা পাইয়াছে জল পিপাসাও
ঝারিয়া ঝরনায় কেরা
ঝরনায় ঝরনায় গিয়াছি।।
অর্থাৎ ঃ ফুল তুলিবার জন্য মাগো আমি কত যে ঝরণার ধারে গিয়াছি। কিন্তু পাই নাই। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইয়া ঝরণার ধারে ধারে গিয়াছি (তবু পাই নাই)। এই গান হইতে আমরা অনুমান করিতে পারি পূর্ব পুরুষগণ এই পরবে পুষ্পের অপ্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সচেতন ছিলেন।
সকালে ডাণ্ডা কাটান অনুষ্ঠানে গঁসাই লাকড়া কহিলেন—এবার ঠিক মত ভেরোডা ডাল পাওয়া যায় নাই। দেখিলাম, প্রায় দেড় ফুট কঞ্চি র মত একটি ভেরোয়া ডাল দিয় সেই দ্বিধা বিভক্ত প্রান্তটিকে ফাঁক করিয়া দিল। ফলে ডালের প্রান্তটি একটি সূক্ষ্মকোণী ত্রিভুজ বা ‘ব’-এর আকার ধারণ করিল। তাহার পর ঐ ত্রিভুজটিকে একটি ডিমের সহিত স্পর্শ করিয়া রাখিয়া দিল। ডাণ্ডা কাটানোর বাকি অংশ গত বৎসরের মতো।
ভেরোয়া ডালের জনপ্রিয়তা বহুদূর পর্যন্ত। শুধু তাহা নহে—এই অনুষ্ঠানের সময় কাশ ফুলের গুচ্ছ তুলিয়া আনিয়া রাখিতে হয়। পরে চৈত্র মাসে বাতাসে তাহা উড়াইতে হয়। বুদ্ধ গয়ায় আদি মন্দিরের অদূরে তারিডি গ্রামের বিশাল হরিজন পল্লীতে যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে রামজী (কিষাণ) হরিজনের নিকট দুইটি করমা গীত বা কারাম গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। তাহাদের একটিতে ভেরোয়া ও কাশফুলের কথা আছে। হরিজন হিসাবে পরিচিত হইলে ইঁহারা সর্বদা নিজদিগকে কিষাণ বলিয়া পরিচয় দেয়। আমার মনে হয় ওরাঁওদের তিনটি শাখার প্রধানটি হইল কিষাণ। ইহাদের প্রধান জীবিকা কৃষি। এবং বুদ্ধ গয়া অঞ্চ লের কিষাণগণ সম্ভবতঃ ওরাঁও সম্ভূত।
নৃবিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র রায় মনে করিতেন ‘কুরুক' শব্দের সহিত কৃষির যোগ আছে। কৃবা ঞ ধাতু কর্ম বা কৃষিকর্মের উৎস। বাঙলার বাহিরে ‘ঋ’ ধবনি ‘রু’-এর মত উচ্চারিত হয়। ঋণকে রুণ, অনৃতকে (অদ্ভুতাঞ্জান) বলা হয়। ফলে রু ধাতু ক্রু ও পরে স্বরভক্তি বা মধ্য স্বরাগম হইয়া কুরু। এই কুরু বা কৃষি কর্মের সহিত যাহারা যুক্ত তাহারা কুরুখ, কুডুখ বা কৃষক বা কিষাণ নামে পরিচিত হয়। কুরু ধাতুর সহিত ণক প্রত্যয়যোগে কুরুক আসিয়াছে যেমন কৃ + ণক = কারক অর্থাৎ যে করে। কুরুক শব্দ বিষয়ে পূর্বে এত ভাবি নাই। এখন মনে হয় কুরুক বা কুড়ুখ শব্দের মৌলিক অর্থ হইল কিষাণ অর্থাৎ কৃষি কারক বা কৃষি কুরুক।
‘ওরাঁও কবিতা” নামক কাব্যগ্রন্থের কবি শ্রীযুত বিজয় কুমার এক্কা তাঁহার প্রকাশিত পুস্তকটি কিছুদিন পূর্বে আমার নিকট ডাকযোগে পাঠাইয়াছেন। কবির সহিত এখনও আমার পরিচয় হয় নাই। তবে পুস্তকের ভূমিকা বা উইজী পড়িয়া মনে হয় প্রাচীন সুসভ্য কৃষিকর্মে নিপুন বিশাল দ্রাবিড় গোষ্ঠীর উড্র দেশের অধিবাসীদের ওরাঁও বা উড্রমান নামে চিহ্নিত হইয়া কৃষিকর্মের প্রসারের জন্য বিচিত্র প্রদেশে গমন এবং সেই অঞ্চ লের কৃষিজীবী সম্প্রদায় গঠনে ইহাদের ভূমিকা এবং আঞ্চ লিক ভাষা গ্রহণ করিয়া বৃহৎ ভারতীয় জন সমুদ্রে নিজদিগকে বিলীন করিয়া নিবার প্রবণতার স্রোতধারাটিকে তিনি প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। জঙ্গল সাফ করিয়া সুন্দরবনের কৃষিকর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ওরাঁওদের আগমন এখনো অব্যাহত আছে। তাই তিনি পুস্তকের উইজীতে বলিতেছেন—
“ওরাঁও ভাষা পরিবার কেন্দ্রিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে কেননা ওরাঁও ভাষাভাষী মানুষ অধিকাংশই কৃষিজীবী। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে বিভিন্ন জায়গা যেতে হয়। অধিকাংশ সময় কাটে ঘরের বাইরে। তঁহারা খুবই কম সময় পান নিজেদের ওরাঁও (কুডুখ) ভাষায় কথা বলিবার। এই রকম চলিতে থাকিলে ওরাঁও ভাষা একদিন বিলুপ্ত হইয়া যাইবে।
কৃষিভিত্তিক দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ওরাঁও সমাজের কারাম পরব মূলতঃ উর্বরা শক্তিকে আহ্বান করিবার উৎসব। খেরোয়াল গোষ্ঠীর কারাম পরবের সহিত শুধু পার্থক্য নয়,
নারীর ভূমিকা বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করিয়াছি। ওরাঁওদের কারাম পরবে পুরুষেরা ডাল কাটিয়া আনিয়া প্রতিষ্ঠা করে সত্য তবে নারীকে প্রাধান্য দিতে হয়। কুমারী বালিকারাই ভাসানের দিন “দে দে আয়ো তেলা পূর্ণতা সিঁদুর” সাদরি ভাষায় এই গান গাহিতে গাহিতে কারাম ডাল বহন করিয়া আনিয়া জলাশয়ে বিসর্জন দেয়। বিসর্জনের পদ্ধতিও খেরোয়াল গোষ্ঠী হইতে পার্থক্য লক্ষিত হয়। সাঁওতালগণ পেছন করিয়া কারাম ডাল বিসর্জন দেয় (কিন্তু সর্বত্র নহে। দ্রঃ খেরোয়াল বংশা ধরম পুথি।) কিন্তু ওরাঁও কুমারীরা সামনের দিকে মুখ রাখিয়া বিসর্জন দেয়।
ওরাঁও জাতির সহিত কৃষিকর্মের প্রসারের ইতিহাস জড়িত। পালামৌ অঞ্চ লের কিষাণরা মূলতঃ ওরাঁও ছিলেন। পালামৌ নামটি দ্রাবিড় গোষ্ঠীর একটি প্রাচীন শব্দ হইতে আসিয়াছে। ইহার অর্থ হইল প্রান্তর বা বিস্তৃত ক্ষেত্র। যাযাবর কাকমারাদের ভাষায়, পালামু' শব্দের অর্থ হইল field বা মাঠ (Direct Draid Wrokds in Midnapur Dialect, Bulletin, Culture Research Institute, Vol. XV, Number 1 & 3, 1982) ছোটনাগপুরের পাহাড় ঘেরা বিস্তৃত যে সমতল ক্ষেত্র কৃষির উপযুক্ত তাহাই ‘পালা—মু’নামে পরিচিত। ঠিক এমনভাবে খেরোয়াল গোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা রাঁচি শব্দের ব্যবহার হয়। রাঁচি শব্দ মূলতঃ রাচা হইতেই আসিয়াছে। ইহার মৌলিক অর্থ হইল সমতল প্রাঙ্গণ—ছোটনাগপুরের মালভূমি সমতল ক্ষেত্র।
0 Comments