আদিবাসী/মূলবাসীরা কী বাঁচবে?

আদিবাসী/মূলবাসীরা কী বাঁচবে?



ছ্যাক।' ভারতের মূলবাসী / আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য এত বিপুল যে তা সময়ের সঙ্গে তাল মিেিয় চলতে কোথায় যেন হোঁচট খাচ্ছে। কিন্তু মজার কথা হলো এই গতিশীল ও প্রবাহমান সংস্কৃতি কি ভাবে আজও বহতা, কিংবা এদের তেজ ও বিক্রম আজও সমান ভাবে উষ্ণ ও তীব্র ভাবাবেগের মধ্যে রয়েছে, তা আশ্চর্য্য করে আজকের সমাজবিজ্ঞানীদের।

মজার কথা হলো আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার বা ভারত সরকার স্বীকার করেন না যে ভারতে কোন মূলবাসী বা আদিবাসী মানুষ থাকেন। ১৯৯৩ সালে World Council of Indigenous People বা বিশ্ব মূলবাসী মানুষের সভাতে যা I. L. O. বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন দ্বারা স্বীকৃত। যেখানে ভারত সরকারের চিরস্থায়ী সদস্য ঘোষণা করেন যে ভারতে কোন আদিবাসী নেই। তাঁর বক্তব্য ছিল যে ভারত সরকারের সংবিধান অনুসারে ভারতে তপশিলী উপজাতি বা সিডিউল ট্রাইব আছেন, কিন্তু কোন Indigenous জনগোষ্ঠী নেই। সেই সময় ভারতের মূলবাসী ও আদিবাসী সমাজ সংগঠনের পক্ষে অধ্যাপক অমিয় কুমার কিস্কু, অধ্যাপক রামদয়াল মুন্ডা, জেনেভার উক্ত বিশ্ব সম্মেলনে দাবী করেছিলেন যে ভারতের তপশিলী উপজাতি তথা তপশিলী বা তালিকার বাইরে থাকা বহু গোষ্ঠীর মানুষ ভারতের মূলবাসী।

অন্যদিকে ২০০২ সালে আগষ্টের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্য্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি বিশ্ব সম্মেলন হয়ে গেল। তাতে ভারতের বহু দলিত তথা মূলবাসী মানুষের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়েছিল ভারতের বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল যে দলিত বহুজন তথা মূলবাসী ভারতীয়দের প্রতিনিধিরা বিশেষতঃ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা চাইছিলেন যে ভারতে caste বা জাতি গোষ্ঠীগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্য যাতে মূল সরকারী দলিলে বা official document এ cast বা জাতি গোষ্ঠীকে ঢোকানো যায়। কিন্তু এবারও ভারত সরকারের প্রতিনিধি এবং ভারতের বিশিষ্ট দলিত লোকসভার সদস্যরা এর বিরোধিতা করেন। ভারতের রিপাবলিকান পার্টির আতাউলে এবং প্রকাশ আম্বেদকর সহ ভারতীয় জনতা পার্টির বঙ্গারু লক্ষ্মণ এই ব্যাপারে মোটামুটি নীরবতা পালন করেন।

কিন্তু ভারতের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলির হয়ে নেতৃত্ব দেন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাঞ্চাইলাইহা। তার বহু চর্চ্চিত তত্ত্ব Caste is a race plas অর্থাৎ জাতি ব্যবস্থা বর্ণ ব্যবস্থার থেকেও তীব্র। গায়ের রঙ সাদা, কালো, তামাটে হলুদ দেখে নানা বৈষম্যের খবরে আমরা আঁতকে উঠি, সেখানে ভারতের জাতি ব্যবস্থাতে শূদ্র, অতিশূদ্র বা পঞ্চ মা মানুষদের মনুষ্যতর ভাবার একটি ধারাবাহিক প্রবণতা রয়ে গেছে ভারতের তথাকথিত উচ্চবর্ণ বা বড় জাতের মানুষদের মনে। সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটির দ্বারা আয়োজিত “পূর্ব ভারতের দেশজ মূলবাসী মানুষের পরিবর্তনের ধারা” বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশের ও বিদেশের বহু পণ্ডিত গবেষক, সমাজ বিজ্ঞানীদের সমাগম হয়েছিল। উক্ত সভায় মূল ভাষণ উপস্থাপনার সময় আমি বলেছিলাম যে পূর্ব ভারতের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড ছাড়াও ভারতের সর্বত্র মূলবাসী আদিবাসী মানুষদের বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের সারনেম বা পদবী দেখে। আদিবাসী মানুষের পদবী যেমন মুর্মু, হেমব্রম, টুডু, সোরেন, মাঝি, মাহাতো, বানোয়ান, দিডুয়ার, কচ্ছপ, মুণ্ডা, সরদার, ওরাঁও, খালখো, হো, সোম্বরাই ইত্যাদি পদবীগুলির মানুষেরা যখন তথাকথিত বাবু বা ভদ্রলোক সমাজের দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানে বা অফিসে তাঁদের সামান্যটুকু অধিকার পাবার জন্য চেষ্টা করেন তখন সুদীর্ঘ দিনের ঘৃণা আর অবজ্ঞার হাত ধরে চলে আসা মানসিকতার মানুষেরা হোঁচট খান এবং এর পরই শুরু হয় Manipulation বা কারচুপির ছয়লাপ ।

সাম্প্রতিক দিনে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা পাঠকদের মনে আছে কি? জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার নাম করে তপশিলী জাতি উপজাতি ছেলে-মেয়েদের মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে যাতে তাঁরা ভর্তি হতে না পারে তার জন্য অসাধারণ ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তপশিলী উপজাতির ছেলে-মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত দুই-তৃতীয়াংশ আসন খালি পড়ে রইলো।

কলেজ সার্ভিস কমিশনে জাতি উপজাতি প্রার্থীদের জন্য প্রায় ৭৫০টি অধ্যাপকের চাকরীকে অসংরক্ষিত ঘোষণা করে দিলেন মাননীয় বিচারপতি। সুতরাং প্রায় ঠিক করে নেওয়া হয়েছে যে তপশিলী উপজাতি মানুষের সন্তানেরা সহ মূলবাসী আদিবাসী মানুষেরা হাওড়া, হুগলী, বৰ্দ্ধ মানে গত ৩০০ বৎসর ধরে যেমন নামাল বা পূর্বখাদা শ্রমিক হিসাবে বছরের পর বছর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর কিংবা ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা, রাজমহল, দুমকা থেকে বিভিন্ন মরসুমে পরিযায়ী পাখীদের মতো সস্তা শ্রমিক হিসাবে কাজ করে যাবেন অনুপস্থিত জোতজমির মালিকদের ক্ষেতে খামারে। আসামে কুলি চালান বন্ধ 

হয়েছে। কিন্তু বালেশ্বর, কটক, ভুবনেশ্বর রেল লাইনের ধারে ধারে যারা বসবাস করেন তাঁরা কিন্তু বৃহত্তম ঝাড়খণ্ডের মূলবাসী আদিবাসী মানুষেরা।

সেদিন কথা হচ্ছিল নৈহাটির কুলিয়াগড় হাইস্কুল প্রাঙ্গণে বনমালী মুর্মু, বিনয় সদার আর দুর্গাদাস মাণ্ডীর সঙ্গে এদের অনেকেই নীলচাষীদের বংশধর। নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, সুন্দরবন অঞ্চ লে কয়েক লক্ষ মানুষ এসেছিলেন ২০০০ নীলকুঠিতে কুলি হিসাবে কাজ করতে আর সুন্দরবন আবাদ করার জন্য রাঁচী, মানভূম, সিংভূম থেকে। অনেকেই লেখাপড়া শিখেছেন এক ভয়ানক অমানবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, কিন্তু সরকারী চাকরী তো দূর অস্ত তাঁরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ ভুলে পরিণত হয়েছেন সস্তা শ্রমিকে। এই মানুষদেরই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— 'নির্বাক মানুষজন’।

অন্যদিকে তপশিলী উপজাতি প্রমাণপত্র পাবার জন্য সুন্দরবনের চরাবিদ্যা গ্রামের চন্দন মাহাতো, কিংবা সুবলচন্দ্র সরদার (নেজাদ) কিংবা ডায়মণ্ডহারবারের কিংবা আনন্দপুরের কিংবা বাঁশদ্রোণীর সূর্য্যসেন গোড়াইতদের কি ভয়ানক অবস্থা, যা এক কথায় অকল্পনীয়। চন্দনকে তো মানববিজ্ঞানী শরৎচন্দ্র রায়ের বই The Mundas and the Country থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে হলো যে মুণ্ডাদের সারনেম বা পদ্মী মধ্যযুগে মাহাতো ছিল।

এই যখন আদিবাসী মূলবাসীদের বাঁচার সংকট যাকে বলে একেবারে সার্বিক সংকট তখন পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামে চলছে তীব্র ম্যালেরিয়ার দাপট, পি. ডবিলিউ, জি. আর. এম. সি. সির পাশাপাশি কেশপুর গড়বেতা, শালবনিতে শান্তি শৃঙ্খলা ও আইনের সুরক্ষার নামে নারকীয় তাণ্ডব। তাই আদিবাসী মূলবাসীদের বাঁচা মরার প্রশ্নটাই আগে, পরে সংস্কৃতি আর স্বপরিচয় নিয়ে ভাবনার কথা বলে জানালেন সুচাঁদ বাস্কে । বান্দোয়ানের এই যুবক ছিলেন আমার পথ প্রদর্শক দামপাড়া-সুরজডিয়া যাবার। হাতী আর অন্যান্য জন্তু জানোয়াদের সংরক্ষণ এবং তাদের বাঁচার ও যাতায়াতের জন্য বান্দোয়ান, কুইলাপাল, দামপাড়া, বাঁশপাহাড়ী এবং বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি সীমান্ত এলাকার প্রায় দু-শত আদিবাসী মূলবাসী হড় মিতান মানুষ উচ্ছেদ হতে চলেছেন। কারণ সেখানে তৈরী হবে বিশ্ব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ তহবিলের সহযোগিতায় অরণ্য রক্ষাগার। সমগ্র এলাকা জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে।

সুবর্ণরেখা, দামোদর, ডুলুং, খড়কাই নদীতে দেখ দিয়েছে ভয়ানক প্রদূষণ। দামোদর নদীর জল বোকারো আর সোনডিমরা পর্যন্ত বিষাক্ত, তেল চিটচিটে হয়ে গেছে। সাঁওতালডি বিজলী কারখানার দাহ্য পদার্থের জেরে দামোদর নদী মেজিয়া পর্যন্ত ধুঁকছে।

অন্যদিকে খাদশিলা থেকে কোপাড়া সর্বত্র দেখা যাচ্ছে সুবর্ণরেখাতে প্ৰদূষণ। জলে শেওলা পড়ে, কালো পর্দা যুক্ত জল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। হিন্দুস্থান কপার, ইউরেনিয়ামের বিষাক্ত শোধন জল আর টাটা কোম্পানীর দূষিত নলবাহী জল সমগ্র নিম্ন ঝাড়খণ্ড এলাকার মানুষকে যেন তটস্থ করে রেখেছে। মরণ বাঁচন এই সংগ্রামে দ্রুত জঙ্গল শেষ, খরা, দুর্ভিক্ষ এদের নিত্যসঙ্গী। সুন্দরবনের আদিবাসীরা আর ধান চাষ করে না—করে মীন অর্থাৎ চিংড়ি পোনা (গলদা চিংড়ি) চাষ করছে। হাড়োয়া থানার ডিহিগাছির আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয় আজও মঞ্জুর হয়নি জানালেন আকন মুণ্ডা ।

সমগ্র আদিবাসী সমাজে তাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো শরীরে শক্তি বা সামর্থ্য নেই পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডী পাহাড়ের পাহিড়া বা পাহাড়িয়া আর বীরহোর গোষ্ঠীর মানুষদের। পাহাড়িয়া গোষ্ঠীর মানুষেরা দ্রুত অবলুপ্তির পথে চলেছেন। বিশ্ব আদিবাসী/মূলবাসী দশক চলছে সেই সময় পৃথিবীর আদিতম মানুষেরা, আজ সজল নয়নে তাকিয়ে সভ্যতাগর্বী, আধুনিক, অমানবিক বিশ্বায়নের দিকে। মেদিনীপুরের লোধা, পুরুলিয়ার শবর খেড়িয়া মানুষেরা শুধু মাত্র বাঁচার জন্যই বোবা হয়ে গেছে। ওদের কথা শোনার লোক কেউই নেই। মন্ত্রী আছেন আদিবাসী উন্নয়নের জন্য—আদিবাসী উন্নয়নের জন্য বড় বড় ব্যুরোক্রেট আছেন, আছেন ডাইরেকটার। প্রোজেক্ট অফিসার তাঁর জেলা সভাধিপতির কাছে দায়বদ্ধ। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে পানীয় জল, রেশন, ইন্দিরা আবাস, কৰ্ম্ম সংস্থান, ছাত্রবৃত্তি, ছাত্র খাদ্য সুরক্ষা সব কেমন বায়বীয় হয়ে গেছে। পুরুলিয়ার অঝর্ণা গ্রামের খেড়িয়া যুবক যুবতীদের পরনের শেষ কাপড়টুকু এতদিনে আরও ছিঁড়ে গেছে।


Post a Comment

0 Comments