গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণ : সগর রাজাদের উপাখ্যান
মহারাজ ভগীরথ কেন, কিভাবে দেবী গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন ? বিপ্রবর লোমশকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলে ‘লোমশ’ মহাত্মা সগরের গল্প শুরু করেন, বলেন— “হে রাজন! ইক্ষ্বাকু বংশে সগর নামে অসামান্য রূপবান এবং বহু গুণের অধিকারী এক রাজা ছিলেন। বৈদভী এবং শৈব্যা নামে তাঁর দুই রূপলাবণ্যময়ী পত্নী ছিলেন। বিয়ের পর অনেক দিন অতিবাহিত হলেও রাজ-দম্পতি তখনও সন্তান থেকে বঞ্চিত ছিলেন । তাই পুত্র লাভের আশায় পত্নীদের সঙ্গে নিয়ে নৃপতি সগর এক সময় কৈলাস পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এইভাবে বেশ কিছুকাল চলার পর তিনি একদিন দেবাদিদেব শূলপাণির সাক্ষাৎ লাভ করেন। মহারাজ সগর ভগবান শম্ভুকে দেখে স্ত্রীদ্বয় সহ নিজে তাঁর চরণে ভক্তিপূর্ণ চিত্তে প্রণাম করে ‘পুত্র বর’ প্রার্থনা করেন ।
ত্রিশূলধারী ভগবান শিব তাঁদের আপ্যায়নে সন্তুষ্ট হয়ে সস্ত্রীক নৃপতিকে বর দিয়ে বললেন— “হে রাজা! তোমার এক স্ত্রী'র গর্ভে ষাট হাজার অতি বলশালী, পরাক্রমী সন্তান জন্ম নেবে, কিন্তু তারা সকলে একসঙ্গে বিনষ্ট হবে। আর অন্য মহিষীর গর্ভে একটি মাত্র সন্তান জন্ম নেবে, যে তোমাদের বংশের মুখোজ্জ্বল ও বংশরক্ষা করবে।”
এইভাবে দেবাদিদেব মহেশ্বর সগর দম্পতিকে বর প্রদান করে অন্তর্হিত হলেন । রাজা সগর তারপর আকাঙ্ক্ষিত বর লাভ করে অনন্দিত মনে নিজের ভবনে ফিরে গেলেন।
কিছুদিন পর সগর নৃপতির দুই সহধর্মিণীই গর্ভধারণ করলেন। বৈদভী যথা সময়ে একটি বিশাল লাউ প্রসব করলেন। অন্যদিকে শৈব্যার গর্ভে এক অনিন্দ্যসুন্দর পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলো। রাজা সগর সেই লাউটি বিরক্তির সঙ্গে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে গম্ভীর স্বরে হঠাৎ আকাশবাণী শোনা গেল— “হে রাজন! তুমি সবদিক বিচার না করে এই লাউটি ফেলে দিও না। এর মধ্যে যে বীজগুলি আছে তাকে ষাট হাজার ভাগে ভাগ করে ঘৃতপূর্ণ উষ্ণ কলসিতে রেখে দাও। তা হলেই তোমার ষাট হাজার পুত্র লাভ হবে। দেবাদিদেব তোমাকে পুত্র লাভের এমন নির্দেশ পূর্বেই দিয়েছেন। তুমি এ নিয়ে অযথা আর চিন্তা করো না।”
দৈববাণী শুনে রাজা সগর অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লাউ বীজগুলি সংগ্রহ করে সেগুলি ষাট হাজার ভাগে ভাগ করলেন। এরপর প্রত্যেকটি ভাগ ষাট হাজার ঘৃতপূর্ণ মাটির কলসিতে স্থাপন করলেন। প্রতিটি কলসি রক্ষা করার জন্য এক একজন ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। এইভাবে বেশ কিছুকাল কেটে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ে সেই সমস্ত কলসিগুলি থেকে বীর-বিক্রমী ষাট হাজার পুত্রের জন্ম হলো। জন্মানোর পর পরই সকল সন্তানেরা আকাশে উড়ে যেতে পারতো। তারা প্রত্যেকেই ছিল ক্রূর প্রকৃতির। বড়, ছোট কাউকেই মানতো না। যোগ্য সম্মান দিত না। দেব, গন্ধর্ব, রাক্ষস প্রভৃতি মানুষ নয়, এমন প্রাণীদের সঙ্গেও ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়তো।
তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতাগণ একদিন ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। পিতামহ ব্রহ্মা তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুনে বললেন- “আপনারা যে যার ঘরে ফিরে যান। সগর সন্তানেরা অল্প দিনের মধ্যেই নিজেদের কর্মফল ভোগ করবে। সকলেই একসঙ্গে বিনষ্ট হবে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আর উদ্বিগ্ন হবেন না।”
এর কিছুকাল পর সগররাজ অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। সগর সন্তানদের তত্ত্ববধানে অশ্বমেধের ঘোড়া বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একসময় জলশূন্য বিশাল একটি সাগর তীরে ঘোড়াটি সহ তারা পৌঁছাল। যদিও রাজকুমারগণ ঘোড়াটিকে চোখে-চোখে রেখে অনুসরণ করছিল, কিন্তু হঠাৎ যজ্ঞের ঘোড়াটি তাদের চোখের আড়ালে চলে যায়। তখন সগর তনয়গণ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি গেছে ভেবে তাদের পিতার কাছে গিয়ে খবর দেয়। পিতা সেই খবর শুনে বলেন- “তোমরা ঘোড়ার খোঁজে সব জায়গায় যাও। তাকে অবিলম্বে খুঁজে বের করো।”
পিতার নির্দেশ শুনে তারা তখন গোটা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে চললেও কোনভাবেই ঘোড়াটির সন্ধান পাচ্ছিল না। এক সময় নিরুপায় হয়ে তারা পুনরায় তাদের পিতাকে বলল- “পিতা! আপনার নির্দেশমতো সমুদ্র, দ্বীপ, বন, নদ, নদী, পর্বত, গুহা সর্বত্র গিয়ে ঘোড়াটিকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও ঘোড়াটি বা তার অপহরণকারীর সন্ধান পাই নি। এ কি ঈশ্বর-নির্দিষ্ট কোন ঘটনার প্রভাব ?”
রাজা সগর তাঁর পুত্রদের কথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন— “তোমরা যেভাবে পার ঘোড়াটিকে অনুসন্ধান করো। ঘোড়াটি না নিয়ে ফিরবে না। এই আমার আদেশ।”
যাইহোক, সে সময় রক্ষাকর্তা হিসাবে এগিয়ে এলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। বৃষ্টির ঝর্ণাধারায় সেই দাবানল অচিরেই নির্বাপিত হলো। কিছু বৃষ্টির জলধারা পর্বতগাত্র গড়িয়ে সমুদ্রজলে মিশতে থাকলো। মন্দার পর্বতও ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হলো। তার মণিমুক্তা সহ মূল্যবান বস্তুসমূহ সমুদ্রজলে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। একটানা মন্থন ও নানা রকম বস্তুর মিশ্রণে সমুদ্র জলের রং দুধের মত ক্ষীর সাগরের রূপ নিল। তাতে দেবগণ ও দানবগণ অবগাহন করে বলশালী হলেও দীর্ঘ পরিশ্রমে তাঁরা সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। অনেকে আবার অত্যন্ত পরিশ্রম করে অমৃত না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলেন। পরিস্থিতি বিচার করে পদ্মাসনস্থ ব্রহ্মা শ্রী বিষ্ণুকে অনুরোধ করলেন— “আপনি সকলকে শক্তি প্রদান করুন। নাহলে মন্থন কার্য পুনরায় শুরু করা সম্ভব হবে না।”
শ্রীবিষ্ণু তা শুনে বললেন— “আমি সকলকে শক্তি প্রদান করছি। প্রত্যেকে আরও সক্রিয় হয়ে সমুদ্র মন্থন করুক। সমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করে তুলুক।”
শুরু হলো পুনরার সমুদ্রমন্থন। দেব ও অসুরগণ নতুন উদ্যমে আবার মন্থন প্রক্রিয়াটিকে জোরদার করে তুললেন। হঠাৎ সকলকে অবাক করে শীতল আভাযুক্ত সৌম্যমূর্তি শ্বেতবর্ণ চন্দ্রের (শীতাংশু) উদয় হলো। দেবাদিদেব মহাদেব তাঁকে নিজের মাথার ধারণ করলেন। তারপর ঘৃত থেকে মূল্যবান ‘কৌস্তভ মণি' প্রকট হলো। কৌস্তভ মনি প্রকটিত হলো অহংকারের বিষয়। তাই তা ভগবান নারায়ণকে অর্পণ করা হলো। এরপর শ্বেত পদ্মাসনা লক্ষ্মী ও সুরাদেবী আবির্ভূতা হলেন। তারপর মন্দার, পারিজাত, সন্তান, কল্পতরু ও হরিচন্দন- এই পাঁচটি দিব্য বৃক্ষ প্রকটিত হলো। এগুলি স্বতীর নদনকাননে রোপন করা হালো।
রুমে 'উচ্চঃশ্রবা' নামে দিব্য অহ 'কামধেনু' নামে দিব্য ধেনু এবং চার দন্ড বিশিষ্ট দিব্য গল্প 'ঐরাবত' প্রকটিত হলো। 'উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বটি দেওয়া হয়েছিল অসুরদের। ঐরাবতটি দেওরা হালো দেবরাজ ইন্দ্রকে, তিনি তা নিজ বাহন হিসাবে স্বীকার করালেন। এরপর সুরা, সোমরস, সুধা সহ অন্যান্য পানীয় দ্রব্য নিয়ে আবির্ভূত হালেন পানীয়ের দেবি 'বারুণি'। তাঁকে স্বর্গে স্থান দেওয়া হলো। এমন সময় শারঙ্গ- ধনু এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খ উঠে এলো। দেব, দানব- কেউই তা গ্রহণ করতে আগ্রহী না হালে ব্রহ্মার অনুরোধে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু সেগুলি গ্রহণ করলেন। সবশেষে, অমৃতপূর্ণ শ্বেতবর্ণ কমণ্ডলু হাতে আবির্ভূত হলেন দেব ধন্বন্তরি। তা দেখে দৈত্যগণ “এই অমৃত আমার, এই অমৃত আমার” বলে কোলাহল করতে শুরু করলেন। সমুদ্র মন্থনের অন্তিম পর্বে উত্থিত হলো 'কালকূট' বিষ। তার তীব্র গন্ধে অনেকে অচেতন হয়ে পড়লেন। ব্রহ্মা তা দেখে দেবাদিদেব মহাদেবকে অনুরোধ করলে তিনি তা নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নিলেন। সেই থেকে তিনি ‘নীলকণ্ঠ' নামে পরিচিত হলেন।
অন্যদিকে তখন দেবি লক্ষ্মীকে এবং অমৃত পাওয়ার প্রত্যাশায় দৈত্যগণ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তখন ভগবান নারায়ণ মোহিনী-মায়া রূপ ধারণ করে তাদের সামনে আবির্ভূত হলেন। সেই রূপে মোহিত হয়ে দানবগণ মোহিনী রূপধারী নারায়ণের হাতে অমৃত ভাণ্ডটি অর্পণ করলেন। এককথায় ভগবান নারায়ণ মোহিনী বেশে দানবাদের কাছ থেকে অমৃত হরণ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা দেবতাদের মধ্য বণ্টনের ব্যবস্থা করলেন।
এরপর দেবতারা সেই অমৃত মহানন্দে পান করতে লাগলেন। সকলে যখন অমৃত পানে ব্যস্ত সেই সময় রাহু নামে এক দৈত্য ছদ্মবেশে দেবতাদের দলে প্রবেশ করে এবং অমৃতপান করতে শুরু করে দেন। কিন্তু সূর্যদেব ও চন্দ্রদের তৎক্ষণাৎ রাহুকে চিহ্নিত ও শনাক্ত করেন এবং শ্রীনারায়ণকে তা জানিয়ে দেন। ভগবান নারায়ণ কালবিলম্ব না করে সুদর্শন চক্র দিয়ে রাহুর মস্তক ছেদ করেন। অমৃত ততক্ষণে রাহুর কণ্ঠদেশ পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়েছিল। পর্বত শিখরের মতো রাহুর বৃহদাকার ভয়ংকর মাথা গর্জন করতে করতে আকাশে উড়ে গেল এবং তার নিথর শরীর বসুন্ধরা কাঁপিয়ে ভূপতিত হলো। সেই থেকে শুরু হলো চন্দ্র-সূর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা। তাই ‘চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণ' পৌরাণিক ব্যাখ্যানুসারে রাহুর প্রকোপ জনিত ঘটনা বলে আজও প্রচলিত আছে। আর দৈত্যকুলের একমাত্র প্রতিনিধি রাহু ঐদিন অমরত্বের কিঞ্চিৎ অংশীদার হয়ে মস্তক-সর্বস্ব হয়ে আজও দেবসমাজে অমর হয়ে আছেন।
একটু পরেই দৈত্যগণ বুঝতে পারে কী ভয়ংকর ভুল তারা করে ফেলেছে। ততক্ষণে দেবগণ অমৃত পান করে অমরত্ব লাভ করেছেন। সে জন্য বঞ্চিত হতাশ অসুরগণ তখন দেবতাদের উপর মারমুখী হয়ে ওঠে। এভাবে শুরু হলো সুর-অসুর ভয়ংকর সংগ্রাম। তখন খড়্গা, চক্র, গদা, শক্তি প্রভৃতি শস্ত্র বর্ষণে উভয় পক্ষ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে এক সময় দৈত্যগণ ভগ্ন মনোরথ ও হীনবল হয়ে পড়লো। এবং দেবতারাই শেষে জয়ী হলেন। তাঁরা মন্দার পর্বতকে তখন স্বস্থানে সংস্থাপন করলেন। সবশেষে, ইন্দ্রাদি দেবগণ হৃষ্টচিত্তে অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু সুরক্ষিত করে ভগবান নারায়ণের হাতে সমর্পণ করলেন।
0 Comments