খাণ্ডব দহন

খাণ্ডব দহন

খাণ্ডবদহনের গল্পটি মহাভারতের সভাপর্বের একদম অন্তিমে আলোচিত আছে। খাণ্ডব দহন একটি ভয়ংকর দাবানল, যা স্বয়ং অগ্নিদেব ঘটিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন ছিলেন তাঁর প্রাধান সহায়ক। খাণ্ডব দহনের ফলে অসংখ্য প্রাণীহত্যা এবং অপরিমেয় সবুজ বনানী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই ধ্বংসলীলা নিঃসন্দেহে সৃষ্টির কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি । কিন্তু মহাভারতের কবি এটিকে আর পাঁচটি ঐশ্বরিক ঘটনার আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ধ্বংসলীলার কারণ, প্রকৃতি ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করেই আলোচ্য গল্পটি নির্মিত হয়েছে। এখন জেনে নেওয়া যাক মূল গল্পটি।

* বৈশম্পায়ন ঋষি বললেন— জনমেজয়। ইন্দ্রপ্রস্থে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন বেশ গুছিয়ে রাজ্য শাসন শুরু করেছেন। রাজা রূপে তাঁকে পেয়ে প্রজাগণ খুব খুশি। চারদিকে তখন একটি শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবেশ। সবার মুখে তখন একটাই কথা; সৌভাগ্য লক্ষ্মী ঘরে ঘরে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন। ধর্ম ও বুদ্ধি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পূর্ণিমার চাঁদ দেখে যেমন সকলের চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়, তেমনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে পেয়ে প্রজাদের মন ও হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। তাঁদের রাজা প্রকৃতই প্রজারঞ্জক এবং সত্যের পূজারী। তিনি কখনো অপ্রিয় বাক্য বলেন না। তিনি নিজের যেমন ভালো চান, তেমনি সকল প্রজাদেরও মঙ্গল চান। সকল পাণ্ডব ভাইয়েরা যুধিষ্ঠিরের অধীনে থেকে অন্যান্য সকল রাজাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষত রেখে রাজ্যশাসনে সাহায্য করেছিলেন। এভাবে সকলে মিলে তাঁরা মহানন্দে দিনগুলি কাটাচ্ছিলেন।

তখন গ্রীষ্মকাল। সর্বত্র তীব্র দাবদাহ অনুভূত হচ্ছে। অর্জুন একদিন ধনঞ্জয়কে বললেন, সখা, চলুন আমরা সপরিবারে, সবাই মিলে যমুনায় গিয়ে জলবিহার করে আসি ।

বাসুদেব অর্জুনের প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। তারপর যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে সবান্ধবে তাঁরা যমুনার উদ্দেশে রওনা দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন স্থানটি খুবই

মনোরম। নির্জন-শান্ত-সমাহিত পরিবেশে সমগ্র এলাকাটি এক কথায় অসাধারণ। চারিদিকে নানারকম গাছপালায় সাজানো তার প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট। ফুল, গন্ধ, মৃদু- মন্দ বাতাসে সেখানে তখন এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। বীণা, মৃদঙ্গ ও বাঁশির মনভোলানো সুরে সকলের মধ্যে তখন কেমন যেন এক মন মাতানো আবেশ। তারই মধ্যে ভগবান বাসুদেব এবং সখা কৃষ্ণ একটি রমণীয় স্থান বেছে নিয়ে সুন্দর একটি আসনের উপর উপবেশন করলেন।

বাকি যাঁরা সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁরা যে যার ইচ্ছামতো আনন্দ করতে শুরু করলেন। কেউ বেছে নিলেন বনবিহার, কেউ বা যমুনার জলে নেমে শুরু করলেন জলক্রীড়া, কেউ কেউ আবার গল্প-গুজব করতে করতে আনন্দ যজ্ঞে সামিল হলেন। এমন সময় নবোদিত সূর্যের ন্যায়, পিঙ্গল জটাধারী, এক-গাল গোঁফ-দাড়ি বল্কল-পরিহিত তেজস্বী এক ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে কৃষ্ণ এবং অর্জুন দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন। আগন্তুক ব্রাহ্মণ তখন বললেন— “আমি অপরিমিত ভোজন করি। আপনাদের কাছে একটি বিশেষ প্রার্থনা নিয়ে এসেছি। দয়া করে আমার প্রার্থনা স্বীকার করুন।”

কৃষ্ণ ও অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন— “আপনি কি ধরনের খাওয়ার পছন্দ করেন ? তা যদি বলেন, তা হলে আমরা সেইভাবে আয়োজন করতে পারি।”

ব্রাহ্মণ বললেন— “আমি অগ্নি । আমি অন্ন ভোজন করি না । তাই আমাকে অনুরূপ- অন্ন প্রদান করুন। ইন্দ্রের সখা পন্নগরাজ (সর্পরাজ) তক্ষক সপরিবারে খাণ্ডব অরণ্যে বাস করেন। ইন্দ্র এককথায় খাণ্ডবকে রক্ষা করেন। আমি যখনই প্রজ্জ্বলিত হয়ে খাণ্ডব দগ্ধ করতে প্রয়াসী হই, তখনই তিনি মুষলধারে বৃষ্টি শুরু করেন। যার ফলে আমি আর খাণ্ডব দাহ করতে পারছি না।

তাই আপনাদের কাছে আমার প্রার্থনা, আপনারা সশস্ত্র হয়ে খাণ্ডব অরণ্যের সকল প্রাণীগণকে নষ্ট করুন, তাহলে আমি খাণ্ডব দহন করতে সমর্থ হই।”

জনমেজয় তখন প্রশ্ন করলেন— “মুনিবর! বহু প্রাণীর আবাসস্থল, খাণ্ডব বন ভগবান হব্যবাহন নিশ্চয়ই কোনো সামান্য কারণে দহন করতে প্রয়াসী হননি। কি সেই কারণ ? অগ্নিদেব কেনই বা এত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ? আমি সেই বৃত্তান্ত শুনতে চাই। দয়া করে তা বলুন।”

বৈশম্পায়ন বললেন— “মহারাজ! ঋষিমুখে শোনা খাণ্ডব দহনের সেই পৌরাণিক কথাগুলি এখন আমি পরিবেশন করছি। মন দিয়ে শুনুন।”

বহুকাল পূর্বে শ্বেতকি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিশালী, বুদ্ধিমান এবং যাজ্ঞিক এক নৃপতি। নানারকম শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম এবং যজ্ঞানুষ্ঠান করতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তাঁর যজ্ঞ করতে করতে ঋত্বিকগণ যখন পরিশ্রম বোধ করতেন, তখন তাঁরা যজ্ঞ করতে অস্বীকার করতেন। কিন্তু রাজা যজ্ঞ বন্ধ করতেন না। তিনি ঋত্বিকদের অনুনয়-বিনয় করে তাঁদের পুনরায় যজ্ঞ করতে রাজি করাতেন। তার জন্য তিনি ঋত্বিকদের উপযুক্ত দান-ধ্যান করতে কোনো কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু এভাবে দীর্ঘকাল চলার পর ঋত্বিক ব্রাহ্মণগণ সত্যি সত্যি এক সময় হার মানলেন। রাজা শ্বেতকির যজ্ঞস্থল ত্যাগ করে তাঁরা নিজ নিজ গৃহে চলে গেলেন।

রাজা শ্বেতকি কিন্তু পিছু হটবার পাত্র নন। তিনি তখন কৈলাস পর্বতে গিয়ে ব্রত, উপবাস, এবং কঠোর তপস্যা করতে শুরু করলেন। সেই কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে প্রসন্ন হয়ে দেবাদিদেব শঙ্কর তাঁকে বর দিয়ে বললেন— 'তাঁর এই অসম্পূর্ণ যজ্ঞানুষ্ঠান সু- সম্পন্ন করার জন্য মহর্ষি দুর্বাসাই হলেন উপযুক্ত ব্যক্তি। তাঁর কাছে যাও। তাঁকে রাজী করাও।'

এরপর রাজা শ্বেতকি মহর্ষি দুর্বাসাকে দিয়ে এক মহাযজ্ঞ করালেন। সেই মহাযজ্ঞ প্রথমে দ্বাদশ বৎসর এবং পরে একশ বৎসর ধরে চলেছিল। সেই যজ্ঞে রাজা শ্বেতকি ব্রাহ্মণদের প্রভূত দান-দক্ষিণা দিয়ে সকলকে তৃপ্ত করেছিলেন। যজ্ঞান্তে দুর্বাসাও প্রসন্ন হয়েছিলেন। এর ফলে রাজা শ্বেতকি দীক্ষিত যাজক সহ স্বপরিবারে স্বর্গে গমন করেছিলেন।

বলাবাহুল্য, এত সুদীর্ঘকাল ধরে চলা এই মহাযজ্ঞে অগ্নিদেবকে প্রভূত পরিমাণে হব্য অর্থাৎ ঘৃতের ধারা পান করতে হয়েছিল। তার ফলে তাঁর শরীরে অজীর্ণ রোগ এসেছিল। তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন। তাঁকে দুর্বলতা গ্রাস করেছিল। তিনি তখন নিরাময়ের জন্য ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মার পরামর্শ প্রার্থনা করে ছিলেন।

ব্রহ্ম সব ঘটনা শুনে বললেন- “অগ্নিদেব! যদি তুমি খাণ্ডব বন পোড়াতে পার, তাহলে তোমার অজীর্ণতা দূর হবে। শরীরে বল ফিরে পাবে। খাণ্ডব বনে অসংখ্য প্রাণী বাস করে। তাদের মেদ-মাংস ভক্ষণ করলে ক্ষুধামন্দা কাটবে। তোমার শরীর আগের মতো বলশালী হয়ে উঠবে।”

সেই মত অগ্নিদেব সাতবার খাণ্ডব বনে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র প্রতি ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। অগ্নি এভাবে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মদেব তখন তাঁকে অর্জুন ও কৃষ্ণের সাহায্য নিতে পরামর্শ দিলেন।

যাইহোক, অগ্নিদেবের প্রার্থনা শুনে অর্জুন বললেন— “অগ্নিদেব! আমার কাছে দিব্যাস্ত্রের কোনো অভাব নেই। দিব্যাস্ত্র যা আছে তা দিয়ে শত শত বজ্রধরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবো। কিন্তু আমার কাছে দিব্যাস্ত্রগুলি প্রয়োগ করার জন্য না আছে উপযুক্ত ধনুক, না আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাণ। সেইসঙ্গে এত অস্ত্রশস্ত্র বহন করার মতো দিব্য অশ্বযুক্ত উৎকৃষ্ট রথও এখন আমার কাছে নেই। তাছাড়া কৃষ্ণের কাছে এমন কোনো অস্ত্র নেই যা দিয়ে তিনিও নাগ বা পিশাচদের মোকাবিলা করতে পারেন।

সব মিলিয়ে খাণ্ডব বন দহনের জন্য প্রয়োজনীয় বল ও বিক্রমের অভাব আমাদের নেই । আমাদের অভাবগুলি হলো যুদ্ধ সামগ্রী ও অস্ত্রশস্ত্রের । আপনি দয়া করে আমাদের সেই অভাব পূরণ করুন।”

অর্জুনের বক্তব্য শুনে অগ্নিদেব তখন জলেশ্বর বরুণদেবকে স্মরণ করলেন। বরুণদেব তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তখনই সেখানে উপস্থিত হলেন। অগ্নিদেব বরুণকে বললেন— “রাজা সোমের দেওয়া অক্ষয় তৃণীর, গাণ্ডীব ধনুক এবং বানর চিহ্নযুক্ত ধ্বজা-সমন্বিত দিব্য-রথ আমাকে দিন। তার সঙ্গে চক্রও দিন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন চক্র ও গাণ্ডীব ধনুক সহযোগে আমার জন্য একটি বড় কাজ করতে চলেছেন।”

সেই অনুসারে বরুণ অগ্নিদেবের অনুরোধ মেনে অর্জুনকে দিলেন গাণ্ডীব ধনুক, এবং অক্ষয় তৃণীর । এই ধনুকটি এমন যেটিকে, খণ্ডিত করা যায় না। কিন্তু এই ধনুক অন্য যেকোন শস্ত্রকে খণ্ডিত করতে পারে। এটি সঙ্গে থাকলে যোদ্ধার যশ-বল- কান্তি বৃদ্ধি পায়। এটি ত্রিলোকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, হাজারও ধনুকের সমকক্ষ একটি ধনুক। বরুণ দেব সেই সঙ্গে সকল যুদ্ধ সামগ্রী সহ একটি উজ্জ্বল দীপ্যমান রত্নখচিত দিব্য রথও প্রদান করলেন। এই রথটি বায়ুর বেগের সমান গতিতে ছুটতে সক্ষম। তাতে মহা শক্তিশালী বেগবান গন্ধর্ব দেশের উৎকৃষ্ট শ্বেত অশ্বদ্বয় যুক্ত ছিল। রথের উপর সুবর্ণ একটি দণ্ডে মহাবীর বানরের চিহ্ন অঙ্কিত ধ্বজা উড়ছিল। এইসব কিছু পেয়ে অর্জুন খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই রথে চড়ে অর্জুন যখন গাণ্ডীব ধনুকে ছিলা পরিয়ে টঙ্কার দিলেন, তখন সকলে চমকে উঠলো। অর্জুন তখন নিশ্চিত হলেন। হ্যাঁ, এবার তিনি অগ্নিদেবকে সাহায্য করতে পারবেন।

এরপর অগ্নিদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দিব্য এক চক্র প্রদান করলেন। বললেন- “মধুসূদন। আপনি এই চক্র দিয়ে দেব, দানব সহ অন্য সকলকে যুদ্ধে অনায়াসে পরাজিত করতে পারবেন। আপনি শত্রুর উদ্দেশে এই চক্র যতবার নিক্ষেপ করবেন, শত্রু নিপাত করে ততবারই এই চক্র পুনরায় আপনার হাতে ফিরে আসবে। অন্যদিকে বরুণদেব শ্রীকৃষ্ণকে দিলেন বজ্রের ন্যায় শব্দ দ্বারা শত্রু ধ্বংসকারী একটি গদা, ‘কৌমুদকী’।

এভাবে অস্ত্র প্রদান পর্ব শেষ হলে অগ্নিদেব, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনকে খাণ্ডব দহন করতে বললেন।

বৈশম্পায়ন আবার বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথায়, এরপর শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন রথে চড়ে খাণ্ডব বনের দুপাশে অগ্নিসংযোগ করলেন। আগুন ছড়িয়ে পড়লে বনের অগণিত প্রাণীগণ যে যেদিকে পারলো, পালাতে লাগলো । তাদের দেখে অরণ্যবাসীরাও পালাতে শুরু করলো। কৃষ্ণ ও অর্জুনের রথ এত দ্রুত ছুটছিল যে অর্জুনের রথ বা তার আরোহী কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। শুধুমাত্র রথের চাকার ঘূর্ণনটুকু দৃশ্যমান হচ্ছিল। ইতিমধ্যে আগুন আরও তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়লে বনের মধ্যে বসবাসকারী প্রাণীদের মধ্যে তীব্র আর্তনাদ শুরু হয়। জলাশয়ের মাছ, কুমীর সহ অন্যান্য জলজ প্রাণী, বিনষ্ট হতে শুরু করে। পাখিরা কেউ চক্ষু হারিয়ে কিংবা পাখায় আগুন লেগে প্রাণত্যাগ করতে থাকে । অনেক পাখি দ্রুতবেগে উড়তে উড়তে বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে অর্জুন বাণ প্রয়োগ করতে থাকেন। এর ফলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হয় ।

অন্যদিকে আগুনে পুড়তে পুড়তে অনেক বন্যপ্রাণী আর্তনাদ করতে করতে তখন বন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। অর্জুন তাদের উপর শর নিক্ষেপ করে তাদের নিধন করতে থাকেন। আগুন এরপর গোটা বনাঞ্চল ছড়িয়ে পড়লে তার ধোঁয়ার কুণ্ডলী সু-বিস্তৃত আকাশ কালো করে ত্রাসের সঞ্চার করে। এরপর সমগ্র আকাশ উত্তপ্ত হয়ে যায়। দেবতারা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা এরপর ঋষিদের সঙ্গে নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে যান। এর প্রতিকার করার জন্য আবেদন করেন।

এমন ভয়ংকর খবর শোনার পর দেবরাজ ইন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে খাণ্ডব বন রক্ষা করার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। শুরুতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি মেঘদের বৃষ্টি বর্ষণ করার আদেশ দেন। সেই অনুসারে খাণ্ডব অরণ্যের ওপর দলে দলে মেঘ জড় হতে শুরু করে। শুরু হয় মুষল ধারায় বৃষ্টি। কিন্তু হুতাশনের তীব্র তাপে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আকাশেই শুকিয়ে যায়। তখন দেবরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পুনরায় মহামেঘ দ্বারা বারি বর্ষণ করার ব্যবস্থা করেন। অর্জুন তখন মন্ত্রঃপূত শর-বর্ষণ শুরু করেন। তার ফলে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যায় ৷ অর্জুন এরপর অসংখ্য শরনিক্ষেপ করে গোটা খাণ্ডব বনের আকাশ ঢেকে ফেলেন। তার ফলে সকল প্রাণী অরণ্যের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। ঐ সময় নাগরাজ তক্ষক কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পুত্র অশ্বসেন আগুন থেকে বাঁচার জন্য সব রকম চেষ্টা করেন। কিন্তু অর্জুনের শরজাল ভেদ করে বন থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি অসমর্থ হন। তাঁর লেজ ও মুখে আগুন লেগে যায়। তাঁকে বাঁচাতে তাঁর মাতা এগিয়ে আসেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে নাগমাতা নিজেই আহত হন। পরে মারা যান।

ইন্দ্র এতক্ষণ অর্জুনের রণকৌশল লক্ষ্য করছিলেন। তিনি তখন তীব্র জোরে ঝড় তুললেন। পাশাপাশি বৃষ্টির তেজ বাড়িয়ে অর্জুনকে স্তম্ভিত করে দিলেন। সেই সুযোগে অশ্বসেন পালিয়ে গেলেন।

আকস্মিকভাবে ইন্দ্রের কাছে ধোঁকা খেয়ে অর্জুন ভীষণ রেগে গেলেন। এরপর তীক্ষ্ণ বাণ প্রয়োগ করে গোটা আকাশ তিনি এমনভাবে ঢেকে দিলেন যে, এর ফলে ইন্দ্র কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। ইন্দ্র তার জবাব হিসাবে বাণ বর্ষণ শুরু করলেন। ভয়ংকর বেগে এরপর বাতাস শুরু হলো। সমুদ্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। আকাশে ভয়ংকর মেঘের গর্জন এবং ক্ষণে ক্ষণে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ সৃষ্টি হতে লাগল। অর্জুন এই অবস্থাকে নিজের আয়ত্বে আনার জন্য নিজের তৃণীর থেকে সেরা সেরা অস্ত্রগুলির প্রয়োগ করতে লাগলেন। শেষে ধনঞ্জয় মন্ত্রঃপূত বায়ব অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। তাতে অশনি ও মেঘের বাড় বাড়ন্ত স্তিমিত হলো। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি শান্ত হলো। মৃদু মন্দ বাতাস বইতে শুরু করলো। অগ্নিদেব পুনরায় প্রকাশিত হলেন।

তা দেখে বেশ কিছু পাখি আকাশে উড়তে শুরু করলো। তার মধ্যে পক্ষীরাজ গরুড় নখ, ঠোঁট ও পাখা দিয়ে কৃষ্ণার্জুনকে আক্রমণ করার আশায় আকাশে উড়তে শুরু করলো। সাপেরা আগুনে আধপোড়া অবস্থায় বিষ নির্গত করে অর্জুনের উদ্দেশে ফেলতে লাগলো। অর্জুন তাঁর তীক্ষ্ণ বাণে তাদের দেহগুলি খণ্ড-বিখণ্ড করলেন। প্রজ্জ্বলিত আগুনে এরপর তাদের দেহখণ্ডগুলি ভস্মীভূত হতে লাগলো। এমন সময় যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, নাগ প্রমুখ সকলে অর্জুনকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। অর্জুন ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উপযুক্ত শর নিক্ষেপ করে তাদের মস্তক ছেদন করতে লাগলেন। অন্যদিকে, কেউ কেউ আবার শ্রীকৃষ্ণের চক্রের আঘাতে মূর্ছিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।

ইতিমধ্যে দেবরাজ ইন্দ্র শ্বেতগজের পিঠে চড়ে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনকে লক্ষ্য করে বজ্র নিক্ষেপ করলেন। সেই দৃশ্য দেখে দেবতারা বলতে লাগলেন- “এবার এই দুজন মারা যাবে।” বনরাজ তাঁর কালদণ্ড, ধনপতি কুবের তাঁর গদা, বরুণ তাঁর অস্ত্র পাশ ও বজ্র নিয়ে সুমেরু পর্বতের মত সামনে এসে দাঁড়ালেন। অন্যান্য দেবতারা তাঁদের প্রিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করতে লাগলেন। তাঁদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাসুদেব এবং পার্থ ধনুক-বাণ নিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। তাঁদের দুজনের বিক্রমের সামনে দেবতাদের সকল আক্রমণ ব্যর্থ হলো। ইন্দ্র তখন মন্দার পর্বতের একটি চূড়া তুলে অর্জুনের উদ্দেশে ছুঁড়ে মারলেন। কিন্তু তা লক্ষ্যে আঘাত করার আগেই অর্জুন তাঁর ছোঁড়া বাণের আঘাতে সেটিকে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। সেই পাথরের টুকরোগুলি মাটিতে পড়লে তার আঘাতে বনের মধ্যে থাকা দানব, নাগ, বাঘ, হাতি, ভালুক, মহিষ সহ অনান্য অনেক পশুপাখির দেহ ক্ষত-বিক্ষত হলো।

এইভাবে চলতে চলতে অগ্নি সকলকে গ্রাস করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আর অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণ মুহুর্মুহু বাণ নিক্ষেপ করে সকলকে সেই অরণ্যে ধরাশায়ী করে ফেললেন। দেবতা ও দানব এই দুই সখার রণকৌশল ও বিক্রম দেখে অবাক নয়নে চেয়ে রইলেন।

তাঁদের সম্মিলিত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁরা কৃষ্ণার্জুনের হাত থেকে খাণ্ডব রক্ষা করতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে তাই তাঁরা পিছু হটলেন। ততক্ষণে ইন্দ্র কৃষ্ণার্জুনের প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাঁদের প্রশংসা করতে শুরু করেছেন।

এমন সময় দেবরাজের উদ্দেশে আকাশ থেকে দৈববাণী ঘোষিত হলো- দেবরাজ! তোমার সখা তক্ষক মারা যাননি। খাণ্ডব দহনের সময় তিনি কুরুক্ষেত্রে অবস্থান করেছিলেন। তুমি আর কৃষ্ণার্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কোরো না। তুমি এঁদের হারাতে পারবে না। তুমি দেবতাদের নিয়ে স্বর্গে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে খাণ্ডব দহনের অবশিষ্টটুকু নিরীক্ষণ কর।”

দেবরাজ এই দৈববাণী শুনে ক্রোধ প্রশমন করলেন। সকল দেবতারা স্বর্গলোকের দিকে ফিরছেন দেখে তিনিও তাঁদের পিছু পিছু চললেন। দেবতাদের এভাবে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন অরণ্য দহনের বাকি কাজটুকু দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে শরবর্ষণ তীব্রতর করলেন। বনের জীবজন্তু, পাখি সহ অন্য সকলে আর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল না। তারা একে একে প্রাণত্যাগ করে আগুনে পুড়ে মরতে লাগল। তীব্র আগুনের লেলিহান শিখায় খাণ্ডব বন দ্রুত পুড়ে ছাই হতে লাগল। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য!

এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ লক্ষ্য করলেন যে, ময়দানব তক্ষকের নিবাস থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। তাকে পুড়ে মারার জন্য অগ্নি তার পিছু পিছু অনুসরণ


করছেন। শ্রীকৃষ্ণ তা দেখে তাঁর চক্র ছুঁড়লেন। ময়দানব তখন রীতিমত ভয় পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। তারপর সামান্য চিন্তা করে চীৎকার করে বলল— “বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন! আমি তোমার শরণাগত, আমাকে রক্ষা করো।”

অর্জুন তা শুনে তাকে অভয় দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁর চক্র ফিরিয়ে নিলেন। অগ্নিও তাঁকে আর গ্রাস করতে প্রয়াসী হলেন না। এভাবে ময়দানবের প্রাণ রক্ষা পেলো। খাণ্ডবদাহন চলছিল পনের দিন ধরে। এই ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে মাত্র ছয়টি প্রাণীর প্রাণ শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছিল। তাঁরা হলেন— অশ্বসেন (তক্ষক নাগের পুত্র), ময়দানব এবং তার চারজন শাঙ্গ পাখি । শাঙ্গ পক্ষীদের পিতা মন্দপাল সহ চার পক্ষী ঐ সময় অগ্নিদেবের স্তুতি করেছিল। অগ্নি তাই তাদের ভস্ম করেন নি।

খাণ্ডব দহন শেষ হলে অগ্নিদেব ব্রাহ্মণের রূপ ধরে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের সামনে এলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনকে উদ্দেশ করে বললেন— “আপনারা এমন এক কাজ করলেন যা, দেবতাদের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। আমি আপনাদের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। আপনারা আপনাদের পছন্দমত দুর্লভ বস্তু আমার কাছে প্রার্থনা করুন।”

অর্জুন তখন বললেন— “হে দেবরাজ! আমাকে সব রকমের অস্ত্র প্রদান করুন।” ইন্দ্র বললেন— “অর্জুন! দেবাদিদেব মহাদেব যখন তোমার উপর প্রসন্ন হবেন তখন তোমার তপস্যার পুরস্কার স্বরূপ আমি তোমাকে আমার অস্ত্রগুলি তুলে দেব। সেই সময় কখন আসবে তা আমি জানি। এ নিয়ে তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই ।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন- “দেবরাজ! আপনি আমাদের এমন বর দিন যাতে অর্জুন এবং আমার বন্ধুত্ব নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য থাকে।”

ইন্দ্র তখন খুশি হয়ে বললেন- “এবমস্ত, অর্থাৎ তাই হবে।”

এরপর দেবতারা চলে গেলেন। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন এবং ময়দানব যমুনার পবিত্র তীরে বসে ধ্যানস্থ হলেন। যমুনা তীরের বাসিন্দারা সেই শান্ত সমাহিত মুহূর্তের সাক্ষী। অন্তরীক্ষ থেকে তারাদের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়েছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি। যেন ধ্বংসের পরে সৃষ্টিকে আহ্বান ও তার বন্দনায় রত তাঁরা।


Post a Comment

0 Comments