সুন্দ-উপসুন্দের গল্প

মহাত্মা সত্যবাদী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন স্ত্রী দ্রৌপদী সহ বাকি ভাইদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন। প্রজারা সকলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। সকলের মধ্যে ধর্ম ও সদাচার প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজ্য জুড়ে তখন আনন্দের কোন অভাব ছিল না । একদিন পঞ্চপাণ্ডব রাজসভায় বসে রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় দেবর্ষি নারদ আপন মনে বেড়াতে বেড়াতে সেখানে উপস্থিত হলেন। দেবর্ষিকে দেখে সকল পাণ্ডবভ্রাতা উঠে দাঁড়ালেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আসন থেকে উঠে নারদমুনিকে সাদর সম্বর্ধনা জানালেন। দেবর্ষি পূজা গ্রহণ করে যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করলেন। এবং সবাইকে বসতে বললেন। এরপর নারদমুনির আগমনবার্তা অন্দরমহলে দ্রৌপদীর কাছে পাঠানো হ'ল । তা শুনে দ্রুপদ কন্যা মুনির কাছে এসে তাঁর পদধূলি নিলেন। এবং হাতজোড় করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দেবর্ষি তখন পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করলেন। পরে অন্তঃপুরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন ।

দ্রৌপদী রানিমহলে প্রস্থান করলে মুনিবর যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চভ্রাতাকে একান্তে ডেকে বললেন- “হে পাণ্ডবগণ! তোমরা পাঁচ ভাই; কিন্তু দ্রুপদনন্দিনী তোমাদের একমাত্র পত্নী। তাই তোমাদের এই স্ত্রী'কে নিয়ে যাতে কোন ভ্রাতৃবিরোধ না হয়, সেজন্য একটি নিয়মনীতি স্থির করা উচিত। পুরাকালে সুন্দ ও উপসুন্দ, দুই ভাই ছিল। তারা একসঙ্গে শোওয়া, বসা, খাওয়া-দাওয়া এবং একযোগে রাজ্য শাসন করতো। কিন্তু একসময় একজন নারীকে কেন্দ্র করে তাদের সম্পর্ক বিবাদে পরিণত হয়, যা শেষ পর্যন্ত উভয়ের মৃত্যু ঘটায়। তোমাদের ভাইদের মধ্যে এখন যে মধুর সম্পর্ক আছে, তা যেন কখনো বিনষ্ট না হয়— সেই কারণে আমি উপযুক্ত একটি উপায় স্থির করার কথা বলছি।”

যুধিষ্ঠির বললেন- “হে মুনিশ্রেষ্ঠ! আপনি যে সুন্দ-উপসুন্দের কথা বলছেন, তারা কারা ? তাদের জন্ম কিভাবে হয়েছিল ? তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ কি ছিল ? এই ঘটনাগুলি জানার খুবই ইচ্ছা করছে। দয়া করে এ বিষয়ে আলোকপাত করুন।”

নারদমুনি তখন বললেন— “হে কুন্তীপুত্র! একসময় অসুরাধিপতি হিরণ্যকশিপুর বংশে নিকুম্ভ নামে এক মহাবলী দৈত্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঐ দৈত্য ছিলেন দৈত্যদের রাজা। সুন্দ এবং উপসুন্দ ছিলেন তাঁরই পুত্রদ্বয়। তাঁরা ছিলেন পরাক্রমী, মহাশক্তিধর দুই ভাই। তাঁরা সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নিতেন। ভোজন, শয়ন, ভ্রমণ— কোন কাজেই তাঁরা বিচ্ছিন্ন হতেন না। কেউ কাউকে আঘাত দিতেন না, কষ্ট দিতেন না। উভয়ের মধ্যে ছিল সত্যিকারের প্রীতির সম্পর্ক। তাই দুই ভাইকে দেখলে মনে হতো তাঁরা যেন একটি মাথা দুভাগে ভাগ হয়েছেন।

ক্রমে তাঁরা স্থির করলেন ত্রিভূবন জয় করার। সেই উদ্দেশ্য সফল করার উপায় হিসাবে বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে তাঁরা শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি— সব কিছুকে উপেক্ষা করে দীর্ঘকালব্যাপী চলেছিল সেই তপস্যা। দেবগণ তাঁদের তপস্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন দেখে তা ভঙ্গ করার জন্য একাধিক কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সুন্দ-উপসুন্দ, দু-ভাই ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল, একাগ্র চিত্ত। শেষ পর্যন্ত, ভগবান ব্রহ্মা তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য হলেন। ভগবান পদ্মযোনি ব্রহ্মাকে দেখে দু-ভাই উঠে দাঁড়িয়ে এবং হাতজোড় করে বললেন- “হে দেব! আপনি আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনি যদি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হন তাহলে আমাদের আশীর্বাদ এবং বরদান করুন; যাতে, আমরা অস্ত্রবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ হই। মায়ারূপ ধারণে পারদর্শী হই । ইচ্ছামত রূপ ধারণ করতে পারি। মহাপরাক্রমী হই এবং উভয়ে অমর হই ।”

ব্রহ্মা বললেন— “দেখো অমরত্ব ছাড়া অন্যান্য বরগুলি আমি তোমাদের দিচ্ছি। অমরত্ব বর দান করলে তোমরা দেবতাদের সমান হয়ে যাবে। তোমরা সকলের উপর আধিপত্য দেখাতে চাও বলে এই কঠোর তপস্যা শুরু করেছো, তাই তোমাদের অমরত্ব দান করা সমীচীন নয়।”

তখন সুন্দ-উপসুন্দ বললেন- “হে পিতামহ! যদি সত্যি আমাদের অমরত্ব না দেন, তাহলে এই বর দিন যাতে ত্রিভূবনের যেকোন স্থাবর ও অস্থাবর থেকে আমরা যেন কোন ভয় না পাই। আমরা শুধুমাত্র পরস্পর পরস্পরকে সংহার করতে পারি।” প্রজাপতি ব্রহ্মা বললেন- “হে দানবেন্দ্ৰ! তোমাদের এই প্রার্থনা স্বীকার করলাম । তোমরা যেমন বর চাইলে তোমাদের মৃত্যু সেভাবেই হবে।”

এই বলে ব্রহ্মদেব ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। আর সুন্দ ও উপসুন্দ ব্রহ্মার আশীর্বাদে বলীয়ান হয়ে হৃষ্টমনে নিজের ভবনে গমন করলেন।

এরপর এই দুই দানব যথারীতি ত্রিলোক বিজয়ে বেরিয়ে পড়লেন। দেবতারা যখন জানতে পারলেন যে, এঁরা প্রজাপতি ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত তাই আর কালবিলম্ব না করে তাঁরা দেবলোক ছেড়ে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। সুন্দ-উপসুন্দ তখন অনায়াসে ইন্দ্রলোক জয় করে সেখানকার যক্ষ, রক্ষ ও অন্যান্য খেচরদের সংহার করার পর পাতাল আক্রমণ করলেন। সেখানে নাগগণ ও অন্যান্য ম্লেচ্ছজাতির উপর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করলেন। তারপর আক্রমণ করলেন মর্ত্যলোকের সকল রাজন্যবর্গ ও ব্রাহ্মণদের উপর। তাদের আক্রমণে ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ পণ্ড হ’লো; এবং মুনিরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হলে তাঁরা অসুরভাইদের অভিশাপ দিতে লাগলো। যদিও ব্রহ্মার বরে সেই সকল অভিশাপ ব্যর্থ হলো। তখন ব্রাহ্মণ ও মুনি-ঋষিরা উদ্ভ্রান্তের মতো পলায়ন করে প্রাণ বাঁচাতে লাগলেন। এককথায় সুন্দ-উপসুন্দের আক্রমণ ও অত্যাচারে ত্রিভুবনবাসী ঐ পরিস্থিতিতে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন ।

তখন সকল দেবতা-সহ মুনি-ঋষিগণ অনন্যোপায় হয়ে ব্রহ্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হলেন। তাঁরা সেখানে প্রজাপতির কাছে ত্রিলোকবাসীর দুরবস্থার কারণ ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে তার প্রতিকারের জন্য তাঁর কৃপা ও পরামর্শ প্রার্থনা করলেন। ব্রহ্মা বিস্তারিতভাবে সব কিছু শুনে সামান্যক্ষণ চিন্তা করে বিশ্বকর্মাকে ডেকে বললেন— “হে বিশ্বকর্মা! তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো একজন সর্বাঙ্গসুন্দরী কামিনী নির্মাণ করো।”

ব্রহ্মার আদেশ পেয়ে বিশ্বকর্মা এক সর্বাঙ্গসুন্দরী লক্ষ্মীরূপা নারী নির্মাণ করলেন । সেই ললনা রত্নসমূহের তিল তিল অংশ নিয়ে নির্মিত হয়েছিলেন বলে ব্রহ্মা তাঁর নাম দিলেন ‘তিলোত্তমা’। ব্রহ্মাকে দর্শন করে তিলোত্তমা কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন— “ভগবন। কি উদ্দেশ্যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন, দয়া করে তা বলুন।”

ব্রহ্মা বললেন— “তিলোত্তমে! তুমি সুন্দ ও উপসুন্দের কাছে যাও। তাদের তুমি তোমার অলোকসামান্য রূপ-মাধুরী দিয়ে এমনভাবে প্রলোভিত করো, যাতে তারা পরস্পর বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।”

তিলোত্তমা এরপর ‘তাই হবে' বলে পিতামহকে নমস্কার এবং তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর একে একে সকল দেবতাদের প্রদক্ষিণ করলেন। তিনি যখন দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রদক্ষিণ করলেন তখন মহাদেবের চতুর্দিক থেকে এক একটি মুখ নির্গত হয়েছিল। তেমনি দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করলে তাঁর সর্বাঙ্গে সহস্র লোচন নির্গত হলো । বলাবাহুল্য, এইভাবে ভগবান মহাদেব চতুর্মুখ এবং বলিনিসূদন

ইন্দ্র সহস্রলোচন হয়েছিলেন। তারপর তিলোত্তমা সুন্দ উপসুন্দকে প্রলোভিত করার উদ্দেশ্যে গমন করলেন।

সুন্দ ও উপসুন্দ তখন বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশে এক সুরম্য পরিবেশে অবস্থান করছিলেন। পরিচারকগণ তাঁদের ভোগ ও সেবার জন্য সব ধরণের ভোগ্যবস্তু পরিবেশন করছিল। আর অসুরদ্বয় কামিনীদের নিয়ে প্রমোদ-ক্রীড়ায় মত্ত ছিলেন। নাচ, গান, বাজনা, স্তুতিবাদ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশ হয়ে উঠেছিল মনোমুগ্ধকর। এমন সময় তিলোত্তমা সূক্ষ্ম রক্তবস্ত্র পরিধান করে অপরূপ সাজে সেজে বাগানে ফুল তুলতে শুরু করলেন। তারপর ধীরে ধীরে সুন্দ, উপসুন্দের দিকে এগোতে লাগলেন।

বলাবাহুল্য, দানবদ্বয় তখন সুরাপানে মত্ত ছিলেন। তিলোত্তমাকে হঠাৎ দর্শন করে তাঁরা উভয়েই রোমাঞ্চিত হলেন এবং কামাসক্তি অনুভব করলেন। তারপর তাঁরা আসন ছেড়ে উঠে উভয়েই তিলোত্তমাকে পাওয়ায় আশায় তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলেন। মদোন্মত্ত দুই ভাইর তখন অন্যরূপ।

সুন্দ বললেন- “এ আমার পত্নি। তাই আমি যেহেতু জ্যেষ্ঠ, তাই এই নারী তোমার গুরু হল।”

অন্যদিকে উপসুন্দ বললে— “তা কেন হবে! এই রমণী আমার ভার্যা। তাই তুমি একে ভ্রাতৃবধূ বলে বিবেচনা করো।”

এরপর সুন্দ বললেন— “এ আমার স্ত্রী, তোমার নয়' এবং উপসুন্দ বললেন— 'না না, এ আমার পত্নি তোমার নয়।” এই বলে উভয়ে বিবাদ শুরু করলেন। তারপর ভ্রাতৃত্বের সমস্ত সম্পর্ক মুছে তাঁরা শুরু করলেন ভয়ংকর গদাযুদ্ধ। উভয়ের গদার ঘাত-প্রতিঘাতে অচিরেই দুই অসুর মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং নিমেষে মারা গেলেন।

তারপর ভগবান ব্রহ্মা, অন্যান্য দেবতা সহ অসুরগণ তিলোত্তমার কাছে এলেন। তাঁরা সকলে তিলোত্তমাকে ধন্যবাদ ও প্রশংসাবাক্য শোনালেন। ভগবান ব্রহ্মা বর দিয়ে বললেন— “তিলোত্তমে! সূর্য যে পথে যাতায়াত করেন, তুমি সেই পথে যাতায়াত করতে পারবে। তোমার তেজঃপ্রভাবে কেউই তোমাকে দেখতে পাবে না।”

সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনি বর্ণনা করে নারদমুনি পাণ্ডবদের বললেন— “হে পাণ্ডুপুত্রগণ! এক নারীকে কেন্দ্র করে সুন্দ-উপসুন্দ শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট হয়েছিল। তোমরাও যাতে পাঞ্চালীকে নিয়ে ভবিষ্যতে এমন কোন বিরোধে জড়িয়ে না পড়ো, তাই তোমাদের মধ্যে একটি উপযুক্ত নিয়ম-নীতি গৃহীত হওয়া খুব প্রয়োজন।”