বকাসুর বধ
আমার পরম হিতৈষিণী, নিত্য সহচরী। তুমি আমার সন্তানের জননী। তাই নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য তোমাকে রাক্ষসের হাতে তুলে দেওয়া আমার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয়। ”
স্বামীর কথার প্রত্যুত্তরে ব্রাহ্মণী বললেন- “হে নাথ! আপনার মতো পণ্ডিত ব্যক্তির এমনভাবে শোক করা মানায় না। জীব মাত্রেই মরণশীল। তাই মৃত্যুর জন্য শোক করা বৃথা । স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই আপনার আপন– এমন বিবেচনা ত্যাগ করুন । আমি নিজে ঐ রাক্ষসের নিকট যাব। পত্নী হিসাবে দায়িত্ব পালনের এমন সুবর্ণ সুযোগ আমার আর কী বা হতে পারে ? আমার এই কাজে সংসারে সকলের সুখ হবে। অন্যদিকে আমারও পরলোকে সুখ এবং ইহলোকে যশোলাভ হবে। আমার এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে আপনি প্রচুর পরিমাণে ধন ও অর্থ লাভ করবেন। লোকে বিয়ে করে সন্তান লাভের আশায়। আমাদের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেছে। আপনি এদের প্রতিপালন করতে পারবেন; যা আমার একক প্রচেষ্টায় কখনো সম্ভব
নয়।
ভাবুন তো প্রাণেশ্বর! আপনাকে ছাড়া আমি একা একা কিভাবে বাঁচব ? আপনার সন্তানদের দশাই বা কি হবে ? আমি যদি অনাথ হয়ে বেঁচে থাকি তাহলেও কি এদের রক্ষা করতে পারবো ? বিধবা নারীদের ওপর মাংসলোভী পুরুষেরা সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে— সেক্ষেত্রে আমি কি করব ? আপনি না থাকলে কন্যাটিকে মর্যাদার সঙ্গে বড় করা এবং পুত্রটিকে সদগুণ-সম্পন্ন করা আমার একার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত যে, আপনি না থাকলে আমি বা আপনার সন্তানেরা কেউ কোনভাবেই বাঁচতে পারবো না। তাই রাক্ষসের কাছে আমাকে পাঠান। পতির আগে স্ত্রী'র পরলোক গমন করা সৌভাগ্যের বিষয়। আমি সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে পারবো না, কারণ আমি আপনারই আশ্রিত। কোনো রমণীর পক্ষে যজ্ঞ, তপস্যা ও দানের চেয়ে তার পতিই অধিক গ্রহণীয়। পতির হিত ও পতির প্রিয় কাজ করাই স্ত্রী'র প্রধান কর্তব্য। বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্ত্রী-পুত্র-মিত্র ও ধনাদি সঞ্চয় করা হয়। আবার বিপদের জন্য ধন-সঞ্চয়; ধন সম্পদ হারিয়ে স্ত্রীকে রক্ষা; এবং পত্নী
ও ধন উভয় হারিয়ে আত্মকল্যাণ সম্পাদন করা বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই করে থাকেন।
তবে এমনও হতে পারে- স্ত্রীলোক অবধ্য এই কথা ভেবে রাক্ষস না মেরে হয়তো আমাকে ছেড়েও দিতে পারে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দিন। আজ পর্যন্ত ধর্ম- কর্ম যথাসাধ্য করেছি। পুত্র-কন্যার মাতাও হয়েছি। ফলে আমার আর এ জীবনে কিছু পাওয়ার নেই। আমার মৃত্যু হলে আপনি আবার বিয়ে করতে পারবেন- কারণ
পুরুষদের বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত; কিন্তু নারীদের পক্ষে তা অধর্ম। তাই আমাকে রাক্ষসের কাছে পাঠিয়ে দিন।”
বলা বাহুল্য, পত্নীর এই যুক্তিবিন্যাস শুনে ব্রাহ্মণ তাকে বুকে জড়িয়ে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।
অন্যদিকে পিতা-মাতার এই সব হৃদয়-বিদারক কথাবার্তা শুনে তাঁদের একমাত্র কন্যাটি বললেন- “মাতা! আপনারা কেন এভাবে কান্নাকাটি করছেন ? আপনারা আমার কথা শুনুন। আমাকে কিছুদিন পরে পরের ঘরে যেতে হবে। তার পরিবর্তে আপনারা এখুনি আমাকে পরিত্যাগ করলে এই সংসার আসন্ন বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবে। সন্তান বিপদ থেকে রক্ষা করে বলে লোকে অপত্য কামনা করে। ইহকাল ও পরকালে পরিত্রাণ করে বলে পণ্ডিতগণ সন্তানের নাম 'পুত্র' দিয়েছেন। পিতামহেরা আমার গর্ভে দৌহিত্র জন্ম নেবে এমন আশা করেন। কারণ তাহলে পিগুলোপের ভয় দূরীভূত হবে। আমি আমার বাবার জীবন রক্ষা করে তাঁদের সেই ভয় দূর করতে চাই । আপনি সেখানে গিয়ে প্রাণত্যাগ করলে আপনার দুঃখে অল্পদিনের মধ্যে আমার ভাইটির জীবনে বিষাদ নেমে আসবে। কিন্তু আপনি যদি শুধু আমাকে ত্যাগ করেন তাহলে আমার মা এবং ছোট ভাই উভয়েই রক্ষা পাবে। বংশের সন্তান-সন্ততি ও পিণ্ডদান অক্ষত থাকবে।
শাস্ত্রকারেরা বলেন— 'পুত্র আত্মার স্বরূপ; স্ত্রী সখি-স্বরূপ; কিন্তু কন্যা কৃচ্ছ্র- স্বরূপ । তাই আমাকে পরিত্যাগ করে কৃচ্ছ্র থেকে বিমুক্ত হোন।' হে পিতা! আপনি না থাকলে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না। অনাথিনী ও দীনা হয়ে যত্রযত্র ঘুরে বেড়াতে হবে। আপনি না থাকলে আমাদের কুকুরের মতো দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে দিন কাটাতে হবে। কিন্তু আমাকে রাক্ষসের কাছে পাঠালে আপনারা সকলে বেঁচে যাবেন, এমনকি মৃত্যর পর পরলোকে গিয়ে পরম সুখলাভেরও কোনো অসুবিধা হবে না।”
ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী তাঁদের কন্যার এমন মর্মান্তিক অনুভূতি শুনে তাঁরা আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। তাঁদের শিশু সন্তানটি তখন বললো- “ও বাবা, ও মা, ও দিদি তোমরা কেঁদো না, আমি তো আছি। এই দেখ-আমার হাতে এই যে তৃণটি দেখছো, আমি এর আঘাতে ঐ দুরাত্মা রাক্ষসের প্রাণনাশ করবো।”
তাঁরা তিনজন তখন খুবই বিষণ্ণ থাকলেও শিশু সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে সবাই আনন্দিত হলেন।
কুন্তী এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন দরজার বাইরে; এই অবসরে তিনি তাঁদের কাছে
এসে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন— “আপনারা কেন এত কান্নাকাটি করছেন ? আমাকে খুলে বলুন। আমি সাধ্যমত আপনাদের দুঃখমোচন করতে আগ্রহী। বলুন কি হয়েছে ?”
ব্রাহ্মণ কুন্তীর এই মধুর বাক্য শুনে বললেন— “হে তপোধনে! দুঃখীর দুঃখমোচন করা যেকোন মহৎ ব্যক্তির কর্তব্য। কিন্তু আমরা যে গভীর দুঃখ সাগরে ডুবতে চলেছি তা নিবারণ করা কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। হে দেবী! এই নগরের কাছে ‘বক’ নামে এক রাক্ষস বাস করে। সেই দুরাত্মা এই নগরের অধিপতি। সে এই জনপদ রক্ষা করে। ঐ রাক্ষস তার খাওয়ার জন্য গ্রামে একটি নিয়ম তৈরি করেছে। প্রতিদিন পালা করে এক একটি বাড়ি থেকে একজন মানুষ, কুড়ি মণ চাল, অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ও দুটি মহিষ তাকে দিতে হবে এবং সে সেই বস্তুগুলি সহ মানুষটিকে খেয়ে তার উদর-পূরণ করবে। তার তৈরি এই নিয়মে সকলেই অসন্তুষ্ট। কিন্তু এই নিয়ম যখনই কেউ ভেঙেছে, রাক্ষস তৎক্ষণাৎ সেই বাড়ির সকলকে হত্যা করে গোগ্রাসে ভোজন করেছে।
এই প্রদেশের সামান্য দূরে বেত্রকীয়-গৃহ নামে এক নীতিজ্ঞানহীন রাজা আছেন। নগরবাসীর ভালোমন্দ বিষয়ে তিনি চরম উদাসীন। তাই আমরা এই ঘোর অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারছি না। শাস্ত্রে বলে— 'লোকে প্রথমে রাজার আশ্রয় গ্রহণ করবে, তার পরে পত্নী এবং শেষে ধনাদি সঞ্চয় করবে— কারণ এই তিন সমৃদ্ধি দ্বারা জ্ঞাতি- বন্ধু-পুত্রকে রক্ষা করা যায়।' আমার দুর্ভাগ্য যে, এই তিন বিষয়ই আমার অনুকূল নয় । আজকে আমার পালা- রাক্ষস-নির্দিষ্ট একজন মানুষ সহ অন্যান্য ভোগ্য-বস্তু তার কাছে প্রেরণ করার। রাক্ষসের কাছে পাঠানোর জন্য চালপত্র জোগাড় করেছি। কিন্তু যথেষ্ট টাকা আমার নেই যাতে একজন মানুষ কিনে পাঠাতে পারি। আবার নিজের কাউকে যে পাঠাব তাও সম্ভব নয়। এমনই এক গভীর সঙ্কটে আজ আমরা পড়েছি। তাই সবাই আমরা এত বিষ, দুঃখে কাঁদছি।”
ব্রাহ্মণের পরিবারের সঙ্কটের কারণ শুনে কুন্তী বললেন- “হে ব্রাহ্মণ! আপনি দুঃখ করবেন না। ঐ দুরাত্মার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি একটি উপায় ভেবেছি। আপনার একটি মাত্র সন্তান, সে আবার শিশু। কন্যাও একটি। আপনি বা আপনার স্ত্রী'র পক্ষেও সেখানে যাওয়া যথার্থ নয়। আমার পাঁচ পুত্র, তাদের মধ্যে একজনকে বলছি, যে আপনার শুভার্থী হয়ে সেই রাক্ষসের কাছে যাবে।”
ব্রাহ্মণ তা শুনে অবাক হয়ে বললেন- “ও মা! একে আপনারা ব্রাহ্মণ, তাও আবার আমাদের অতিথি! অতি নির্বোধ ব্যক্তিও নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য কখনো
ব্রাহ্মণের প্রাণনাশ করে না। তাই ব্রাহ্মণ বধ বা আত্মাহুতি— এই দুয়ের মধ্যে আত্মাহুতিই আমার কাছে শ্রেয়। কারণ ভুল করেও ব্রাহ্মণ হত্যা করলে তার পাপ থেকে নিস্তার নেই।
পণ্ডিতেরা বলেন— অতিথি, আশ্রয়প্রার্থী এবং ভিক্ষুক এদের বধ করা নৃশংস মানসিকতার পরিচয়।
প্রাজ্ঞরা বলেছেন— হননের মতো নিন্দনীয় কাজ কখনোই করা উচিত নয়। তাই আমি স্থির করেছি আমি ও আমার স্ত্রী দুজনে একসঙ্গে গিয়ে রাক্ষসের হাতে মৃত্যুবরণ করবো। তাই বলে ব্রাহ্মণ বধের মতো কোন কাজে কখনোই রাজি হবো না।”
কুন্তী বললেন— “হে ব্ৰাহ্মণ! আপনি যথার্থ বলেছেন— 'ব্রাহ্মণ অবশ্যই রক্ষণীয়।' হ্যাঁ, এটি ঠিক যে, শত পুত্র থাকলেও কোন মা কখনো চাইবেন না তাঁর কোনো একজন পুত্রকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে। তবে আমি জানি, রাক্ষস কখনোই আমার পুত্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমার পুত্র খুবই বলবান, তেজস্বী এবং ঈশ্বরাশীর্বাদ-পুষ্ট। সে রাক্ষসের কাছে ভোজ্য বস্তুগুলি নিয়ে যাবে এবং তার কাছ থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসবে। আমি অনেকবার দেখেছি সে অনেক শক্তিশালী বিশাল বড় বড় রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের নিধন করেছে। আমার অনুরোধ, এই কথা আপনি আর কাউকে বলবেন না। এ খবর জানাজানি হলে, কৌতূহলী হয়ে অনেকে তখন আমার ছেলেদের বিরক্ত করবে। আমাদের এখানে থাকতে অসুবিধা হবে।”
ব্রাহ্মণ কুন্তীর এই আশ্বাসবাণী শুনে খুবই আনন্দিত হলেন। এবং তাঁরা সস্ত্রীক কুন্তীকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তারপর মাতা কুন্তী এবং ব্রাহ্মণ ভীমসেনের কাছে গেলেন। তাঁকে রাক্ষস নিধনের জন্য তার কাছে যেতে অনুরোধ করলেন। বলাবাহুল্য, ভীমসেন তাঁদের অনুরোধ স্বীকার করলেন।
অন্যদিকে, যুধিষ্ঠির সহ চার ভাই ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরে জানতে পারলেন যে, ভীমসেন ভয়ংকর ‘বক রাক্ষস' বধের সংকল্প করেছেন। যুধিষ্ঠির একান্তে মাতা কুন্তীকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- “মাতা! এই কঠিন কাজটি করার জন্য ভীম কি একা একা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, না আপনার অনুমতি নিয়ে সে তা করতে ব্রতী হয়েছে।”
কুন্তী বললেন— “বৎস! ভীমসেন আমার আদেশ অনুসারে ব্রাহ্মণ পরিবার ও নগরবাসীদের কল্যাণের জন্য এই কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
যুধিষ্ঠির প্রত্যুত্তরে বললেন— “মাতা! আপনি অপরের সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের পুত্রের প্রাণনাশের ঝুঁকি নিয়েছেন। মনে রাখবেন আপনার এই পুত্র এখন আমাদের সকলের আশা, ভরসা ও প্রধান অবলম্বন। তার পরাক্রমের কথা চিন্তা করে দুর্যোধন, শকুনি সহ কৌরবরা বিনিদ্র রজনী কাটায়। তারই সাহসিকতা ও সামর্থ্যের গুণে আমরা জতুগৃহ সহ অন্যান্য কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছি। তাই কেন যে আপনি এমন এক ভয়ংকর কাজে তাকে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তা, আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”
কুন্তী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “তুমি অযথা আশঙ্কিত হচ্ছো যুধিষ্ঠির। দেখ, আমরা এই ব্রাহ্মণের বাড়িতে বাস করছি, কৌরব সন্তানেরা তা জানে না। ব্রাহ্মণ আমাদের যথেষ্ট সম্মান করেন। তাই এই উপকারী ব্রাহ্মণের মঙ্গলের জন্য আমরা এই কাজ করছি। যে ব্যক্তি উপকার গ্রহণ করে, তার উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি উপকার প্রত্যর্পণ করা। ভীমসেনের শক্তি মত্ত হাতির সমান। আমার মনে হয় পুরুষোত্তম চক্রপাণিকেও সে জয় করতে পারে।
মা হয়ে বুঝতে পেরেছি তার ক্ষমতা কতখানি! তাই তাকে এই ভয়ংকর কাজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কাজ করে আমাদের দুটি মহৎ কাজ হবে। এক, আমরা আশ্রয়দাতার উপকারের প্রতিদান দিতে পারব; দুই, এটি একটি মহৎ ধৰ্ম্মানুষ্ঠান।”
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ একসময় আমায় বলেছিলেন— ‘যে ক্ষত্রিয় কোন ব্রাহ্মণের উপকারে সাহায্য করে সে শুভলোক লাভ করে; যে ক্ষত্রিয় কোন ক্ষত্রিয়ের প্রাণরক্ষা করে, সে ইহকাল ও পরকালে যশস্বী হয়, যে ক্ষত্রিয় কোন বৈশ্যের উপকার করে, সে প্রজারঞ্জক হয়। এবং যে ক্ষত্রিয় কোন শরণাগত শুদ্রকে বিপদমুক্ত করে সে উচ্চ ক্ষত্রিয়কুলে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে ধন্য হয়” ।
মাতা কুন্তীর মুখে এমন শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন- “আপনি আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণ পরিবার ও নগরবাসীগণের উপকারের জন্য ভীমসেনকে পাঠাচ্ছেন তাতে কোন ভুল নেই। কিন্তু দয়া করে ব্রাহ্মণকে বলবেন যে, নগরবাসীগণ এই ঘটনাসমূহ যেন জানতে না পারে। আমাদের পরিচয় যেন জনসমক্ষে না আসে।”
এরপর রাত্রির অবসান ও প্রভাত হলে ভীমসেন অন্নাদি সহ খাদ্যবস্তুগুলি নিয়ে রাক্ষসের নিকট গমন করলেন। সেখানে পৌঁছে বক রাক্ষসকে ডাকতে ডাকতে নিয়ে যাওয়া খাদ্যসামগ্রী নিজেই খেতে শুরু করলেন। দীর্ঘদেহী রাক্ষস, ভীমের ডাক শুনে
তাঁর সামনে এলো। এবং যখন দেখলো যে, নিয়ে আসা অন্নাদি ভীম তার সামনেই খাচ্ছেন; তখন সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো। বলল- “ওরে দুর্বুদ্ধি! আমার সামনেই আমার জন্য আনা খাদ্য খাচ্ছিস ? তোর কি যমালয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে ?”
ভীমসেন রাক্ষসের কথায় কর্ণপাত না করে আগের মতো দিব্যি খাওয়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। রাক্ষস তখন ভীমের কাছে এসে তার পিঠে সপাটে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে লাগল। বৃকোদর সেই আঘাতে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আপনমনে খাওয়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। এরপর খাওয়া শেষ করে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। রাক্ষস ততক্ষণে নানারকম বৃক্ষশাখা এনে ভীমসেনকে প্রহার করতে শুরু করেছে। ভীমসেন ও উপযুক্ত বৃক্ষশাখা সংগ্রহ করে তার উপর প্রত্যাঘাত করতে লাগলেন।
বক তখন বলল— “ওরে দুরাত্মা! তুই আজ বক নিশাচরের পাল্লায় পড়েছিস। তোর আর নিস্তার নাই।”
এরপর শুরু হলো উভয়ের মধ্যে ভয়ংকর মল্লযুদ্ধ। ভীমসেনের উপর্যুপরি প্রহারে রাক্ষস ক্রমশ ক্লান্ত হতে লাগলো। তারপর সুযোগ বুঝে ভীমসেন রাক্ষসকে মাটিতে ফেলে তাকে চরম প্রহার করতে লাগলেন। বারবার আঘাত সহ্য করতে করতে বক এক সময় তীব্র চিৎকার করতে করতে রক্তবমি করতে লাগল। এবং একটু পরে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ল । সেই তীব্র চিৎকার শুনে রাক্ষসের পরিবারের অন্যান্য সকলে ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। ভীম তখন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “তোমরা প্রতিজ্ঞা করো আজ থেকে আর নরহত্যা করবে না। যে রাক্ষস এরপর নরহত্যা করবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে সংহার করবো।”
রাক্ষসগণ “যে আজ্ঞা” বলে ভীমের আদেশে সম্মতি জানাল। এরপর ভীমসেন সেই বকনিশাচরের মৃতদেহ রাক্ষসের বাড়ির উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। একটু পরে ব্রাহ্মণের বাড়িতে এসে যুধিষ্ঠিরের নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন।
পরের দিন সকালে নগরবাসীগণ বকরাক্ষসের মৃত্যু সংবাদে উল্লসিত এবং রোমাঞ্চিত হয়ে একচক্রা নগরীতে খবরটি প্রচার করলেন। গতকাল কার পালা ছিল এই আলোচনা করতে গিয়ে তারা জানতে পারলেন, ব্রাহ্মণের পালাতেই ভয়ংকর রাক্ষসের এই অবিশ্বাস্য পরিণতি ঘটেছে। তখন তাঁরা একত্রিত হয়ে ব্রাহ্মণকে এই বিষয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
ব্রাহ্মণ সকলকে বললেন- “হে পৌরগণ! রাক্ষসের আহার যোগাড় করতে
অপারগ হয়ে আমরা যখন বাড়ির সকলে কাঁদছিলাম তখন এক আগন্তুক মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ আমার সামনে উপস্থিত হন। তিনি বলেন, যে চিন্তা করবেন না আমি অন্ন নিয়ে ঐ দুরাত্মা রাক্ষসের কাছে যাবো। সেই অনুসারে তিনি রাক্ষসের কাছে যান এবং তাঁর দ্বারাই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে।”
আলোচ্য গল্পটির বিষয়বস্তু খুবই মর্মস্পর্শী। একটি পরিবারে স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানাদি প্রত্যেকের অটুট আত্মিক বন্ধন যে কতটা সুদৃঢ় তা এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। আবার প্রত্যেক সদস্য অপর সদস্যদের প্রতি কতখানি সহানুভূতিশীল, তা যুক্তি ও শাস্ত্র ব্যাখ্যার দ্বারা বোঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে অতিথি ভগবতী কুন্তী এবং তাঁর সন্তান ভীমসেন আশ্রয়দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য জীবন বাজি রেখে যে দুরূহ কর্তব্য পালন করছেন, সেই শিক্ষার শিকড় প্রাচীন ভারতীয় সমাজ চেতনা ও মূল্যবোধের গভীরে প্রোথিত। মহাভারতের ‘আদি পর্বে ১৫২-১৫৫তম অধ্যায়ে এই গল্পটি লিপিবদ্ধ আছে।
0 Comments