কৌশিক ব্রাহ্মণের আত্মোপলব্ধি

কৌশিক ব্রাহ্মণের আত্মোপলব্ধি


মার্কণ্ডের যুধিষ্ঠিরকে বললেন- “হে রাজন! বিপ্লব কৌশিক পতিব্রতা সেই রমণীর ধর্ম-বিষয়ক ব্যাখ্যা শুনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। নিজেকে অপরাধীর মতো ভাবছিলেন। তাঁর মনে অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশার তিনি মিথিলার উদ্দেশে যাত্রা করলেন, যেখানে সেই ধর্মব্যাধ বাস করতেন। এরপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তিনি এক সময় মিথিলার উপস্থিত হলেন। সেখানে ধর্মব্যাধের

ঠিকানা জানতে চাইলে সেখানকার ব্রাহ্মণেরা তা বুঝিয়ে তাঁকে বলে দিলেন। সেই অনুসারে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে হিজবর দেখলেন যে, ধর্মব্যাধ একটি কসাই খানায় বসে আছেন। হরিণ ও মহিষের মাংস বিক্রি করছেন। মহাত্মা কৌশিক তখন ক্রেতাদের ভীড়ের মাঝে এককোণে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলেন। ততক্ষণে ব্যাধ মনে মনে সবকিছু বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণকে বললেন- “বিপ্লব: প্রণাম, আপনার সবকিছু কুশল তো ? আমি জানি, সেই পতিব্রতা রমণীর কথায় আপনি এখানে এসেছেন। এখন বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।”

কৌশিক ব্রাহ্মণ ব্যাধের প্রাথমিক আপ্যায়নে মুগ্ধ হলেন। তারপর যখন বুঝলেন যে, তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যও ব্যাধ ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। তাতে তিনি রীতিমত

বিস্মিত হলেন।

তারপর ব্যাধ বললেন- “ভগবন্! এই অজানা, অচেনা দেশে আপনি এসেছেন। তাই যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে আমার বাড়িতে চলুন।”

সেই অনুরোধ ব্রাহ্মণ স্বীকার করলে ব্যাধ তখন তাঁকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তারপর তাঁকে পাদ্য, অর্ঘ্য, আসন, আচমনীয় ইত্যাদি সহযোগে আপ্যায়ন করে তার বসার ব্যবস্থা করলেন।



হঠাৎ মলত্যাগ করে। ব্রাহ্মণ উঠে পাড়ালেন। তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে কে এমন কাজ করেছে তা খুঁজতে খুঁজতে বকটিকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বকটির দিকে স্থির হয়ে তাকালেন। এবং তার ফলে একটি নিমেষের মধ্যে মারা গেল। তার নিথর দেহটি মাটিতে পতিত হল। এভাবে আকস্মিক ভাবে বকটি মারা গেলে ব্রাহ্মণের মনে করুণার উদয় হলো। “না, না আমি বকটিকে মেরে মোটেই ঠিক কাজ করিনি।” এই কথা বারবার মনে মনে উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণ অনুতাপ করতে লাগলেন।

অনুতপ্ত বিপ্লবর এরপর ভিক্ষার উদ্দেশ্যে একটি গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে শুরু করলেন। এর মধ্যে একটি গৃহে তিনি ভিক্ষা চাইলে গৃহপরি বললেন- “ মহাশয়! একটু অপেক্ষা করুন। আমি আপনার জন্য ভিক্ষা নিয়ে আসছি।”

এই বলে বাড়ির ভেতরে গিয়ে তিনি ভিক্ষা পাত্রটি পরিষ্কার করছেন, এমন সময় তাঁর স্বামী অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধাতুর হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। স্বামীকে দেখেই তিনি তাঁকে পা-ধোয়ার জল, আসন এবং অন্যান্য ভাল-মন্দ খাদ্য সামগ্রী দিয়ে তাঁর সেবা-যত্ন করতে লাগলেন। আর বাড়ির বাইরে ভিক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।

প্রসঙ্গত, এই মহিলাটি প্রত্যেকদিন স্বামীর উচ্ছিষ্ট ভোজন করতেন। তাঁর স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে, সেবা, যত্ন এবং মনোরঞ্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু মনযোগ দিয়ে করতেন। পরিবারের অন্য সকলের প্রতি তাঁর কর্তব্য নিষ্ঠাও ছিল একই রকম। একটু পরে স্বামীর সেবা করতে করতে তাঁর হঠাৎ মনে পড়লো বাড়ির বাইরে অপেক্ষারত ভিক্ষা-প্রার্থী ব্রাহ্মণের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভিক্ষা পূর্ণ গাত্র হাতে নিয়ে সলজ্জ হয়ে ব্রাহ্মণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে ব্রাহ্মণ রাগান্বিত হয়ে বললেন- “আমাকে কেন তুমি অকারণে দাঁড় করিয়ে রাখলে ? সঙ্গে সঙ্গে বিদায় করে দিলে না কেন ?”

প্রতিব্রতা রমণী তখন বিপ্লবরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “হে বিদ্বন! আমার অপরাধ মার্জনা করবেন। এই মাত্র আমার স্বামী ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়িতে এসেছেন। আমি তাঁর সেবা করতে গিয়ে আটকে পড়েছিলাম। আমি তাঁকে দেবতা জ্ঞানে দেখি। তাই আপনাকে ভিক্ষা দিতে বিলম্ব হলো।”

ব্রাহ্মণ বললেন- “তুমি ব্রাহ্মণকে যথাযথভাবে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিতা কেন ? তুমি পতিকে সেবা করতে যতখানি তৎপর কিন্তু ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে তার বিন্দুমাত্র

প্রকাশ দেখি না। ও হে গর্বিতা রমণী। তোমার অবগতির জন্য বলছি মানুষের কথা কোন ছার, স্বয়ং ইন্দ্র ও দেব-দ্বিজকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে থাকেন। ব্রাহ্মণেরা অগ্নি সদৃশ। তাঁরা চাইলে জগৎ-সংসার নিমেষের মধ্যে জ্বালিয়ে দিতে পারেন।”

গৃহস্থ-রমণী বললেন- “হে তপোধন। ক্রোধ সম্বরণ করুন। আমি আপনার দেখা সেই বক নই । আপনার অগ্নিমূর্তি দিয়ে আমার কি ক্ষতি করবেন ? আমি ব্রাহ্মাগদের তেজ ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত। ব্রাহ্মণের ক্রোধের প্রভাবে সমুদ্রের জল নোনতা এবং পানের অযোগ্য হয়ে যায়। আমি এও জানি যে, কিভাবে তেজস্বী মুনি-ঋষিদের ক্রোধানলে দণ্ডকারণ্য ভস্মীভূত হয়েছিল। অগস্ত্যমুনির তেজস্বীতায় ভয়ংকর বাতাপি কেমন মুহূর্তে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

হে বিপ্রবর! বাড়ির বৃদ্ধাদের মুখ থেকে শুনেছি যে, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণের গুনের শেষ নেই। তাঁদের ক্রোধ যেমন অসীম, তেমনি প্রসাদও অনন্ত। তাই আপনাকে নত মস্তকে প্রণাম জানিয়ে বলি দয়া করুন, আমার এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধ মার্জনা করুন।

তবে অপরাধ যদি না নেন, তাহলে বলি আমার কাছে স্বামী-সেবা হলো আমার প্রধান ধর্ম। শুধু আমার কাছে নয় যেকোন স্ত্রীলোকের কাছে তাঁর স্বামী দেবতাদের ন্যায় শ্রদ্ধার পাত্র। এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস অটুট। প্রমাণ হিসাবে দেখুন আপনার কোপানলে পড়ে বকটি কেমন সঙ্গে সঙ্গে ভস্মীভূত হয়েছে। আমি তা জনতে পেরেছি। যদিও আমার কিছুই হয়নি।

হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠ! আমি সামান্যা নারী। আমি জানি ক্রোধ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু । যিনি ক্রোধ-বিমুক্ত, সব সময় সত্য কথা বলেন, গুরুজনদের শ্রদ্ধা-ভক্তি দিয়ে যোগ্য মর্যাদা দেন, তিন কখনো হিংসা করেন না। তিনি সব সময় শুদ্ধাচারী, ধর্মপ্রাণ, জিতেন্দ্রিয়

এবং স্বাধ্যায়ে নিযুক্ত থাকেন। কাম-ক্রোধ-লোভ প্রভৃতি ক্ষতিকারক রিপুগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

দেবগণ তাঁকেই ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করেন যিনি যজন, যাজন, পড়াশুনা, অধ্যাপনা দান-ধ্যান এবং ব্রহ্মচর্য পালন করে জীবন কাটান। বেদ অধ্যয়নের মাধ্যমে পরমাত্মার

স্বরূপ অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকেন। ব্রাহ্মণগণ সব সময় সত্য কথা বলেন। তাঁদের মানে কখনো মিথ্যাভাব আসে না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন যে, শাশ্বত ধর্মের মর্মার্থ বোঝা বেশ কঠিন কাজ। কারণ ঐ ধর্মের মূল আধার হলো সত্য। তাই ধর্ম নানা প্রকার হলেও তার বিষয়বস্তু অতি সূক্ষ্ম। আপনি স্বাধ্যায়ী, ধর্ম এবং শুদ্ধচিত্তের হলেও যথার্থ ধর্ম সম্পর্কে আপনার

সরস্বতী বললেন- “তাক্ষ! স্বাধ্যার রূপ যোগে রত, তপস্যা ও সাধনাকে যে সব যোগী পুরুষ অবলম্বন করে আছেন, তাঁরা ব্রত, পূণ্য এবং যোগবলের দ্বারা যে শাশ্বত পরম ধন লাভ করে বীতশোক অর্থাৎ দুঃখ কষ্ট ভুলে এক শান্ত সমাহিত জীবন যাপন করেন, সেই পরম ধনই হলো ব্রহ্ম বা পরমাত্মা। সেই পরম ব্রহ্ম হলো ব্রহ্মাণ্ডরূপী একটি অচিন্ত্যনীয় বিশাল বৃক্ষ, তা ভোগস্থানরূপী অনন্ত শাখা-প্রশাখাযুক্ত, শব্দাদি বিষয়ের পবিত্র সুগন্ধে পরিপূর্ণ। সেই ব্রহ্মাণ্ডরূপী বৃক্ষের মূলাধার হ’ল অবিদ্যা। এই অবিদ্যা থেকেই ভোগ-বাসনা-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে এক অনন্ত নদী সৃষ্টি হয়েছে। এই নদীগুলি দূর থেকে দেখলে বেশ রমণীয়, সুগন্ধযুক্ত, সুমিষ্ট জলের ন্যায় তৃপ্তিপ্রদানকারী বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তা নিষ্ফলা, বহু ছিদ্রযুক্ত, শুকনো পাতার মতো জীর্ণ, অসার। আপাতত এগুলি অমৃতের মতো সুস্বাদু লাগলেও মনকে মলিন করে।

হে মুনি! ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ সহ আর যত দেবতা যে ব্রহ্মকে লাভ করার জন্য নিরন্তর পূজা, হোম, যজ্ঞ করে চলেছেন আমারও আশ্রয় হলো সেই পরম পদযুগল। আমার উপদেশ, তুমিও সে পথের পথিক হও।”


Post a Comment

0 Comments