অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
সর্বকালের সর্বসেরা পদার্থ- বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইনস্টাইন। অনেকের মতে আইনস্টাইন ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জার্মানির উলম শহরে 1897 খ্রীস্টাব্দের 14 ই মার্চ এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অ্যালবার্টের বাবা হেরম্যান আইনস্টাইন ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার এবং ব্যবসায়ী। অ্যালবার্টের মা পাউলিন ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন মা-বাবার প্রথম সন্তান। হেরম্যান আইনস্টাইন তার ব্যবসার কাজকর্মে খুব দক্ষ ছিলেন না। অ্যালবার্টের জন্মের এক বছর পর ব্যবসার কারণে আইনস্টাইনের পরিবার উলম শহর ছেড়ে মিউনিখ শহরে চলে আসেন। এই মিউনিখ শহরে হেরম্যান ও তার ভাই জেকব মিলে ইঞ্জিনীয়ারিং দ্রব্যাদি নির্মাণের কারখানা খোলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বাল্যকালে পড়াশুনায় খুবই সাধারণ মানের ছিলেন। তবে হেরম্যান আইনস্টাইন চাইতেন যে তার ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখুক। সেজন্য আইনস্টাইন পরিবার মাঝে মাঝেই মিউনিখ শহরের আশেপাশের গ্রামগুলিতে বেড়াতে যেতেন। তবে অ্যালবার্ট শৈশব থেকেই কিছুটা মুখচোরা স্বভাবের ছিলেন এবং চুপচাপ বসে থাকতেই পছন্দ করতেন। অ্যালবার্টের মা পাউলিন ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন এবং গানও গাইতে পারতেন। পিয়ানোর সুর মাধুর্য খুবই তন্ময় হয়ে শুনতেন বালক অ্যালবার্ট। সেজন্য বালক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মাত্র ছ বছর বয়স থেকেই বেহালা বাজানো শিখতে শুরু করলেন। পরবর্তীকালে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অবসর পেলেই বেহালা বাজাতেন। এই বেহালা বাজানোই ছিল তার অবসর কাটানোর অন্যতম উপায়। পরবর্তীকালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যখন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তখন এই বিজ্ঞানী মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেহালা বাজানোর জন্য আমন্ত্রিতও হতেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমগ্র জার্মানী জুড়ে প্রচন্ড ইহুদী বিদ্বেষ ছিল। সেই সময় জার্মানীতে সম্প্রদায়গতভাবে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার প্রচলন ছিল বেশী। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদী। ইহুদীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অ্যালবার্টের বাড়ী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ছিল। তাছাড়া এই বিদ্যালয়ে পড়ার খরচও ছিল অনেক বেশী। সেজন্য অ্যালবার্টকে ওই স্কুলে ভর্তি না করে কাছাকাছি এক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। ছয় বছর বয়সে অ্যালবার্টের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। জার্মানীতে থাকবার সময় ছাত্রজীবনে অ্যালবার্টকেও ইহুদীবিদ্বেষের অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ইহুদীদের প্রতি জার্মানীদের বিদ্বেষমূলক ব্যবহারের কথা ভবিষ্যৎ জীবনেও ভুলতে পারেননি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
ছেলেবেলায় অ্যালবার্ট ছিলেন খুবই নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির। বন্ধুদের সাথে তিনি খুব একটা মেলামেশাও করতেন না। সেই সময় জার্মানীতে ও সমগ্র ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে এক দেশের সাথে অন্য দেশের প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। সেজন্য জার্মানীর মিউনিখ শহরে বেশীরভাগ সময়েই মিলিটারী ব্যান্ডের বাজনা শোনা যেত এবং সৈন্যরা তাদের মিলিটারী পোষাক পড়ে ব্যান্ডের তালে তালে কুচকাওয়াজ করত। মিউনিখ শহরের বেশীরভাগ রাস্তা জুড়ে এই কুচকাওয়াজ চলত। মিউনিখ শহরের বেশীরভাগ শিশু ও ছাত্রদের কাছে এই দৃশ্য বড়ই প্রিয় ছিল। তবে বালক অ্যালবার্ট সৈন্যদের এই ব্যান্ডের বাজনা ও তাদের কুচকাওয়াজে খুবই ভয় পেত ।
ছাত্রজীবনে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কখনই খুব ভাল রেজাল্ট করতে পারেননি। সেই সময় তার রেজাল্ট ছিল খুবই সাধারণ মানের। ভাষা ও ইতিহাস বিষয় পড়তে তিনি খুব একটা আনন্দ বা উৎসাহ পেতেন না। কোনও বিষয়ের পড়া পরে মুখস্থ করা এবং পরদিন স্কুলে নিয়ে শিক্ষকের সামনে সেইসব পড়া গড় গড় করে মুখস্থ বলা—এসব পদ্ধতি তাঁর কাছে প্রিয় ছিল
না। তবে কোনও জিনিষ তার কাছে একবার আকর্ষণীয় মনে হলে সে বিষয়ে খুঁটিনাটি জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। অ্যালবার্ট যখন খুবই ছোট ছিলেন, তখন তাঁর বাবা তাঁকে একটা কম্পাস কিনে দেন। এই কম্পাস ও কম্পাসের কাঁটাটির নড়াচড়া তাঁর মনে প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। এই প্রসঙ্গ চুম্বকত্ব কেন সৃষ্টি হয়, কেনই বা সবসময় চুম্বকের কাঁটাটি উত্তর-দক্ষিণ দিক করে থাকে সে বিষয়ে নানান প্রশ্ন করে বাবা ও কাকাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিতেন।
অ্যালবার্টের বয়স যখন দশ বছর, তখন তাকে লুইটপোল্ড জিমন্যাসিয়ামে ভর্তি করে দেওয়া হল। কিন্তু তার কাছে পুরোনো স্কুলের মত নতুন স্কুলও ভাল লাগলো না। এই নতুন স্কুলেও অ্যালবার্ট পড়াশোনায় ভাল করে মনোনিবেশ করতে না পারায় স্বাভাবিক কারণেই তাঁর বাবা মা তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বেশীরভাগ শিক্ষকের পড়ানো পদ্ধতি অ্যালবার্টের কাছে খুবই নিষ্প্রাণ ও যান্ত্রিক মনে হত। সেজন্য অ্যালবার্ট তার বাল্যকালের লেখাপড়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন-“প্রাথমিক শিক্ষকরা আমার কাছে সার্জেন্টের মতন আর নতুন এই লুইটপোল্ড জিমন্যাসিয়ামে মাস্টারমশায়রা সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এর মতন।” তবে লুইটপোল্ট জিমন্যাসিয়াম শিক্ষাকেন্দ্রের মি: রুয়েস নামে এক শিক্ষক অ্যালবার্টের জীবনে খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। মি: রুয়েস ছাত্রদেরকে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য, শিক্ষার সঙ্গে সত্যর সম্পর্ক বিষয়ে মূল্যবান কথা বলতেন। এছাড়া মি: রুয়েস ছাত্রদেরকে গ্যাটে, সেক্সপীয়ারের রচনা খুবই মনোগ্রাহী করে শোনাতেন। ছাত্র অ্যালবার্ট এইসব বিষয়গুলি শুনে খুবই আনন্দ ও অনুপ্রেরণা লাভ করত। এই সময় অ্যালবার্টের কাকা জেকবও সুন্দর সুন্দর উদাহরণ সহযোগে বীজগণিত শেখাতেন। এর ফলে বালক অ্যালবার্টের মনে গণিতের নানারকমের ভাবনা চিন্তার ঢেউ সৃষ্টি হয়। কিন্তু স্কুলের কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক তার অনিসন্ধিৎসু মনের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত না। এই সময় এক মেডিক্যাল ছাত্র ট্যালমি তার কাছে ঠিক যেন ঈশ্বরপ্রেরিত দুত হিসাবে উপস্থিত হন। আইনস্টাইন পরিবারে একটা ভাল রীতির প্রচলন ছিল—তাদের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার মিউনিখ শহরে পড়তে আসা বহিরাগত এক গরীব ছাত্রকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো। ম্যাক্স ট্যালমি ছিলেন এইরকম এক গরীব ছাত্রর আইনস্টাইনদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ ছিল। ম্যাক্স ট্যালমির আসল বাড়ী ছিল পোলান্ডে—সে জার্মানিতে মেডিক্যাল পড়তে এসেছিল। ট্যালমির কাছে বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক বেশ কয়েকটি ভাল বই ছিল। ট্যালসির সেই সব বইগুলি পড়ে অ্যালবার্ট বিজ্ঞানও গণিত পাঠে উৎসাহিত হন। অ্যালবার্ট ও ট্যালমির মধ্যে বয়সের ফারাক অনেক হলেও তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নানান ঘটনা ও দর্শন বিষয়ে ট্যালমির ভাবনা অ্যালবার্টের কাছে অনেক যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হত। ট্যালমির সংস্পর্শে এসেই তাঁর মনে দর্শনপাঠ বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় এবং তিনি তখন দেকার্তে, স্পিনোজা প্রভৃতি দার্শনিকদের রচনাগুলিও পড়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে আইনস্টানের জীবনে এইসব বিখ্যাত দার্শনিকদের চিন্তাধারা খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মিউনিখে কয়েকবছর অতিবাহিত হতে না হতেই হেরমান আইনস্টাইনের ব্যবসার মন্দা দেখা দিল। হেরমান সেজন্য মিউনিখ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলেন। জার্মানীতে তখন ইহুদীদের বসবাস করা খুব একটা সুখদায়ক ছিল না। সেজন্য হেরমান আইনস্টাইন ও তার ভাই জেকব ইটালির মিলান শহরে বসবাস করা ও ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু পড়াশুনা শেষ না হওয়ায় অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মিউনিখেই রয়ে গেলেন- তিনি হেরমানের এক বন্ধুর বাড়ীতে থাকতে লাগলেন। পরিবারের সব সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই অ্যালবার্ট একাকী ও অসুখী বোধ করতে লাগলেন। অ্যালবার্টও সেজন্য মিউনিখ ছেড়ে ইটালী চলে যেতে মনস্থ করলেন।
ইটালীর মিলান শহর কিশোর অ্যালবার্টকে খুবই মুগ্ধ করল। ইটালীর অতিপ্রাচীন মিউজিয়ম, আর্টগালারী এবং সুন্দর সুন্দর রাজপ্রাসাদ অ্যালবার্টকে খুব মুগ্ধ করল। কিন্তু অ্যালবার্ট পড়াশোনা শেষ না করে মিলানে চলে আসায় স্বাভাবিক কারণে অ্যালবার্টের বাবা ও কাকার চিন্তা খুব বেড়ে গেল। অনেক ভাবনা চিন্তার পর তাঁরা অ্যালবার্টকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের এক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
জুরিখ শহরের পলিটেকনিক অ্যাকাডেমি ছিল ইউরোপের এক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অ্যালবার্ট কিন্তু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না। এই ব্যর্থতায় হেরমান ও জেকব তো ব্যথিত হয়েছিলেন, অ্যালবার্টও এই ব্যর্থতাকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। সেজন্য দ্বিগুণ উদ্যোগে তিনি আরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। দ্বিতীয়বার কিন্তু অ্যালবার্টকে ব্যর্থ হতে হয়নি। এবার তিনি ওই পলিটেকনিকে ভর্তি হবার পরীক্ষায় পাশ করলেন এবং ভর্তিও হলেন জুরিখ শহরের ওই পলিটেকনিকে। জুরিখ শহরের এই পলিটেকনিকে পড়ার সময়ই অ্যালবার্টের জীবনে দারুণ পরিবর্তন দেখা দিল। এখানেই মুখচোরা লাজুক ছাত্র থেকে তিনি পরিণত হলেন এক স্থিতধী এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রে। এখানেই পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্র অধ্যয়নে তার আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই অ্যালবার্ট কৃতিত্বের সাথে স্নাতক হন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই তার বিজ্ঞান শিক্ষার ধারাটাই পালটে গেল। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতবিজ্ঞানের বিভিন্ন দার্শনিক ও বিমূর্ত ধারণার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হল। এই সময়ই তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের আলোক তরঙ্গর বিভিন্ন গুণাবলী বিষয়ক গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এরই ফলস্বরূপ তিনি আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে এক যুগান্তকারী আবিস্কার করেন। এই আপেক্ষিকতাবাদ আবিষ্কারের জন্যই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিজ্ঞানীমহলে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেন।
“মগজ ভরা তথ্য ও সংখ্যা থাকলেই প্রতিভার সৃষ্টি হয় না।” —অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
0 Comments