ঋষি আরুণির উপাখ্যান
প্রাচীনকালে আয়ুদধৌম্য নামে একজন ঋষি ছিলেন। তাঁর তিন জন খ্যাতনামা শিষ্যের অন্যতম ছিলেন— আরুণি। গুরু তাঁর নাম দিয়েছিলেন উদ্দালক। আরুণি ছিলেন পাঞ্চাল প্রদেশীয়। একদিন প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। একটানা বর্ষণে ক্ষেতে জল থৈ থৈ করছে। গুরু আয়ুদধৌম্য আরুণিকে ডেকে বললেন- “বৎস। শীঘ্র ক্ষেত্রে যাও। সেখানে আল বেঁধে জলের গতিরোধ করে এসো।”
গুরুর আদেশ শুনে কাল বিলম্ব না করে আরুণি তখনই ক্ষেত্রের দিকে রওনা দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন, ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে সবেগে ভাল করে চলেছে। জলের বেগ আটকানোর জন্য আরুণি আলের ওপর কানা মাটি নিয়ে বাঁধ উঁচু করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেগ এতখানি তীব্র ছিল যে, আরুণির সকল প্রয়াস এক সময় ব্যর্থ হলো। ঐ সময় সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরুণি এক সময় আলের উপর শুয়ে পড়লেন। তাতে জল প্রবাহ আটকানো সম্ভব হলো। ক্ষেত্রটিকে রক্ষা করা গেল।
এদিকে সন্ধ্যা নামল। সকল শিষ্য যে যার নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পন্ন করে আশ্রমে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আরুণি ক্ষেতের আলের উপর শুয়েই রইলেন। আনাধীন তখন শিষ্যদের ডেকে জনে জনে জিজ্ঞাসা করলেন- “তোমরা কেউ আরুণিকে ফিরতে দেখেছো ?”
তারা সকলে প্রায় একই উত্তর দিলেন- “ভগবন! আপনি তাঁকে ক্ষেত্রে আল বাঁধতে পাঠিয়েছেন। তাকে আর ফিরতে দেখিনি।
আচার্য তখন শিষ্যদের বললেন- “আমার সঙ্গে তোমরা সবাই চলো। আরুণি কোথায় আছে, তার সন্ধান করা যাক।
এরপর শুরু আয়ুদধৌম্য শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষেত্রের নিকট চললেন। সেখানে পৌঁছে তিনি চিৎকার করে ডাক দিলেন- “পুত্র আরুণি। তুমি কোথার? আমার কাছে এসো।”
গুরুদেবের ডাক শুনে আরুণি ক্ষেতের আল থেকে উঠে গুরুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। গুরুদেবকে প্রণাম এবং হাতজোড় করে বললেন- “গুরুদেব! ক্ষেত্রের জলকে কোনভাবেই আটকানো যাচ্ছিল না। তখন নিরুপায় হয়ে আলের উপর শুয়ে পড়ে জলের গতিরোধ করেছি। আপনার ডাক শুনে উঠে এসেছি। আদেশ করুন, আমি আপনার আর কি সেবা করতে পারি ?”
আচার্য আয়ুদধৌম্য বললেন- “বৎস! তুমি ক্ষেতের বাঁধ উদ্দালন (ভেঙে চুরে) করে উঠে এসেছো। তাই তোমার নাম দিলাম উদ্দালক'।”
পরে শিষ্যের কর্তব্য নিষ্ঠায় খুশি হয়ে আচার্য বললেন- “পুত্র! তুমি আমার আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছো। তোমার মঙ্গল হোক। আমার আশীর্বাদে তুমি বেদ সহ সকল শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হবে।”
আচার্যের আশীর্বাদ পেয়ে আরুণি তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। তাঁর গুরুভক্তির এমন উজ্জ্বল নিদর্শন জগতে বিরল।
আরুণির এই গল্পটি একটি বহুল প্রচলিত গল্প। এই গল্পের তাৎপর্যটি চিরকালীন। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেখানে আমরা যুতসই কোনো অজুহাত দিয়ে অসম্ভব কোন কর্তব্য থেকে নিজেদের বিরত রেখে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রতিপন্ন করি। তখন আরুণির দৃষ্টান্ত আমাদের অন্তঃস্থলে নাড়া দেয়। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে একটি কথা বেশ জনপ্রিয়; তা হলো- 'আদেশ এবং আদেশ পালন'। (Order and execution of order)। এর মাঝখানে আর কোনো কথা নেই। আদেশ যত কঠিন বা নির্মম হোক, তা কার্যকরী করা যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন; আদেশ পালনকারীকে তা পালন করতেই হবে। তাতে যদি প্রাণ চলে যায় যাক। দেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় এভাবেই আমাদের বীর সেনানীরা প্রাণ বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আরুণি যেন এই গল্পে একজন সাধারণ সৈনিক। আর গুরু আয়ুদধৌম্য যেন একজন সেনা-নায়ক। তবে লক্ষণীয় হলো এই যে, গুরু এবং শিষ্য এখানে পরস্পরের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। দুজনেরই অন্তর একটি মাত্র ভালোবাসার সুতো দিয়ে বাঁধা। তাই তাঁরা অবিচ্ছিন্ন। এভাবে সংক্ষিপ্ত এই গল্পটির শেষে উভয়ের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় গুরু শিষ্য পরম্পরার সৌন্দর্যময় অভিব্যক্তিটি উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।
গল্পটি মহাভারতের ‘আদি পর্বের' একেবারে প্রথম দিকে (তৃতীয় অধ্যায়) উল্লিখিত আছে।
0 Comments