'পুঁইমাচা' : বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।


'পুঁইমাচা' : বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বস্তু জগতে বস্তুর সত্যরূপটাই প্রকট এবং বস্তু পরিবর্তনশীল বলে এই সত্য রূপও পরিবর্তনশীল। কিন্তু যা সত্য তাতো চিরকালই সত্য। বিভূতি ভূষনের পুঁইমাচা গল্পের সাংসারিক যন্ত্রনা ও দুঃখবোধ বস্তুসত্য, এই বস্তু সত্যই সার্বিক সত্যে রূপ পরিগ্রহ করেছে একেবারে গল্পের শেষ দিকে যেখানে পুঁইমাচার পুঁইগাছের অনন্ত জীবন প্রবাহ মৃত্যুর পরবর্তীকালীন অনন্ত জীবন প্রবাহের সার্বিক সত্যকে শিল্পরূপ প্রদান করেছে। এই গল্পে প্রকৃতি হল নিয়ামক শক্তি। প্রকৃতির জগৎ পরিবর্তনশীল। কোন কিছুই এখানে ধ্বংস হয় না। শুধু রূপ পরিবর্তনের খেলা চলছে অনন্তকাল ধরে। বিভূতিভূষণ এই গল্পে প্রকৃতির এই spiritual দিকটির স্বরূপ উদঘাটনে ব্রতী হয়েছেন।

আকস্মিকতা হীনও মানসিক সংঘাত বা কোন ইঙ্গিত ব্যতিরেকেই কাহিনী এগিয়ে চলেছে গ্রামীন এক পরিবারকে ঘিরে। সহায়হরি চাটুজ্যের সংসার হত দরিদ্র—নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। গৃহিনী অন্নপূর্ণা অন্ন শূন্যা, তাই স্বভাব হাস্যময়ী না হয়ে কিছুটা গম্ভীর ও কটুভাষিনী। এ না হয়ে তার উপায় নেই। স্বামী তার সৃষ্টিছাড়া ব্যোম ভোলা প্রকৃতির। তিন মেয়েকে নিয়ে পাঁচজনের সংসারে নিত্যদিনের খুঁদ কুঁড়ো জোটাতেই অন্নপূর্ণার নাজেহাল অবস্থা। মেয়ে বড় হয়েছে, তার বিয়ের ব্যবস্থা করাও অন্নপূর্ণার দায়িত্ব।

একদিন শীতের সকালে সহায়হরি রস আনতে যাবার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু অন্নপূর্ণা জানালেন যে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা না করলে গ্রামের লোকে তাকে একঘরে করবে। একঘরে হতে সহায়হরির কোন আপত্তি যে আছে-তা বোঝা গেল না। কারণ ক্ষেন্তি ও তার দুই বোনের হাতে এক বোঝা পুঁইশাক দেখেই সহায়হরি বিশেষ পুলকিত হয়ে উঠেছেন। পুলকের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যখন সে শুনল কেমন করে ক্ষেন্তি গয়া পিসির কাছ হতে কুঁচো চিংড়ি আদায় করেছে। কিন্তু অন্নপূর্ণা সব উৎসাহে জল ঢেলে দেন। মায়ের আদেশে ছোট মেয়ে পুঁই শাকের বোঝা বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু পুঁইশাক আবার রান্না ঘরে ঢোকে অন্নপূর্ণার মাতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতায়। খেতে বসে পুঁই শাকের চচ্চড়ি দেখে ক্ষেন্তির আনন্দ ধরে না। সে দুবার চেয়ে নিয়ে খায়, তা দেখে অন্নপূর্ণার চোখ জলে ভরে ওঠে। তা গোপন করতে লঙ্কা খোঁজার ভান করতে হয়। এর পরের অধ্যায় কালীময়ের চণ্ডীমণ্ডপ। শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সঙ্গে ক্ষেন্তির বিয়ের সম্পর্ক পাকা করে দেয় কালীময় সুদের টাকা রেহাই দিয়ে। পাত্র পক্ষের আশীর্বাদের পরে সহায়হরি পাত্রের চরিত্রহীনতার খবর পেয়ে এ বিয়ে ভেঙে দেয়। কালীময়ের ক্রোধের সামনে সহায়হরি এসে দাঁড়ালেও সে যে বিশেষ বিচলিত হয়েছে তা বোঝা গেল না।

এর পরের দৃশ্য বরোজ পোতার বন। সেখান থেকে মেটে আলু তুলে আনার সময় অন্নপূর্ণা সেটি দেখে ফেলে। সহায়হরির বানানো গল্প কোন কাজে আসে না। মায়ের ধমকে ক্ষেন্তি সব সত্য প্রকাশ করে দেয়।

পৌষ পার্বনে পিঠে পুলির সময় ক্ষেন্তি ও তার বোনেরা কাঁচা গোলা খেয়েই পরিতৃপ্ত। মাতৃ বাৎসল্যে অন্নপূর্ণা বড় মেয়েকে বেশি করেই পিঠে খেতে দেয়।

বৈশাখ মাসে ক্ষেন্তির দোজ বরে বিয়ে হয়ে যায়। এক বছর পরের আষাঢ় মাসে সহায় হরি ও বিষ্ণু সরকারের কথাবার্তার মধ্যে ক্ষেন্তির মৃত্যু সংবাদ জানা যায়। বরপনের আড়াই শো টাকা বাকি থাকার জন্যে ক্ষেন্তির শ্বশুর শাশুড়ী তাকে বাপের বাড়ি পাঠাত না। ফাল্গুন মাসে ক্ষেন্তির বসন্ত হল। সেই অবস্থায় তাকে তারা দূর সম্পর্কীয় এক পিসির বাড়িতে ফেলে রেখে যায়। সেখানেই ক্ষেন্তির জীবনের সমাপ্তি ঘটে। দিন, মাস, বছর কেটে যায়। পুনরায় এসে পড়ে পৌষ পার্বন। সবই ঠিক আছে, শুধু ক্ষেন্তি নেই। স্বাভাবিক ভাবেই কথা প্রসঙ্গে ক্ষেন্তির কথা এসে পড়ে। অন্নপূর্ণার জলভরা চোখ পড়ে লতায় পাতায় ভরা জীবন রসে টইটুম্বুর মাচার পুঁইগাছের দিকে।

এ গল্পের কাহিনী অংশ নগন্য। বিস্তৃত হয়েছে প্রকৃতি ভাবনা। যা ফুটে উঠেছে অন্তিম পর্বের গম্ভীর ব্যঞ্জনায় । পুঁই গাছ প্রতীকি রূপে রহস্যময়ী প্রকৃতির মূল রহস্যকে অঙ্গুলী নির্দেশে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। ক্ষেন্তি নেই, কিন্তু তার বাসনা বেঁচে আছে। ক্ষনস্থায়ী জীবন অনন্ত জীবন প্রবাহে প্রবর্ধমান পুঁইগাছের জীবন ধারার মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠেছে। ক্ষেন্তির বিচ্ছেদ প্রত্যক্ষভাবে প্রচ্ছন্ন রেখে তাকে প্রকৃতির প্রবাহমানতায় মিলিয়ে দিয়ে বিচ্ছেদের শোককে বেদনার আনন্দে স্মরনীয় করে তোলার মধ্যেই রয়েছে লেখকের রোমান্টিক ইমেজ। 


Post a Comment

0 Comments