দ্রোণাচার্য-এক বিরল প্রতিভাধর অস্ত্রবিদ ও অস্ত্র প্রশিক্ষক
মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেন গুরু দ্রোণ বা দ্রোণাচার্য। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু যজন-যাজন বা অধ্যাপনাতে মনঃসংযোগ না করে তিনি পাখির চোখ করেছিলেন অস্ত্রবিদ্যাকে। তিনি অস্ত্রশিক্ষার পাঠ পেয়েছিলেন ভৃগু পরশুরামের কাছে। অস্ত্রশিক্ষা প্রদান করে যশস্বী হয়েছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু হয়ে। তাঁর ছাত্র তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছিলেন শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর। ব্রহ্মচর্যাবস্থায় তিনি বালক দ্রুপদকে পেয়েছিলেন সহপাঠী সখা হিসাবে। আবার সেই বালক দ্রুপদ যখন পাঞ্চাল দেশের রাজা হলেন তখন তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলেন বঞ্চনা ও অসম্মান। তাঁর ছাত্ররা একদিন দ্রুপদকে পরাজিত করে তাঁর পদতলে এনে হাজির করে গুরুর এই অসম্মানের প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করেছিল। এমনই উত্থান-পতন নিয়ে অত্যাশ্চর্য জীবন আলেখ্যটি ছিল দ্রোণাচার্যের।
এবার আলোচনা করা যাক, দ্রোণাচার্য এবং তার অত্যাশ্চর্য জীবনের বর্ণময় ঘটনাগুলি যা, মহাভারতের ‘আদি পর্বের একশো একত্রিশতম ও একশো বত্রিশতম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে।
গুরু দ্রোণের পিতার নাম ছিল ঋষি ভরদ্বাজ। তিনি একদিন গঙ্গা স্নানে গিয়েছেন। সেই সময় ‘ঘৃতাচী’ নামের এক অপ্সরা স্নান করে নদী তীরে উঠছিল। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তার গায়ের কাপড় সরে যায়। মুনি সেই রূপ লাবণ্যময়ী নারীকে দেখে সামলাতে পারলেন না। তাঁর বীর্যস্খলন হলো। তিনি সেই বীর্য একটি দ্রোণ বা কলসের মধ্যে রাখলেন। কিছুদিন পর সেই বীর্য থেকে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। দ্রোণ থেকে জন্ম হয়েছিল বলে মহর্ষি ভরদ্বাজ পুত্রের নাম রেখেছিলেন দ্রোণ ৷
এরপর দ্রোণ খুব দ্রুত বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করতে লাগলেন। মহর্ষি ভরদ্বাজের ‘পৃষত’নামে এক পরম বন্ধু ছিল । তাঁর সন্তান দ্রুপদ ভরদ্বাজের আশ্রমে অধ্যয়ন ও খেলাধূলা করতো। স্বাভাবিকভাবে তাই দ্রোণ এবং দ্রুপদের মধ্যে নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। একদিন দ্রুপদ দ্রোশকে বললেন- “মিত্র! আমাদের এই বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে।”
প্রোশ প্রত্যুত্তরে বললেন- “সখা! অসম বন্ধুত্ব কখনও স্থায়ী হয় না।”
সম্পদ বললেন- “আমাদের বন্ধুত্ব অবশ্যই স্থায়ী হবে। আমি যখন রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হবো, তখন তুমি যে কোন প্রয়োজনে আমার কাছে আসবে। আমি তোমাকে সব রকম সাহায্য করব।"
কিছুকাল পরে দ্রোণাচার্যের পিতৃবিয়োগ হলে দ্রোণ পিতার আশ্রমে থেকে তপস্যা করতে লাগলেন। অন্যদিকে রাজা পৃষত লোকস্তুরিত হলে সিংহাসনে আরোহন করলেন তাঁর পুত্র দ্রুপদ। কিছুদিন এভাবে চলার পর পিতার ইচ্ছানুসারে দ্রোণ পুত্রলাভের আশায় শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে বিবাহ করলেন। কৃপী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা এবং জিতেন্দ্রিয়া রমনী ছিলেন। তাঁর গর্ভে অশ্বত্থামার জন্ম হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈববাণী শোনা যায়- “ এই পুত্র জন্মানোর সাথে সাথে ঘোড়ার ডাকের মতো গভীর ধ্বনি অনুরণিত হবে, তাই এর নাম হবে অশ্বত্থামা।”
ঐ সময় দ্রোণাচার্য জানতে পারলেন মহাত্মা জমদগ্নি-নন্দন ভগবান পরশুরাম তাঁর যথা-সর্বস্থ ব্রাহ্মণদের দান করে দিয়েছেন। তা শুনে দ্রোণ তাঁর কাছ থেকে ধনুর্বেদ, অন্যান্য দিব্যাস্ত্র সহ নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি পেতে উৎসাহী হলেন। সেই সময় পরশুরাম মাহেন্দ্র পর্বতে অবস্থান করছিলেন। তখন ভরদ্বাজ-নন্দন শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। ভুত পরশুরামকে প্রণাম করে বললেন- “আমি মহর্ষি অঙ্গিরার গোত্রে ভরদ্বাজ কবির দ্বারা অযোনিসম্ভূত পুত্র দ্রোণ। আমি আপনার কাছে কিছু পাবে- এই আশার এসেছি।”
পরশুরাম বললেন- “হে তপোধন! আমার যাবতীয় ধনসম্পদ ইতিমধ্যে ব্রাহ্মণদের দান করে নিয়েছি। এই সসাগরা পৃথিবী বাহুবলে জয় করে মহর্ষি কাশ্যপকে নিয়ে নিয়েছি। এখন কেবল এই শরীর এবং নানা ধরনের কিছু অস্ত্রশস্ত্র অবশিষ্ট আছে। এগুলির মধ্যে তোমার বা ইচ্ছা- তা প্রার্থনা কর। আমি তা-ই তোমাকে প্রদান করব।” মহামতি। যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হন, তাহলে সমস্ত অস্ত্র, প্রয়োগ বিধি, রহস্য ও সেগুলির উপসংহার-জ্ঞান আমাকে প্রদান করুন।”
পরশুরাম বললিন- "তাই তোমাকে আমার সকল অস্ত্রশস্ত্র, সকল রহস্য সহ প্রয়োগ বিধি প্রদান করলাম।
এরপর দ্বিজোত্তম দ্রোণ পরশুরামের কাছ থেকে নানান অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে খুশি মনে প্রিয় বন্ধু দ্রুপদের নিকট গেলেন। এবং মহারাজ দ্রুপদকে বললেন- “হে রাজন! আমি তোমার সখা। তোমার পূর্ব বচন অনুসারে তোমার কাছে এসেছি। আমার সাদর মিত্রতা গ্রহণ করো।”
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ বন্ধুর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত তো করলেন না, বরং বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন- “ওহে ব্রাহ্মণ! আমাকে সখা বলে নির্বোধের পরিচয় দিয়েছো ঐশ্বর্যশালী রাজাদের সঙ্গে এমন ধনহীন ব্যক্তির বন্ধুত্ব অসম্ভব। বাল্যাবস্থার তোমার সঙ্গে আমার মিত্রতা ছিল, তা ঠিক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত বেমানান এবং অসম্ভব। পূর্বে তোমার সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্ব ছিল তা অর্থনিবন্ধন মাত্র। কিন্তু পণ্ডিতের সঙ্গে মূর্খের বা বীরের সঙ্গে দুর্বলের বন্ধুত্ব যেমন অর্থহীন, তেমনি ধনী ব্যক্তির সঙ্গে গরীবের সখ্যতা এককথায় নিরর্থক, অসম্ভব।”
মহাতেজা দ্রোণ দ্রুপদের যুক্তি জাল বা বাক্যবাণ আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি ক্রোধে কাঁপছিলেন এবং দ্রুপদ রাজার সঙ্গে তখনই তাঁর বৈরিতা শুরু হলো। তিনি অপমানিত হয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে এলেন, এবং হস্তিনাপুরে এসে শ্যালক কৃপাচার্যের বাড়িতে নিভৃতাবাস করতে লাগলেন। একদিন হস্তিনাপুরের রাজকুমারগণ নগরে একটি লোহার বল নিয়ে খেলছিল। হঠাৎ লোহার সেই বলটি একটি জলশূন্য কুয়োতে পড়ে যায়। কুঁয়ো থেকে বলটি তোলার জন্য সকলে তখন প্রাণপনে চেষ্টা করতে থাকলেও কৃতকার্য হতে পারছিল না। এজন্য তাদেরকে যখন বেশ হতাশ এবং নিরুপায় লাগছিল। তখন সেখানে উপস্থিত হলেন আচার্য দ্রোণ।
তাঁকে দেখে সব বালকেরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়ালে দ্রোণাচার্য বললেন- “ওহে কুমারগণ! তোমাদের ক্ষাত্রবল এবং অস্ত্রশিক্ষাকে ধিক্। তোমরা ভরতবংশীয় অথচ কূপ থেকে এই সামান্য লৌহ গোলকটি তুলতে পারছো না। দেখ, আমি ঐ বল এবং আমার এই আংটিটি কিভাবে কুয়ো থেকে তুলছি। তোমরা আমার ভোজনের আয়োজন করো।”
এই বলে তিনি তাঁর আংটিটি কুয়োয় ফেলে দিলেন। আচার্য দ্রোণের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন- “হে মহাত্মা! কৃপাচার্য চাইলে আপনি এখানে চিরকাল ভোজনাদি করতে পারবেন। "
যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে স্লোশ হাসতে লাগলেন এবং বললেন- “এই দেখ এটি একটি লোহার শিক। আমি এটি নিঃক্ষেপ করবো যা লোহার বলটিকে বিদ্ধ করবে। পুনরায় এক একটি শিক নিঃক্ষেপ করবো যেগুলি পরপর শিকগুলিকে বিদ্ধ করে বলটিকে তুলে আনবে।”
অত্যাশ্চর্য হলো এই যে, এরপর দ্রোণ পুরো কাজটি তাদের সামনে করে দেখালেন এবং বলটিও কুয়ো থেকে সহজেই তোলা সম্ভব হলো ।
কুমারেরা এই দৃশ্য দেখে হতবাক। তারা তখন বললো- “হে বিপ্রবর। এই আংটিটি কিভাবে কুয়ো থেকে তুলবেন ?”
দ্রোণ এরপর শর যোজন করে কুয়োতে পড়ে থাকা অঙ্গুরীয়টিকে বিদ্ধ করে অদ্ভুত কায়দায় উপরে তুলে আনলেন।
বালকেরা সেই দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হলো। তারা করজোড়ে বলল— “আপনাকে অভিনন্দন জানাই । আপনি যে চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন, তা অন্য কারুর পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। দয়া করে আপনার পরিচয় জানিয়ে আমাদের ধন্য করুন।”
দ্রোণ তখন বললেন— “মহামতি ভীষ্মের কাছে গিয়ে তোমরা আমার রূপ ও গুণ বর্ণনা করে বলবে যে, সেই মহাতেজা এখানে উপস্থিত হয়েছেন।”
কৌরব কুমারেরা সেই অনুসারে পিতামহ ভীষ্মকে বিস্তারিত সব কিছু জানালে ভীষ্ম বুঝতে পারলেন যে স্বয়ং দ্রোণাচার্য এখানে এসেছেন। বলা বাহুল্য, তিনি কুমারদের জন্য একজন উপযুক্ত অস্ত্র শিক্ষক নিয়োগের কথা ভাবছিলেন; এখন ধনুর্বিদ্যাবিশারদ দ্রোণাচার্যের আগমন বার্তা শুনে তিনি তাঁকে রাজসভায় নিয়ে এলেন। রাজসভায় দ্রোণ এলে ভীষ্ম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে আচার্য! আপনি কেমন আছেন ? আমার পক্ষে আপনার জন্য কি করা সম্ভব ?”
ভীষ্মের কুশলপূর্ণ প্রশ্নাদি শুনে দ্রোণ তাঁর বেদচর্চা, ধনুর্বেদ চর্চা সহ জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা ভীষ্মকে নিবেদন করলেন। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত চিত্তে তাঁর বাল্য সখা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ কিভাবে তাঁকে অসম্মান করেছেন— তাঁর বর্ণনাও ভীষ্মের কাছে পরিবেশন করলেন।
এরপর তাঁর বিবাহ প্রসঙ্গ এবং পুত্র অশ্বত্থামার অত্যাশ্চর্য জন্ম কথা উল্লেখ করে বললেন— “একদিন এক ঋষিকুমার গাভীর দুধ পান করেছিল। তা দেখে আমার পুত্র অশ্বত্থামা দুধ খাওয়ার জন্য বায়না করলো। আমি তখন কোনো গোয়ালার কাছে দুধ না চেয়ে একটি গাভী জোগাড় করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আমি কোনো গাভী জোগাড় পারলাম না। ফিরে এসে দেখি, ছোট ছোট শিশুরা আটা জলে গুলে দুধ বলে আমার অশ্বত্থামাকে খাওয়াচ্ছে এবং অশ্বত্থামাও খুশি মনে তা পান করছে। আমার একমাত্র শিশু সন্তানের এমন করুণ পরিণতি দেখে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। আমার তখন খুব অসহায় লাগছিল। বলতে দ্বিধা নেই, আমি এখানে গুণবান ছাত্রদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। আপনি আমাকে তার সুযোগ করে দিলে কৃতার্থ বোধ করব।”
ভীষ্ম বললেন— “আপনি আপনার ধনুকের ছিলা খুলে রাখুন। এখন থেকে রাজকুমারদের ধনুর্বাণ সহ যাবতীয় অস্ত্র শিক্ষা দিন। এই কৌরবদের ধন, সম্পদ, যশ, খ্যাতি সব আপনারই। আমরা সকলেই আপনার আদেশ পালনকারী। আপনার শুভাগমনে এই রাজ্য বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ হবে— এই বিশ্বাস করি।”
সেই থেকে শুরু হলো দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে রাজকুমারদের নিবিড় অস্ত্র প্রশিক্ষণ। কিছুদিন পর দ্রোণাচার্য বুঝলেন, রাজকুমারেরা অস্ত্রবিদ্যায় যথেষ্ট দক্ষ ও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। তিনি ভাবলেন এবার গুরুদক্ষিণা নেওয়ার সময় এসেছে। একদিন তিনি সকল রাজকুমারদের ডাকলেন এবং নির্দেশ করলেন— “যাও, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত করে বন্দি করে নিয়ে এসো। এই হবে তোমাদের উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা।”
এরপর গুরুর আদেশ নত-মস্তকে মেনে নিয়ে রথে চড়ে সকল রাজকুমার চললেন পাঞ্চাল নগরের উদ্দেশে। দুর্যোধন, যুযুৎসু, দুঃশাসন প্রমুখ কৌরব-ভায়েরা আস্ফালন শুরু করে দিল— “আমিই দ্রুপদরাজকে ধরব।” ইতিমধ্যে পাঞ্চালরাজ সম্ভাব্য আক্রমনের খবর পেয়ে তাঁর ভ্রাতাদের নিয়ে দুর্গের বাইরে এসে তীব্র অবরোধ গড়ে তুললেন। শুরু হলো দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ ।
অর্জুন এইসব দেখে শুনে গুরু দ্রোণাচার্যকে বললেন—“আচার্য! আমি নিশ্চিত এরা কেউ পাঞ্চাল-রাজকে পরাজিত করতে পারবে না। আমরা শেষে চেষ্টা করব।” এই বলে পঞ্চভ্রাতা আধক্রোশ দূরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অন্যদিকে দ্রুপদ- বাহিনী শুরু করে দিলেন শরবৃষ্টি। তাঁদের মুহুর্মুহু শরবর্ষণে কৌরব রাজকুমারেরা হতচকিত হলো। তবুও দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রমুখ কৌরব ভ্রাতাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু দ্রুপদের ক্ষিপ্রতা এবং রণ নিপুণতার সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারছিল না। পাশাপাশি, পাঞ্চাল রাজ্যের সাধারণ নাগরিকবৃন্দ যে যা হাতে পেয়েছিল, তা নিয়ে কৌরবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরকম সম্মিলিত আক্রমণ মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা এবং শক্তি কোনোটাই তাদের ছিল না। তাই কৌররেরা রণক্ষেত্রে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। পাণ্ডবেরা যেখানে দূরে অবস্থান করছিল, তারা অচিরেই সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য হলো।
কৌরবদের শোচনীয় অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে পাণ্ডবেরা আর দেরি না করে রণক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলো। যুধিষ্ঠিরকে ঐস্থানে রেখে নকুল ও সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে অর্জুন চললেন রথে চড়ে দ্রুপদকে আক্রমণ করার জন্যে। ভীম গদা হাতে নিয়ে চললেন আগে আগে। দ্রুপদ ও তার সৈন্যদল যুদ্ধে জিতে তখন মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি করছিল। সেই সময় দণ্ডপানি কালের ন্যায় গদাহাতে আবির্ভূত হলেন ভীম। তাঁর গদার আঘাতে দ্রুপদ সেনাদের হাতি, রথ ইত্যাদি চূর্ণ বিচূর্ণ হতে লাগলো। সৈন্যরা প্রাণ হারাতে লাগলো একে একে। অন্যদিকে অর্জুন শুরু করলেন শরবৃষ্টি – নিপুণ হাতে, অনাবিল দক্ষতায়, শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদদের মতো। তার মুহুর্মুহু শরবর্ষণে দ্রুপদের সৈন্যদল ঢাকা পড়ে গেল। প্রথমে সত্যজিৎ অর্জুনকে আটকানোর জন্য সাহস করে এগিয়ে এলেও অর্জুন তাকে অনায়াসে পরাজিত করলেন। তারপরই দ্রুপদরাজার ধনুক ও ধ্বজা দুটুকরো করে ফেললেন তিনি। এরপর পঞ্চবাণ নিক্ষেপ করে দ্রুপদ রাজার রথের চারটি ঘোড়া ও সারথিকে মেরে ফেললেন পাণ্ডু নন্দন। দ্রুপদ তখন আর একটি ধনুক নিতে প্রয়াসী হলে অর্জুন, খজাহাতে রথ থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাঁকে ধরে ফললেন। তারপর ততোধিক ক্ষিপ্রতায় তাঁকে গুরু দ্রোণের কাছে নিয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে কৌরবেরা দ্রুপদের রাজধানী লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। তা দেখে অর্জুন ভীমকে ডেকে বললেন- “দ্রুপদরাজ গুরুদেবের সুহৃদ। তাঁর কোন ক্ষতি বা রাজ্যের ক্ষতি করা আমাদের লক্ষ্য নয়। তাঁকে গুরুদেবের হাতে গুরুদক্ষিণা হিসাবে তুলে দেওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।”
এরপর অর্জুন দ্রুপদকে দ্রোণাচার্যের হাতে সমর্পণ করলেন। দ্রুপদের অহংকার ধূলায় মিশে গেল। তাঁর ধন সম্পদও নিয়ে নেওয়া হলো। দ্রোণাচার্য বললেন- “দ্রুপদ ! আমি জোর করে তোমার রাজ্য ও তোমাকে জয় করেছি। তবে তুমি প্রাণের ভয় করো না। আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষমা করাই আমাদের ধর্ম। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের বাল্যাবস্থার সম্পর্ক বা দিনগুলির কথা ভুলে গিয়েছো। কিন্তু আমি চাই আমাদের পূর্ব সম্পর্ক পুনরায় গড়ে উঠুক। আমার ইচ্ছা, এ রাজ্য দুভাগে ভাগ হোক। তুমি গঙ্গার দক্ষিণ তীরের অংশ নাও। আমি উত্তর তীরের রাজ্য নিই। তুমি বলেছিলে কেবল সমগোত্রীয়দের মধ্যেই মিত্রতা সম্ভব। তাই আমি রাজা হলে তোমার আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে কোনো আপত্তি থাকবে না।”
দ্রুপদ বললেন- “হে মহাত্মা! আপনার মতো উদার হৃদয়, পরাক্রমী ব্যক্তির মুখেই এমন কথা মানায়। আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম। আমার অর্ধেক রাজ্য আপনি গ্রহণ করুন।”
দ্রোণ তখন দ্রুপদকে মুক্ত করে দিলেন। বলা বাহুল্য, উভয়ের মধ্যে ঐ সময় একটা বোঝাপড়া তৈরি হলেও রাজা দ্রুপদ সেই অপমান ভুললেন না। ভবিষ্যতে প্রতিশোধের আশায় তা তুলে রাখলেন মনের কোণে, সঙ্গোপনে।
0 Comments