পাণ্ডবদের জন্মবৃত্তান্ত
পঞ্চ পাণ্ডবদের জন্ম-বৃত্তান্ত একটি ঐশী ঘটনা। যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন মাতা কুন্তীর গর্ভে এবং নকুল ও সহদেব মাতা মাদ্রীর গর্ভে জন্মেছিলেন।
এই পাঁচ পাণ্ডবেরা প্রত্যেকেই হলেন ঈশ্বর-সম্ভূত। পিতৃত্ব-কর্ম উদ্যাপনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাণ্ডু ছিলেন অসহায়। তাঁর অকৃতকার্যতার পেছনে ছিল কিন্দম মুনির অভিশাপ। তাই পাণ্ডবরা কিভাবে মর্ত্যলোকে জন্মেছিলেন সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনাবলী জানার আগে জেনে নেওয়া যাক, পাণ্ডু, পিতৃত্ব পালনে কেন অকৃতকার্য ছিলেন, বা কি কারণে কিন্দম মুনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।
মৃগয়া-বিলাসী রাজা পাণ্ডু একবার একটি গভীর বনে ভ্রমণ করছিলেন। এক সময় হঠাৎ তাঁর চোখে পড়লো একটি মৃগ ও মৃগী পরস্পর যৌন কার্যে রত। তিনি ভালমন্দ বিচার-বিবেচনা না করে তৎক্ষণাৎ পাঁচটি বাণ মারলেন প্রমত্ত ঐ মৃগ-মৃগীর উপর । আপাতভাবে মৃগ-মৃগী হলেও তাঁরা ছিলেন মহাতেজা ঋষি পুত্র, মুনি কিন্দম ও তাঁর স্ত্রী। তাঁরা ঐ সময় মৃগরূপ ধারণ করে পরমানন্দে উপভোগ করছিলেন। পাণ্ডুর আকস্মিকভাবে ছোঁড়া সুতীক্ষ্ণ বাণে ধরাশায়ী হয়ে আর্তনাদ করতে করতে ঋষিপুত্র তখন বললেন— “মহারাজ! অত্যন্ত নির্বোধ, পাপাচারী ব্যক্তিও এমন নৃশংস আচরণ করেন না। আপনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি হয়ে কি করে আমাদের ওপর শর প্রয়োগ করলেন ?”
পাণ্ডু তা শুনে বললেন- “একজন ক্ষত্রিয় যেমন শত্রুবধ করে, তেমনি মৃগয়াকালে মৃগ শিকারও করে। আমি সেভাবেই এই কাজ করেছি। ”
ঋষি তনয় বললেন- “হে রাজা! কথাটি হয়তো ঠিক। কিন্তু ব্যসনকালে (কামজ কর্ম) শত্রুর ওপর শরনিক্ষপ প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাজ নয়। কেবল ন্যায় যুদ্ধেই শত্রুবধ বিধেয়। ”
পান্ডু পুনরায় বললেন- “আমি জানি মত্ত, ভীত কিংবা পলায়ন করছে এমন শত্রুকে বধ করা যথার্থ নয়; কিন্তু ছদ্মবেশী মৃগ বধ করলে ভুল কোথায় ?”
ঋষিতনয় প্রত্যুত্তরে বললেন- “মহারাজ প্রশ্নটি ছদ্মবেশী মৃগ বলে নয়। মৃগ তখন ছদ্মবেশে কি করছিল সেটিই বিচার্য। মহারাজ, আমি তখন ইন্দ্রিয়াসক্ত ছিলাম। আমাকে বধ করা যদি আপনার একান্তই অভিলাষ ছিল তা হলে বিলাস-বিরতি পর্যন্ত অপেক্ষা করা আপনার উচিত ছিল। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মার্থ জ্ঞানী ও নীতি পরায়ণ; আপনার দ্বারা এই দুষ্কর্ম কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি একজন অরণ্যবাসী নিরপরাধ মুনি। মৃগবেশ ধারণ করে বেড়াচ্ছিলাম। আমাকে হত্যা করে আপনি যে পাপ করলেন আমি সে কারণে অভিশাপ দিচ্ছি— “আপনিও ব্যসনকালে আমার মতো অকালমৃত্যু লাভ করবেন। আমি মুনি কিন্দম। লোক লজ্জার ভয়ে এই গহন বনে এসে মৃগীতে আসক্ত হয়েছিলাম। আমি যে ব্রাহ্মণ আপনি তা জানতেন না। তাই ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ আপনাকে স্পর্শ করবে না। হে রাজন! আপনি যেমন সুখের সময় আমাকে দুঃখ দিলেন। তেমনি আপনাকেও সুখকালে দুঃখ ভোগ করতে হবে।” –এই বলে মুনি কিন্দম তখনই মারা গেলেন।
এই রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার দগ্ধ হয়ে রাজা পাণ্ডু রাজভবনে ফিরে এসে পরিতাপ করতে লাগলেন। মুনি কিন্দমের এমন করুণ পরিণতির জন্য নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছিল তাঁর। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ত্যাগ করে একা একা আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াবেন। আর সংসার করবেন না। স্বামীর এমন সিদ্ধান্ত শুনে দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রী রাজাকে বললেন- “হে দেব! সন্ন্যাসীর জীবন ছাড়া আরও অনেক জীবন আছে যা সস্ত্রীক পালন করা যায়। আপনি সেরকম কিছু সংকল্প করুন যাতে, আমরাও আপনার অনুগামিনী হতে পারি।”
তখন রাজা পাণ্ডু ঠিক করলেন, তিনি দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাণপ্রস্থে যাবেন। সব রকম রাজসুখ বিসর্জন দিয়ে অতি সাধারণ অরণ্যাচারীর জীবনকে মোক্ষলাভের উপায় হিসাবে বেছে নেবেন। এইভাবে শুরু হলো তাঁদের অরণ্যচারী পরিব্রাজকের জীবন।
সেদিন ছিল অমাবস্যা তিথি। প্রজাপতি ব্রহ্মাকে দর্শন পাওয়ার আশায় দলে দলে মুনি-ঋষিরা চলেছেন ব্রহ্মলোকের উদ্দেশে। সকলে ব্রহ্মলোক যাচ্ছেন শুনে পাণ্ডু ও তাঁর দুই স্ত্রী তাঁদের অনুগামিনী হলেন । ঋষিরা বললেন- “হে রাজা! পথ অতি দুর্গম, রুক্ষ, প্রস্তরময় ও বরফে ঢাকা। নির্জন যাত্রাপথ। শুধুমাত্র শুদ্ধচিত্ত মুনি-ঋষিরাই সে পথে যেতে পারেন। আপনার সঙ্গে আপনার দুই স্ত্রী আছেন। আপনারা যাবেন না। শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন না।”
পাণ্ডু বললেন— “আমি জানি সন্তানহীনদের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত নয়। মানুষ জন্মানোর সময় চার-ঋণ নিয়ে জন্মায়— পিতৃ ঋণ, দেব ঋণ, ঋষি ঋণ এবং মনুষ্য ঋণ। যজ্ঞ দ্বারা দেব ঋণ পরিশোধ্য। পঠন-পাঠন ও তপস্যা দ্বারা ঋষি ঋণ পরিশোধ করা যায়। শ্রাদ্ধ-শান্তি দ্বারা পিতৃঋণ এবং পরোপকারের মাধ্যমে মনুষ্য ঋণ শোধ করা সম্ভব। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি সব ঋণ থেকে মুক্ত হলেও এখনও পিতৃঋণে ঋণী হয়ে আছি। আমি চাই আমার স্ত্রীরা সন্তানের মাতা হোন।”
ঋষিগণ বললেন— “হে ধর্মাত্মা! আমরা দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, আপনারা অচিরেই দেবোপম যশস্বী পুত্রদের লাভ করতে চলেছেন। আপনাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক।”
রাজা এই কথায় খুশি হলেও তাঁর তখন মনে পড়লো কিন্দম ঋষির দেওয়া অভিশাপ । তিনি তাই তাঁর স্ত্রী কুন্তীকে ডেকে বললেন- “প্রিয়ে। তুমি সন্তানলাভের জন্য সচেষ্ট হও।"
কুন্তী প্রত্যুত্তরে বললেন- “মহারাজ! বাল্যবস্থায় আমার ঋষি দুর্বাসাকে সমাদরে আপ্যায়ন করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে বলেছিলেন — “বৎসে! আমি তোমার সেবা-পরিচর্যায় অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি তোমাকে এক মহামন্ত্র দিচ্ছি। তুমি তা গ্রহণ করো। তুমি এই মন্ত্র উচ্চারণ করে যে দেবতাকে আহ্বান করবে, তিনি চান বা না চান তোমার অধীন হবেন। তুমিও সেই দেবতার প্রসাদে পুত্রবতী হবে।” এখন বলুন, আমি সেই মন্ত্র উচ্চারণ করব কিনা ? যদি করি, তবে কোন দেবতাকে স্মরণ করবো ?
রাজর্ষী পান্ডু বললেন- “ভদ্রে! দেবতাদের মধ্যে ধর্ম সর্বোত্তম। তুমি তাঁকে স্মরণ করো। ধর্ম কোনদিন অধর্মের সঙ্গে আপোষ করেন না। তুমি ধর্মকে প্রার্থনা করো।”
স্বামীর অনুজ্ঞা পেয়ে কুন্তী ভক্তি সহকারে মন্ত্রোচ্চারণ করে ধর্মদেবকে আহ্বান করলেন। ধর্মের উদ্দেশে পূজা শেষ করে মুনির দেওয়া মহামন্ত্র জপ করলেন। তখনই দেবশ্রেষ্ঠ ধর্মরাজ প্রজ্জ্বলিত সূর্যের তেজ নিয়ে সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। কুন্তীকে সহাস্যে বললেন— “বলো সুন্দরী, আমাকে ডাকলে কেন ? তুমি কি চাও, বলো ?” কুন্তী করজোড়ে বললেন- “হে দেব! আমাকে একটি সন্তান প্রদান করুন।”
ধর্ম তখনই কুন্তীর প্রার্থনায় সম্মতি জানিয়ে বললেন – “তোমার গর্ভে পরম যশস্বী এক পুত্র সন্তান সঞ্জাত হলো।”
সঙ্গে সঙ্গে দৈববাণী হলো, “পান্ডুর এই সন্তান ‘যুধিষ্ঠির' নামে খ্যাত হবে। ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ নরপতি হয়ে প্রজা প্রতিপালন করবেন।”
রাজা পান্ডু এমন ধর্মাত্মা পুত্র পেয়ে পুনরায় কুন্তীকে বললেন- “প্রিয়ে। ক্ষত্রিয়বংশে বলশালী ব্যক্তি বিশেষ মার্যাদা পায়। তুমি একজন বলশালী পুত্রের জন্ম দাও। তুমি পবন দেবকে স্মরণ করো।”
কুত্তী রাজার আজ্ঞা পেয়ে ঋষি প্রদত্ত মন্ত্র পুনরায় উচ্চারণ করে পবন দেবকে আহ্বান করলেন। মহা পরাক্রমশালী পবন দেব হরিণে চড়ে তক্ষুণি সেখানে আবির্ভূত হলেন। বললেন- “কুন্তী ? আমাকে কেন স্মরণ করলে ? তোমার কি চাই বলো ?” লজ্জায় মুখ নিচু করে স্মিত হেসে কুন্তী বললেন- “হে সুরোত্তম। আমাকে এক মহা বলশালী দর্প বিনাশকারী পুত্র উপহার দিন।”
বায়ু কুন্তীর প্রার্থনা স্বীকার করলেন। এবং তাঁর গর্ভে এক মহা শক্তিমান পুত্র প্রদান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম পুত্রের ন্যায় দৈববাণী হলো— “এই পুত্রের নাম হবে ভীম। সে শক্তিমানদের মধ্যে অগ্রগণ্য হবে।”
ভীমসেনের জন্মের সময় একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। ভীম তখন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছেন। হঠাৎ মাতা কুন্তী বাঘের ভয় পেয়ে কোলের শিশুকে ছেড়ে পালানোর জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ভীম তখন মায়ের কোল থেকে ছিটকে একটি পর্বতের উপর পড়লেন। তাঁর বজ্রসম শরীরের আঘাতে পর্বত ভেঙে চুরমার হলো। পান্ডু এই দৃশ্য দেখে হতবাক। বলা বাহুল্য, ঐ একই দিনে গান্ধারীর গর্ভে পুত্র দুর্যোধনও জন্মলাভ করছিলেন।
বৃকোদর ভীম জন্মানোর পর পান্ডু চিন্তা করলেন সর্বলোকে শ্রেষ্ঠ একটি সন্তানলাভের। তাঁর বিচারে দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁর প্রসাদে আমি এরকম একজন পুত্র পাবো, যে অসুর, নাগ, গন্ধর্ব, যক্ষ প্রভৃতি সকলকে জয় করতে পারবে। এই ভেবে তিনি কুন্তীকে ডেকে সারা বছর ধরে ব্রত পালনের নির্দেশ দিলেন। এবং স্বয়ং সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দণ্ডায়মান থেকে কঠোর তপস্যার দ্বারা দেবরাজ ইন্দ্রের আরাধনা করতে লাগলেন।
দেবরাজ তাঁদের কঠোর তপস্যা ও ভক্তিপূর্ণ প্রার্থনায় প্রীত হয়ে তাঁদের সামনে এলেন। এবং বললেন- “আমি তোমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করতে চাই। তোমরা গো- ব্রাহ্মণদের রক্ষাকারী, শত্রু দমনকারী এক দিব্য পুত্র উপহার পাবে।” দেবরাজের কথায় আনন্দিত হয়ে কুন্তী মহর্ষিদত্ত মন্ত্র জপ করে ইন্দ্রের আহ্বান !
0 Comments