হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা.
হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. কত কে আসিছে, কত কে আসিবে, কত কে হেরিবে হেথায় ঠিক এভাবেই একদিন জরহুম গোত্রের কাফেলা আরব মরুভূমি অতিক্রম করতে গিয়ে কয়েকটি পাখির কলতান আর ডানা মেলা দেখে মরুদ্যানের বুকে কাফেলাকে থামিয়ে দেয়। ভিত পড়ে মক্কা শহরের। আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। আবুল আমবিয়া বলে খ্যাত হজরত ইবরাহিম আ. তখন নবী। পুত্রহীন নবী। স্ত্রী সারা। বাদশাহ নমরূদ ইবরাহিম আ. কে আগুনে দিয়েছেন কিন্তু তিনি অক্ষত এখন নবী নমরূদের মুখোমুখি তাঁর রাজদরবারে। সাথী স্ত্রী সারা। সারাকে দেখে বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কে? হজরত ইবরাহিম আ. জানালেন এটা আমার বোন। বাদশাহ ইবরাহিম আ. এর ধর্মে দীক্ষা না নিলেও তাঁর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে হাজেরা নামে মহিলাকে উপহার হিসাবে ইবরাহিম আ. এর হাতে তুলে দিলেন। নিঃসন্তান, বাঁঝা সারা যুবতী হাজেরাকে স্বহস্তে স্বামী ইবরাহিম আ. এর দ্বিতীয়া স্ত্রী করে দেন। অর্থাৎ হাজেরা হলেন সারার সতীন।
আল্লাহ ৮০ বছর অতিক্রম করার পর ইবরাহিম আ. এর ঔরষে হাজেরার গর্ভে এক সন্তান দিলেন। হাজেরার কোলে শিশু সন্তান দেখে এতদিনের জ্যেষ্ঠ বোনবৎ আচরণকারিনী সারা এখন এ বাস্তব পৃথিবীর সতিনবং আচরণ করা শুরু করে স্বামীর কাছে আবেদন রাখল হাজেরাকে নির্বাসন দিতে। কিছুটা বাধ্য হয়ে নবী ইবরাহিম হাজেরা ও তার কোলের পুত্র সন্তান ইসমাইলকে (পরবর্তিতে নবী) এক বস্তা খেজুর আর এক মশক (চামড়ার থলি) পানি নিয়ে আরবের নির্জন মরুময় কাবার অদূরে সাফা মারোয়া পাহাড়ের তলদেশে রেখে আসেন। মাত্র কটা দিন, পানি হল শেষ, খেজুরের বস্তা হল খালি। শিশু শুরু করে ক্রন্দন। মায়ের হৃদয় বুক কেঁপে উঠল সন্তানের জন্য। যে করেই হোক সন্তানকে বাঁচাতে হবে। খাদ্য আর পানিয়ের খোঁজে সন্ধান করতে লাগলেন সেই সঙ্গে জনবসতির। ধূ ধূ মরুভূমির মাঝে বালি আর বালি মাঝে মধ্যে খেজুর আর বাবলা গাছ নিয়ে এক আধটা মরুদ্যান। সে ত জন প্ৰাণীহীন। তাই বসতির খোঁজে একবার সাফা একবার মারোয়া পাহাড়ে ছুটোছুটি। সন্তান পড়ে থাকে মরুভূমিতে। সাফা মারোয়া পাহাড়ের পাদদেশে। একবার। দু'বার। তিনবার নয়, সাত, সাত বার সাফা মারোয়া পাহাড়ে ছুটোছুটির পর সন্তানের কাছে ফিরে এসে দেখেন শিশুর পদতলে সৃষ্টি হয়েছে এক ঝরণা। বালি দিয়ে দিলেন বাঁধ। শোকরিয়া আদায় করে দাঁড়িয়ে আঁজলা ভরে পান করলেন পানি। কালক্রমে এই ঝরণা হল কূপ। নামকরণ হল জমজম। জমজম অর্থ ভীড়পূর্ণ স্থান। কেননা এই কূপকে কেন্দ্র করে ক্রমে জমজমাট বসতি শুরু হয়ে যায়। কিভাবে?
জরহুম গোত্রের এ কাফেলা সাফা-মারোয়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখল বেশ কিছু পাখি উড়ছে আর কিছু পাখির কলতান। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তারা বুঝতে পারল এখানে নিশ্চয় খাদ্য পানিয়ের ব্যবস্থা আছে। দেরী না করে উট ও ঘোড়ার লাগামে টান দিল। একে একে উট ঘোড়াগুলোকে গাছে বেঁধে দেওয়া হল। যা ভাবনা তাই বাস্তব। একটু খোঁজাখুঁজির পরই মিলে গেল পানির সন্ধান। আছে পানির কূপ কিন্তু অবাক কাণ্ড তার পাশে বসে আছে এক ফুটফুটে শিশু নিয়ে তার মা। কাফেলার সর্দার শিশুর মাকে শুধাল তারা কি এই পানি ব্যবহার করতে পারবে। মা হাজেরা জানাল পানি ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু কূপের প্রতি তাদের কোন অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না।
সূচনা হল এক নবতম শহর পত্তনের গোড়ার কথা। আদি কথা। সূচনা। এ যে বাতি জ্বালাবার আগে সলতে পাকান। স্রষ্টা রহমত করে দূর করে দিলেন হাজেরার একাকীত্ব শিশু সন্তানকে নিয়ে। আর জরহুম গোত্রের কাফেলার লোকজন প্রসারিত ভূমি ও পানি পেয়ে শুরু করল বসতি।
পিতা ইবরাহিম আ. মাঝে মধ্যে এসে সন্তান ও স্ত্রীকে দেখে যান। বয়সকালে ইসমাইল আ. এই জরহুম গোত্রের এক কন্যাকে সাদী করে সংসার জীবন যাপন শুরু করলেন। অন্যান্য কাফেলার লোকজন এসে জমজম কূপকে কেন্দ্র করে বসতি শুরু করল। আরবে পানির অভাব চরম পরম। এখানে সে অভাবটুকু নেই। অঢেল পানি। আর এ পানি যে সে পানি নয়, এ পানি তৃষ্ণা মেটায়, ক্ষুধাও মেটায়। কিছুদিন পর ইবরাহিম আ. এলেন পুত্র যুবক ইসমাইল আ. কে নিয়ে। আল্লাহর ঘর কাবাকে পুণঃনির্মান করলেন। তারপর ডাক দিলেন বিশ্বমুসলিমকে কারা কেন্দ্রীক হজের জন্য। হজ শুরু হল। মানুষ কাবাকে কেন্দ্র করে তওয়াফ করে (চক্র দেওয়া)। কিন্তু কালক্রমে মানুষ আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে কাবায় ঢোকাল নানা পাথর আর মাটির মূর্তি। ঠাঁই পেল তাদের দেবদেবীবৎ হোবল, লাত, মানত, ওড্ডা, অসংখ্য মাটির ঘোড়া ও পাখি অনেকের হিসাবে ৩৬০টি। মানুষ আল্লাহকে ভুলে এসব দেবদেবীর পূজা করতে লাগল।
৫৭০ খৃীষ্টাব্দে হজরত মুহাম্মদ স. জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগ্রহণ করেন আরবের মক্কা নগরে। পিতামহ আব্দুল মোত্তালেব। জন্মের পূর্বে পৃথিবী ত্যাগী পিতা আব্দুল্লাহ। পিতৃব্য আবুতালিব। মাতা আমিনার গর্ভে। জন্মের সময় তাঁর ধাত্রী মা হন ওম্মে আইমন ও সোয়ায়বিয়া। মাত্র ১০ দিন মত মাতৃক্রোড়ে থাকেন। এ সময় তিনি সোয়ায়বিয়া ও মা আমিনার স্তন পান করেন। পরে আরবের রীতিনুযায়ি তিনি হালিমার গৃহে যান। এই হালিমা হন তাঁর দুধ মা। এখানে তিনি হালিমার পুত্র আব্দুল্লাহকে দুধ ভাই হিসাবে পান আর সাইমাকে দুধ বোন হিসাবে। এখানে ৫ বছর অতিবাহিত করে মা আমিনার কাছে ফেরেন মুহাম্মদ স.। আমিনা পুত্রকে রেখে বিশ্ব ত্যাগ করেন মুহাম্মদ স. যখন ৬ বছরের বালক। এবার অভিভাবক হলেন দাদাজী আব্দুল মোত্তালেব। দু'বছর পর তিনি এন্তেকাল করলে চাচা আবু তালিব তাঁর অভিভাবক হন। ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের খাদিজাকে স্ত্রীত্বে বরণ করেন। ৬০৫ খৃস্টাব্দ থেকে স্রষ্টার খোঁজে তপস্যা শুরু। ৬১০ খৃষ্টাব্দে স্রষ্টা তথা আল্লাহর খোঁজ পেয়ে হলেন নবী। নাজিল হল কোরআন। প্রচার শুরু করলেন, আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ। আমাদের উচিত একমাত্র তাঁরই উপাসনা করা। প্রথমে তাঁর স্ত্রী খাদিজা ইসলামে দীক্ষা নিলেন। তারপর তাঁর চাচাত ভাই বালক আলি (১০ বছর বয়স) তারপরই পুরুষ বয়স্কদের মধ্যে প্রথম মানুষ হিসাবে আবু বকর সিদ্দিকী রা.।
কাবা দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল কোরায়েসদের ওপর। আরবের অতি সম্ভ্রান্ত বংশ কোরায়েস। কোরায়েস অর্থ ব্যবসায়ি। এই কোরায়েস বংশে আরবের মক্কা নগরে হজরত মুহাম্মদ স. এর জন্মের ঠিক তিন বছর পর ৫৭২ খৃষ্টাব্দে হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যনাম আব্দুল্লাহ। আবু বকর তাঁর ডাকনাম। কুনিয়াত নাম কোহাফা। পিতা ছিলেন ওসমান। মাতা উম্মুল খায়ের সালমা বিনতে সাখর। মাতা পিতা উভয়েই তায়িম গোত্রের মানুষ ছিলেন। হজরত মুহাম্মদ স. হাসেমী গোত্রের মানুষ। তায়িম গোত্রও ছিল ব্যবসায়ী গোত্র।
আবু বকর সিদ্দিকী শিশু ও বালককালে হজরত মুহাম্মদ স. এর খেলাধূলার সাথী ছিলেন। শিশুকালে পিতার কাছে শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চতর শিক্ষা না নিয়ে অল্প বয়সে ব্যবসায় যুক্ত হল। ব্যবসা বলতে মূলত কাপড়ের ব্যবসা। স্থানীয় ব্যবসায়িদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির। সেই সংগে মক্কার ১৭ জন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতমজন। কোরায়েসদের বংশপঞ্জি সম্বন্ধে তাঁর সবিশেষ জ্ঞান ছিল।
হজরত মুহাম্মদ স. হেল ফলু-ফজুল গঠন করেন (৫৯৫ খৃষ্টাব্দে)। এই হেল-
ফুল-ফজুলের একজন হয়ে রসুল স. এর সংগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ সেবা করেছেন। ৬১০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ স. যখন নবুওত পান সে সময় হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে ছিলেন। ইয়েমেন থেকে দেশে ফিরে শুনলেন হজরত মুহাম্মদ স. নবুওত পেয়েছেন। তিনি এক আল্লাহর কথা বলছেন। ঐ আল্লাহই আমাদের সকলের প্রভু। সৃষ্টিকর্তা। একমাত্র উপাস্য।
কোন রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব নয়। হজরত মুহাম্মদ স. কে তিনি শিশুকাল থেকে চেনেন। বহু সুখ দুঃখের সাথী তিনি। তিনি ত কখনও মিথ্যা বলেননি। অসত্য বলেননি। বাজে কথা বলেননি। বাজে কাজ করেননি। তাঁর মধ্যে কোন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখা যায়নি। তিনি সদা সর্বদা সত্যের পূজারী। আদর্শ মানব। অতএব তিনি নিশ্চয় সত্য কথা বলছেন। সত্য বচনই তাঁর পরিধান। আর দেরী এবং বাক্য ব্যয় না, সরাসরি তিনি উপস্থিত হলেন বর্তমান নবী, পূর্বের সাথী হজরত মুহাম্মদ স. এর কাছে। মুখে পড়ে নিলেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহো মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই, মুহাম্মদ স. তাঁর দূত বা রসুল। কলেমা পড়ার সাথে সাথে তিনি হলেন বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম মুহাম্মদ স. এর হাতে হাত দিয়ে ইসলাম গ্রহণের মর্যাদায় ভূষিত। পরে দেখব এ দৃঢ় বিশ্বাস, এ দ্বন্দ্বহীন বিশ্বাস, দ্বিধাহীনতা তাঁকে এনে দিয়েছে গণ্ডা গণ্ডা সম্মান। অবশেষে তিনি স্রষ্টার তরফ থেকে বেহেসতের সুসংবাদ পেয়েছেন। শুধু তাই নয় আশারায়ে মোবাসেরাদের প্রথমেই ছিল তাঁর নাম।
শারীরীক গঠনের দিক থেকে তিনি ছিলেন অতি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। খুব বড় দেহধারী ছিলেন না। রঙ ছিল গৌরবর্ণ, ললাট ছিল প্রশস্ত, উন্নত নাসিকা, সামান্য বড় সাইজের মাথা, উজ্জ্বল চোখ, বলিষ্ঠ লম্বা হাত। দেহের গঠন সুশোভিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। দেখা মাত্রই শত্রু মিত্র সকলের মনে জাগতে সম্ভ্রম। বংশ তালিকার দিকে লক্ষ করলে দেখি পিতা ছিলেন ওসমান। কুনিয়াত নাম কোহাফা। তাই অধিকাংশ মানুষ তাঁকে আবু কোহাফা নামে ডাকত। মোররাহ-র পুত্র ছিলেন তায়েম। এই তায়েম-এর নামানুযায়ি তাঁর গোত্রের নাম হয় তায়িম। তায়েম পুত্র সাআদ। সাআদ পুত্র কাআর। কাআব পুত্র আমর। আমর পুত্র আমির। আমির পুত্র আবু কোহাফা (ওসমান)। কোহাফা পুত্র আবুবকর রা.। আবু বকর রা. পুত্র মুহাম্মদ।
আরবভূমি শিক্ষা দীক্ষায় ছিল দারুণভাবে পিছিয়ে। এরই মাঝে আবু বকর সিদ্দিকী রা. শিক্ষাঙ্গনে এক অন্যতমজন ছিলেন। ততকালিন দিনে তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন বললে অভুতি হয় না। মক্কাবাসীর সাধারণ চরিত্র,
আচার আচরণ সম্বন্ধে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। আরবের প্রায় প্রতিটি গোত্রের নসব নামা তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। আরবীর নসবনামা জাননেওয়ালা ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতমজন।
আবু বকর রা. শুধুমাত্র একজন জ্ঞানী ও গুণীজন ছিলেন তাই নয় সেই সঙ্গে তাঁর কলমও চলত। তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখে রেখে গেছেন। এছাড়া অন্যান্য রচনাও আছে। আরবী সাহিত্যের কয়েকজন কবির মধ্যে আবু বকর রা.ও ঠাঁই পেয়ে থাকেন। আবু বকর রা. বংশগতভাবে বিদ্যান, চরিত্রবান, আমানতদার, সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও সাধুতার জন্য শুধু কোরায়েসদের মধ্যে নয় সমগ্র আরবের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। ততকালিন দিনে মক্কায় খুব কম ব্যক্তি ছিলেন আমানতদার। এদিক দিয়ে আবু বকর রা. বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হন।
আবু বকর সিদ্দিকী রা. চরিত্রের পরিচ্ছন্নতার জন্য পেয়েছিলেন হজরত মুহাম্মদ স. এর মত মানুষকে খেলার সাথী থেকে ব্যবসা অতিক্রম করে সাধনা, সিদ্ধি, যুদ্ধক্ষেত্র, নামাজের আসনে তারপর তাঁর এন্তেকালের পর ধর্মীয় ও শাসন ক্ষমতায় বন্ধু মুহাম্মদ স. এর আসনে।
বন্ধুত্বের ফলশ্রুতিতে দেখি প্রথমতঃ বিদেশ থেকে এসে সংবাদ পেয়েই কোন রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে ইসলাম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়তঃ হিজরতের সময় তিনি ছিলেন রসুল সংগী। তৃতীয়তঃ হিজরতের পথে সত্তর গুহায় বন্ধুর জন্য তিনি সাপের দ্বারা আক্রান্ত হন তথাপীও কোন উচ্চবাচ্য করেননি। চতুর্থতঃ তিনিই মদিনা হিজরতের যান আল-কাসোয়া মুহাম্মদ স. কে দেন যদিও তা অর্থের বিনিময়ে। পঞ্চমতঃ মদিনায় যাত্রাকালিন সওর গুহায় তাঁর নির্দেশে তাঁর কন্যা আসমা তাঁদের খাদ্য পানিয় পৌঁছে দিত ষষ্ঠতঃ ৬২১ খৃষ্টাব্দে মেরাজ থেকে ফিরলে সকলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখালেও আবু বকর রা. নির্দিধায় এই হিজরতকে স্বীকার করে নেন আর তার ফলস্বরূপ সিদ্দিক (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত হন। সপ্তমতঃ মদিনায় উপস্থিত হয়ে রসুল স. মসজিদ তৈরীর জমি কিনতে গেলে ইনিই জমি কেনার ১০ দিনার দেন। অষ্টমতঃ বদর, ওহদ, খন্দক সহ কোরায়েসদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ ও অভিযানে আবু বকর সিদ্দিকী রা. যোগদান করেন। নবমতঃ রসুল স. এর অনুপস্থিতিতে ইনিই মসজিদে নববীতে ইমামতি করেন। ১৭ বার এমামতি ও একবার খোৎবা প্রদান করেন। দশমতঃ মক্কা বিজয়ের পর হজ ফরজ হলে প্রথম ফরজ হজ আদায় করতে গিয়ে ইনিই হন প্রথম আমীরূল হজের অধিকারী। একাদশতমঃ ইনার কন্যা হজরত আয়েষা রা. রসুল করিম স. এর একমাত্র কুমারী স্ত্রী হবার মর্যাদা পান। পরে দেখেছি এই আয়েষা রা. বহু মর্যাদার অধিকারী হন। ইনি মহিলাদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেন (২২২৫টি) আয়েষা রা. ঘরে থাকাকালিন পবিত্র কোরআন নাজিল হত। আয়েষা রা. সামনে রেখে মুহাম্মদ স. নামাজ আদায় করেছেন। আয়েষা রা কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন মুহাম্মদ স.। আয়েষা রা. ঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত। এই আয়েষা রা. দেন মোহর আবু বকর রা. দিয়ে দেন। দ্বাদশতঃ হজরত মুহাম্মদ স. এর পর আবু বকর রা. খেলাফতির আসনে বসেন ত্রয়োদশতঃ আশারায়ে মোবাশেরাদের অন্যতমজন ছিলেন আবু বকর রা. শু তাই নয় এর নামই ছিল সর্বাগ্রে। চতুর্দশতঃ মসজিদে নববীর পাথর বসাতে গিয়ে রসুল স. এর পর ইনিই পাথর বসান। পঞ্চদশতঃ রসুল স. এর ঠিক পাশে ইনি চির নিদ্রায় শায়িত।
হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. রসুল মুহাম্মদ স. এর কাছ থেকে সিদ্দিক উপাধী পান। সিদ্দিক অর্থ সত্যবাদী। এরপর থেকে আবু বকর সিদ্দিক রা বংশধরদের সিদ্দিক বলা হয়। আবু বকর সিদ্দিক রা. অন্য উপাধি ছিল আতিক। ইসলামের জন্য আবু বকর সিদ্দিক রা. দান সীমাহীন নানা দিকে নানা ভাবে তিনি ইসলামের খেদমত করেছেন। একজন রেইস (সম্ভ্রান্ত) মানুষ হিসাবে তিনি ইসলামের ছায়ায় এসে মুহাম্মদ স. এর হাতকে মজবুত করেছেন। মুহাম্মদ স. যখন নিরক্ষর তখন একজন শিক্ষিত মানুষকে পেয়েছেন। আবু বকর এসেছেন একজন ব্যবসায়ি ধনশালী ব্যক্তি হিসাবে যাঁর ধন সম্পদ অকাতরে ইসলামের কাজে লেগেছে। একজন বিশ্ব ভ্রমণকারী ব্যক্তি হিসাবে ইসলামের মধ্যে এসে তাঁর অভিজ্ঞতাকে ইসলামের কাজে লাগিয়ে ইসলামকে সমৃদ্ধশালী করেছেন তিনি তাঁর অর্থ হৃদয় মন দিয়ে বহু দাসকে মুক্ত করেছেন এঁর মধ্যে অন্যতম জন ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন হজরত বেলাল রা.। বেলাল রা. দাস অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করলে তার প্রভু বেলাল রা. ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে কিন্তু রসুল করিম স. এর নির্দেশে নিজের তাগিদে একজন দাস ও সেই সংগে অর্থের বিনিময়ে বেলাল রা. কে মুক্ত করেন। তেমনি নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে যাঁদের ইসলামের আলোয় আনেন তাঁরা হলেন হজরত জোবায়ের রা., হজরত ওসমান গণি রা., হজরত সাদ রা., হজরত তালহা রা., হজরত আব্দুর রহমান ইবন আফফান রা.। এছাড়া তাঁর অর্থে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন হজর খাব্বান, হজরত আম্মার রা.। আবু বকর সিদ্দিক রা. যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন কোন বাইরের মানুষ ইসলামের ছায়ায় আসেননি। তাই আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহণ সম্বন্ধে নবী মুহাম্মদ স. এর উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য—
আমি যখনই ইসলাম সম্বন্ধে কাউকে কোন কথা বলেছি দ্বিধাহীন চিত্তে কেউই গ্রহণ করেনি। কিছু কিছু সন্দেহ, সংকোচ মনে গ্রহণ করেছে। কিন্তু একমাত্র আবু বকরকেই দেখেছি বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায় আমার যেকোন আদেশ ও নিষেধকে অন্তর থেকে সানন্দে গ্রহণ করেছে। আবু বকর সিদ্দিক রা. ইসলাম গ্রহণের মধ্যে একটা বড় জিনিষ লক্ষ করার বিষয় প্রথম যে দুজন মুসলমান হন দুজনেই মুহাম্মদ স. এর আপনজন। প্রথমজন খাদিজা রা. তাঁর স্ত্রী। দ্বিতীয় জন আলি রা. তাঁর চাচাত ভাই। আবু বকর সিদ্দিক রা. ইসলাম গ্রহণ করেন অবশ্যই ৬১০ খৃষ্টাব্দ, ১২ হিজরী পূর্বাব্দ।
→ নানা কাজে প্রথম আবু বকর সিদ্দিকী রা.
• সাবালক পুরুষদের মধ্যে প্রথম মুহাম্মদ স. এর কাছে ইসলাম গ্রহণ।
• ৬২২ খৃষ্টাব্দ মদিনা হিজরতে রসুল স. এর সংগী।
• ৬৩২ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ স. এর এন্তেকালের পর প্রথম খলিফা।
• খাদিজার পর প্রথম মহিলা হিসাবে ইসলাম গ্রহণ করেন ইনার মা ওম্মল খায়ের।
• আশরায়ে মোবাসেরা (বেহেসতদের সুসংবাদ প্রাপ্ত) দের মধ্যে প্রথমজন ।
• ইনি সেই ব্যক্তি যিনি রসুল স. এর জীবিত থাকাকালিন মসজিদুন্নবীতে ইমামতি করেন।
• মেরাজ থেকে রসুল স. ফিরলে ইনিই প্রথম এর বাস্তবতা স্বীকার করেন।
• রসুল স. বেঁচে থাকাকালিন আবু বকর সিদ্দিকী রা. জুমায় খোৎবা প্রদান
করেন।
• ৬৩১ খৃষ্টাব্দে প্রথম হজ যাত্রার আমির হয়ে প্রথম আমিরূল হজের মর্যাদা
লাভ করেন।
• আবু বকর সিদ্দিকী রা. তাঁর কন্যা আয়েষা রা.কে মুহাম্মদ স. এর হাতে তুলে দেন এবং ইনি হন একমাত্র কুমারী স্ত্রী।
• খলিফা থাকাকালিন ৬৩৩ খৃষ্টাব্দ হুকুম দিয়ে পবিত্র কোরআন একত্রিত করেন।
• প্রায় ৭০০ ক্রিতদাসকে মুক্ত করে দিয়ে ইনি প্রথম সারির মোজাহেদ। প্রথম বায়তুল মাল স্থাপনকারী।
• প্রথম ভাতা প্রবর্তনকারী।
• প্রথম কোরআন সংরক্ষণকারী।
• প্রথম স্থান সংরক্ষণকারী মসজিদে নববীর।প্রথম বেহেসত প্রবেশকারী সাধারণ মানুষ হিসাবে।
• প্রথম শ্রেষ্ঠ মানব নবী রসুলগণের পর।
• নবীর মুহাম্মদ স. পর প্রথম ইমান আননেওয়ালা।
• আবু সিদ্দিকী রা. রসুল স. পাশে প্রথম শায়িত হন।
• হজরত মুহাম্মদ স. এর শেষ হিজরত তথা মুসলমানদের তৃতীয় হিজরত ইয়াথরেবে তথা মদিনায়। এই হিজরতে রসুল সংগী ছিলেন আবু বকর রা.। তিনিই দেন আল কাসোয়া উট।
• সওর গুহায় লুকিয়ে থাকাকালিন আবু বকর যেমনি তাঁর সংগী ছিলেন তেমনি আবু বকর কন্যা আসমা রা. সেখানে খাদ্য খাবার যোগান দিত। তারপর আবু বকর পুত্র আব্দুল্লাহ ও আমেরকে নিয়ে মোট তিনটি উট নিয়ে আবু বকর রা. মুহাম্মদ স. সহ মদিনার কুবাতে আশ্রয় নেন।
• বদর (৬২৪ খৃষ্টাব্দে) ওহদ (৬২৫ খৃষ্টাব্দ) খন্দক (৬২৭ খৃষ্টাব্দ) প্রতিটি যুদ্ধে মুহাম্মদ স. এর পাশে ছিলেন আবু বকর রা.। এমনকি ওহুদ যুদ্ধে পিতা পুত্র আবু বকর ও আব্দুর রহমান দুই বিপরীত পক্ষে থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে তরবারী ধরে।
৬২৮ খৃষ্টাব্দের হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি রসুল পক্ষের অনেকেই মুসলিম পক্ষের হীনমন্যতার পরিচয় বলে মনে করলেও আবু বকর সিদ্দিক রা. একে একবাক্যে স্বীকার করে নেন। এতে তাঁর রসুল প্রীতির পরিচয় ফুটে ওঠে। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা একে ফতহুম মুবিন তথা মুসলমানদের জয় বলে ঘোষনা করেন।
৬০০ খৃষ্টাব্দে মক্কা বিজয় হলে ১০ হাজার সাহাবী নিয়ে হজরত মুহাম্মদ স. বীর বেশে মক্কা প্রবেশের সময় নিজ উটে আবু বকর রা. তুলে নেন। কাবার চত্তুরে বসে ইসলামে দীক্ষা দেবার সময় এক অতি বৃদ্ধ মানুষ দীক্ষা নিতে উপস্থিত হলে হজরত মুহাম্মাদ স. সবিনয়ে বললেন, আপনি কেন এলেন আমি জানলে আপনার বাড়ি যেতাম। এ বৃদ্ধ লোকটি আর কেউ নয় হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. পিতা কোহাফা। খাদিজা রা. পর প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী মহিলাদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিকী রা. মা। আর আজ পিতা ইসলামের ছায়ায় আসতে আবু বকর রা. সব থেকে সুখী জন।
হজরত মুহাম্মদ স. ৬৩২ খৃষ্টাব্দে পৃথিবী ত্যাগ করলেন। তাঁর শূণ্য স্থান পূরণ নয়। কে মুসলমানদের ধর্মীয় হাল ধরবে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাল ধরবে। এতদিনে ইসলামী সাম্রাজ্যের ১২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃতি ঘটেছে। শত্রুতাও বেড়েছে। সে শত্রু ঘরে বাইরে। এ অবস্থায় রসুল করিম স. এর লাস কবরস্থ করার পূর্বেই আবু বকর সিদ্দিকী রা. খলিফা নির্বাচিত হন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। খলিফা নির্বাচন নিয়ে চারটি দল সৃষ্টি হয়।
• কোরায়েসরা দাবী করে আমাদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচিত হবেন। • আনসাররা বলে আমাদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচিত হবেন।
• মোহাজেররা দাবী করে আমাদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচিত হবেন।
• একদল বলেন, আহলে বায়েত আলি রা. খলিফা হবেন। সকলে বণি সায়েদায় সমবেত হয়ে অনেক আলোচনার পর হজরত আবু বকর রা. খলিফা নির্বাচিত হলেন। খলিফা নির্বাচিত হয়ে খলিফা যে ভাষণ দেন তাহল-
‘হে মুসলমান ভাইগণ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি সর্বশক্তিমান। চিরজীবিত, চিরবিরাজমান। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোন কাজ হতে পারে না। আপনারা সকলেই জেনে রাখুন যে, খেলাফতির জন্য কোনদিনই আমার এতটুকু আগ্রহ বা আকাঙ্খা ছিল না। এ বিষয়ে কোন দিন আমি এতটুকু চিন্তাও করিনি। আমি নিজেকে এরকম কঠিন দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। এই গুরুভার আমার ওপর অর্পণ না করলে খুশীই হতাম। কিন্তু যে কারণেই হোক গুরু দায়িত্ব আজ আমার কাঁধে। আমাকে আজ শত বার চিন্তা করতে হবে। আপনারা যে গুরুদায়িত্ব আমার ওপর ন্যাস্ত করলেন, আমি যেন সে গৌরবজনক গুরুদায়িত্বের সম্মান রাখতে পারি। অবশ্যই আল্লাহর অপার রহমত ব্যতিত তা কোনদিনই সম্ভব নয়।
আমার ধারণা ছিল আপনারা আমা অপেক্ষা কোন যোগ্য ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব দেবেন। কেননা আমি আপনাদের মধ্যে মোটেই যোগ্যতর ব্যক্তি নই। আমার থেকে বহু যোগ্যতর ব্যক্তি আপনাদের মধ্যে আছে। তবুও আপনারা আমাকে খলিফা নির্বাচিত করলেন। আমি এখন আল্লাহর রহমত ও আপনাদের সাহায্য প্রার্থনা করছি আমি আজ প্রকাশ্যে ঘোষনা করছি আমি যতদিন আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে যতটুকু অনুসরণ করব আপনারা ততদিন ততটুকুই আমাকে অনুসরণ করবেন। আমি যদি ঠিক পথে চলি তবেই আমাকে অনুসরণ করবেন। সত্য ও ন্যায়ই হবে আমাদের একমাত্র নীতি, অন্যায় অবিচার ও মিথ্যার দ্বারা কোন জাতি বড় হতে পারে না। আপনারা উঠুন নামাজে দাঁড়ান আল্লাহ আমাদের সবার ওপর তাঁর অসীম রহমত বর্ষণ করুন।
খলিফা নির্বাচিত হয়ে হজরত আবু বকর রা. চার প্রকার সমস্যার
মুখোমুখী হন—
• বৈদেশিক আক্রমণ • স্বধর্ম ত্যাগের হিড়িক • জাকাত বিরোধী আন্দোলন
• মিথ্যা তথা ভণ্ড নবীর আবির্ভাব।
বৈদেশিক আক্রমণের ভয় রসুল স. এর সময় থেকে ছিল। মুতার যুদ্ধে শহীদদের প্রতিশোধ নেবার জন্য রসুল সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। খলিফা হয়ে আবু বকর সেই কাজকে তৃড়িৎ করলেন। জায়েদ বিন ওসামার নেতৃত্বে সৈন্য প্রেরণ করলেন। ইসলামই পারে একজন দাস পুত্রকেও সমানাধিকার দিয়ে নেতৃত্বে বরণ করতে। তিনি যুদ্ধ নীতি হিসাবে নির্দেশ দিলেন—
• কোন অবস্থাতেই তোমরা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না।
• কোন আমানত খেয়ানত করবে না।
• যুদ্ধক্ষেত্রে হাত, পা, নাক, কান কেটে কষ্ট দেবে না।
• শিশু-নারী-বৃদ্ধকে হত্যা করবে না।
• কোন ফলবান গাছ নষ্ট করবে না।
• সাধারণ মানুষের ক্ষতি করবে না।
জাকাত প্রদান ইসলামে ফরজ। জাকাত হল 'বার্ষিক কর'। সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা ঐ মূল্যের রৌপ্য, সম্পদ অতিরিক্ত থাকলে তার জন্য বছরে চল্লিশ ভাগের একভাগ দান করাকে জাকাত বলে। হজরত মুহাম্মদ স. আল্লাহর নির্দেশে এটা করলেও তাঁর মৃত্যুর পর কতিপয় মুসলমান নিজের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে টাকা দিতে অস্বীকার করে। এদের দমন করা আবু বকর সিদ্দিকী রা. এক বিশেষ কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়তঃ একদল মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করতে চায়। রসুল স. এর মহব্বৎ, তার ক্ষমতা অনেককে ইসলামের পথে নিয়ে আসে কিন্তু আজ তারা দুর্বল মন নিয়ে ইসলাম ত্যাগের বাসনা করলে রসুল স. এর পূর্ণ করতে আবু বকর রা. কড়া ব্যবস্থা নেন। পবিত্র কোরআন ৬১০ খৃষ্টাব্দ হতে ৬৩২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ২২ বছর ২ মাস ১২ দিন ধরে অবতীর্ণ হয়। অন্যভাবে বলা যায় পবিত্র কোরআন রসুল স. এর কাছে তাঁর গ্রন্থেকাপের ৯ দিন পূর্ব পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কোরআন শরীফ- লিপিবদ্ধ করে রাখা হলেও একত্রিত করা হয়নি। গাছের ছালে, খেজুর পাতায় ও খেজুর আঁটিতে, চামড়ায়, হাড়ে, পাথরে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। রসুল স. এর এস্বেকালের পর একে একত্রিত করণের প্রয়োজন দেখা দেয়। হজরত আবু
বকর সিদ্দিক রা. জায়েদ বিন সাবিতের নেতৃত্বে কোরআন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পবিত্র কোরআনকে একত্রিত করান। কেননা তিনি দেখেছিলেন কোরআন এভাবে যেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তেমনি আছে কোরআনে হাফেজদের অন্তরে। সেই সব হাফেজ এন্তেকাল করলে অসুবিধার সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০ হাফেজ এন্তেকাল করলে তিনি বিশেষ চিন্তিত হয়ে অন্যান্যের পরামর্শ নিয়ে এই মূল্যবান কাজটি সম্পন্ন করেন। এবং এন্তেকালের পূর্বে হজরত ওমর ফারুক রা. হাতে সংকলনটি তুলে দেন। আবার ওমর রা. এন্তেকালের পূর্বে এটাকে তাঁর কন্যা রসুল পত্নি হাদিসে হাফেজা হজরত হাপসা রা. হাতে তুলে দেন। এই সংকলিত কোরআন আজও চলে আসছে। যদিও পরবর্তিতে তাতে জের, জবর, পেশ যোগ করা হয়েছে।
বিশাল সাম্রাজ্যের খলিফা হয়ে বসলে দেশের মানুষ যখন তাকে খলিফাতাল্লাহ বলে ডাকত তখন তিনি বলতেন তোমরা আমাকে 'খলিফাতুর রাসুল* রসুল স. এর খলিফা বলে ডাকবে। এটা তাঁর রসুল প্রীতির নিদর্শন। খলিফা হবার পরও তিনি ব্যবসার মালপত্র তথা কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে বাজারে যেতেন। পরে কাজের চাপে তা বন্ধ হয়। এবং রাজকোষ তথা বায়তুল মাল থেকে মাসিক ৫০০ রৌপ্য মুদ্রা ভাতা ধার্য্য করলে তিনি তাই দিয়েই সংসার কার্য নির্বাহ করতেন। এন্তেকালের সময় তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীদের নির্দেশ দিয়ে যান যেটুকু অর্থ আমি ভাতা হিসাবে নিয়েছি তা যেন বায়তুল মালে (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) ফেরত দেওয়া হয়।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক ছিলেন। তিনি রসুল স. এর পাশে থেকে যেমনি হাদিস বর্ণনা করেছেন তেমনি তিনি ছিলেন হাদিসের শিক্ষক। তার কাছে হজরত ওমর, ওসমান, আলি, আনাস, জোয়ায়ফা, আৰু হোরায়রা, আবু সাঈদ, বেলাল, হজরত আয়েষা প্রমুখ সাহাবীরা হাদিস শিক্ষা করে বর্ণনা করেছেন।
শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি দুটো জিনিষকে মেনে চলতেন সূর্যবং কোরআন আর চন্দ্রবং হাদিস। তৃতীয়টি হল ইজতেহাদ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সদা সর্বদা জ্ঞানী, গুণী, পুরাতন ও বয়স্ক সাহাবীদের পরামর্শ নিতেন। শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য দেশকে কয়েকটা ভাগে
ভাগ করেন।
শাসনকার্য চালাতে গিয়ে তিনি বলতেন, 'আমরা সাধারণ মানুষ। ভুল আমাদের চিরসংগী, সাথী।'
দায়িত অর্পণ করেন। তার বকর সিদ্দিক রা. ও ওমর ফারুক রা. কেই বিচার বিভাগের
দায়িত্ব প্রদান করেন
পারিবারিক জীবনে দেখেছি তাঁর আম্মাজান ইসলামের প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণ করলেও পিতা মক্কা বিজয়ের পর ৬৩০ খৃষ্টাব্দে ইসলামের ছায়ায় আসেন। পিতা ইসলাম গ্রহণ করেন মৃত্যুর চার বছর পূর্বে অর্থাৎ পিতা কোহাফা দীর্ঘ জীবন লাভ করে ১৪ বৎসর বয়সে আবু বকর সিদ্দিকী রা. এন্তেকালের ছ'মাস
পর এস্তেকাল করেন।
সংসার জীবনে আবু বকর রা. চারটি নারীর পাণি গ্রহণ করেন। দুটো মাক্কী জীবনে। দুটো মাদনী জীবনে। স্ত্রীরা হলেন- কুতাইলা, উম্মে নোমান, আসমা, হাবিবা, পুত্র-পুত্রীরা হলেন- আব্দুল্লাহ, আসমা, আব্দুর রহমান, আয়েষা, মুহাম্মদ • কুলসুম। কুলসুমের জন্ম হয় আবু বকর রা. এন্তেকালের পর।
হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে প্রথম কিছুদিন রসুল স. এর কাছে ছিলেন তারপর তিনি মদিনার ভাই হিসাবে পান জারিয়া ইবনু জায়েদ রা. কে। তারপর মদিনার একধারে মুন্নাহ নামে এক পল্লীতে স্ত্রী হাবিবার সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকে প্রত্যহ পায়ে হেঁটে রসুল ২. এর ইমামতিতে নামাজ পড়তে মসজিদুন্নবীতে আসতেন। ঘোড়ায় চেপে ফজরের নামাজে ইমামতি করতে আসতেন।
মসজিদে নববীতে বসে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। অতি সাধারণ (সকলের মত) জামা কাপড় পরিধান করতেন। অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। একদিন স্ত্রী হাবিবা তাঁকে মিষ্টি আনতে বলেন, তিনি বলেন, মিষ্টি কোথা পাব? রাজভাণ্ডারে যা কিছু আছে তা সবই জনগনের।
আচার আচরণে আবু বকর সিদ্দিকী রা. ছিলেন রসুল স. এর ছায়া।
বিদ্যা ও বুদ্ধিতে ছিলেন অদ্বিতীয়। নসবনামা বিদ্যায় খুব খুব পারদর্শি ছিলেন। ইসলাম তারিরে খোদা প্রদত্ত জ্ঞান রাখতেন। কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান ছিল অতুলনীয়।
আল্লাহর এবাদতে রাত জাগতেন। অধিকাংশ সময় দিনে রোজা রাখতেন। কোরআন পাঠের সময় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত।
নামাজে দাঁড়ালে মনে হত কাঠ দাঁড়িয়ে আছে।
খলিফা হবার পূর্বে ও পরে সাধারণ জীবন যাপন করতেন। রুটি, মোটা কাপড় পরতেন। খাদ্যের অভাবে কোন কোন সময় তিন দিন না খেয়ে
থেকেছেন। পরিধেয় বস্ত্রের অভাবে মোটা কম্বল পরে থেকেছেন।
খোদার শাস্তির ভয়ে বলতেন, মানুষ না হয়ে বৃক্ষ হলে ভাল হত। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের খুব ভালবাসতেন। তাদের নিয়ে গল্প করতেন। হাস্য কৌতুক করতেন।
খলিফা হয়েও সাংসারিক কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতেন। কাপড় পরিষ্কার করতেন, ঘর ঝাড়ু দিতেন, জুতো সেলাই করতেন।
ইসলাম গ্রহণের সময় আবু বকর রা. সম্পদ ছিল ৪০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। মদিনায় যাবার সময় ৫ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। এন্তেকালের সময় কপর্দকহীন। সবই দান করে দিয়েছেন। তাঁর খেলাফতি জীবন ছিল ফকিরি জীবন। তাবুক অভিযানের সময় রসুল স. সাহাবীদের কাছে সাহায্যের আবেদন রাখেন। আবু বকর রা. তাঁর সমস্ত সম্পদ হজরত মুহাম্মদ স. এর পদতলে এনে দিলে মুহাম্মদ স. অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, হে আবু বকর তুমি নিজের জন্য কি রেখে এলে, জবাবে আৰু বকর রা. বলেন, আমি আল্লাহ স. ও তাঁর রসুলকে রেখে এসেছি।
ইসলামে কয়েকটা জায়গায় প্রতিযোগিতা করা যায়। দানে • এবাদতে • ভালবাসায় • বিদ্যায়।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. উপরোক্ত প্রায় প্রতিটি বিষয়ে প্রতিযোগিতা
করেছেন।
রসুল হজরত মুহাম্মদ স. এর পর ন্যায় নীতি, রসূলী আদর্শ নিয়ে যেভাবে কঠোর হস্ত ও কোমল হৃদয় নিয়ে দেশ শাসনে হাত দেন এবং ২ বছর তিন মাস খলিফা হিসাবে দেশ শাসন করেন তাতে তাকে ঐতিহাসিকরা ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসাবে অভিহিত করেন। এছাড়া উপাধি হিসাবে পান প্ৰথম ৰলিফা • সিদ্দিকী • সিদ্দিকে আকবর • খোলাফায়ে রসুল • খলিফাতুল মুসলেমিন • বদরী • আমিরূল হজ।
৫৭২ খৃষ্টাব্দে জন্ম। নানা ঝড় ঝঞ্ঝার মাঝে থেকে ৬৩ বসন্ত অতিক্রম করে পরপারের ডাকে সাড়া দেন। সাল হিসাবে এটা ৬৩৪ খৃষ্টাব্দের অগাষ্ট মাসে মাত্র ২ বছর তিন মাস খেলাফতি করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অসুস্থ অবস্থায় নিজ কন্যা আয়েষা রা.কে ডেকে বললেন, মা আমি খলিফা হিসাবে রাজকোষ থেকে মোট কত টাকা নিয়েছি বেতন হিসাবে?
বুদ্ধিমতি আয়েষা রা. বলেন, সর্বমোট ৬০০০ দিরহাম। খলিফা নির্দেশ দিলেন আমার একটা নিজস্ব সম্পত্তি আছে। এটাকে বিক্রি করে ঐ ছ'হাজার দিরহাম রাজকোষে ফিরত দিবে।
এবার খলিফা জিজ্ঞাসা করলেন, আমার সংসার যাত্রার জন্য কি কি জিনিষ আছে? একটি হাবসী আংশিক সময়ের দাস, এক খণ্ড বস্ত্র ও একটা উট। আসন্ন মৃত্যু দূতকে সালাম জানাবার পূর্বে খলিফাতুল মুসলেমিন হজরত আবু বকর সিদ্দিকী রা. বললেন, যা কিছু আছে আমার মৃত্যুর পর খলিফা ওমরের কাছে পৌঁছে
দিও।
জেনে নিলেন মুহাম্মদ স. এর কাফনে কটি কাপড় লেগেছিল? আয়েষা রা. বললেন, তিন টুকরো। শুনে খলিফা রা. বললেন, আমাকেও তিন টুকরো দিও। আমার পরণে দুটুকরো আছে আর এক টুকরো কিনে নিও। এবং এই দুটুকরো
পুরাতন কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নিও।
মৃত্যুর পূর্বে শোনা গেল ‘প্রত্যেক অশ্বারোহী তার মঞ্জিল খোঁজে।' বললেন, আল্লাহ তুমি আমাকে ইমানের সাথে মৃত্যু দাও। সোমবার ২২ জমাদিয়ল আউয়াল, ১৩ হিজরী ৬৩৪ খৃষ্টাব্দ, ২৩ অগাষ্ট মগরিব ও এশার নামাজের সময়ের মধ্যবর্তিকালে এন্তেকাল করেন।
বহু সাহাবা ও তাবেয়িনদের উপস্থিতিতে নতুন খলিফা যিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই ওমর ফারুক রা. জানাজার ইমামতি করেন রসুল হজরত মুহাম্মদ স. এর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। একদিন পাশাপাশি, কাঁধাকাঁধি হয়ে পা ফেলে, হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করেছেন। মদিনার মসজিদের পাশে যেখানে রসুল স. শুয়ে আছেন তারই পাশে রসুল স. এর কোমর বরাবর আবুবকর সিদ্দিক রা. এর মাথা রেখে কবরস্থ করা হয়।
আবু বকর সিদ্দিক রা. রেখে গেলেন সেই আদর্শ! বীরত্ব কারো অস্ত্রে, কব্জিতে, বড় বড় কথায়, সম্রাটের সিংহাসনে, লোকবলে নয়, বীরত্ব ত্যাগে, ক্ষমায়, সেবায়, মহত্বে, ঔদার্যে, ভালবাসায়, প্রেমে, নিষ্ঠায়, একাগ্রতায়, আন্তরিকতায়।
এ মৃত্যুর পূর্বে রেখে যাওয়া উক্তি
• আমাকে কেউ আল্লাহর খলিফা বলো না। আমি রসুলের খলিফা। • আল্লাহ ও রসুলকে আমি যতদিন এবং যতটুকু অনুসরণ করব, তোমরাও
ততদিন এবং ততটুকু আমাকে অনুসরণ করবে।
• মিথ্যার দ্বারা কোন জাতি বড় হয় না।
• যেখানেই থাক, একাকী বা সংগী সহ, তোমার অন্তরে যেন সর্বদা আল্লাহর
ভয় থাকে।
• যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জীবিকা এমনভাবে বৃদ্ধি করেন, যা সে
কল্পনাও করতে পারে না।
আমি আপনাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ নই, আপনাদের সকলেরই সাহায্য ও পরামর্শ চাই।
( আবু বকর সিদ্দিকী রা. সম্বন্ধে গুণীজন
•
আমার উম্মতদের মধ্যে আবু বকর রা. বেশী দয়ালু। — মুহাম্মদ স.। ইসলামের খেদমতে কেউ আবু বকর সিদ্দিকী রা. অতিক্রম করতে
ওমর রা.।
পারবে না। চারিত্রিক ও নানাবিধ বৈশিষ্টের জন্যই ইসলামের ইতিহাসে হজরত আবু বকর রা. স্থান মহানবীর পরই।
—মওলানা মুহাম্মদ আলি। • হজরত আবু বকর ইসলামের ত্রাণকর্তা। -গুণীজন। তাঁর নম্রতা একনিষ্ঠতা, অনাড়ম্বর জীবন, অতি সূক্ষ্ম নীতিজ্ঞান, গরীব দরদী মন, কঠিন সংকল্প, হৃদয়ের কোমলতা, ক্লান্তিহীন অধ্যাবসায়, সর্বপরি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি অটল অফুরন্ত বিশ্বাস এবং ভালবাসা প্রভৃতি চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য তাঁর স্থান ইসলামে মহানবীর পর। —মওলানা মুহাম্মদ আলি।
আবু বকর রা. খেলাফত কাল স্বল্পস্থায়ী হলেও মুহাম্মদ স. এর পর আর কারো জীবন তাঁর জীবন পদ্ধতি এমন জীবন্তরূপে গ্রহণ করেনি। ঘনিভূত সংকটে, ঘণঘোর অন্ধকারে হজরত আবু বকরের মত বলিকা না থাকলে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র কোনটাই রক্ষা পেত না। মুসলমানদের ধর্ম ও সমাজ অনিবার্যভাবেই ধ্বংস হত।
-আব্দুল্লাহ বিন মাসউ
0 Comments