আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
পরাধীন বাংলায় এবং ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চায় ও বিজ্ঞান গবেষণায় নবজাগরণ এসেছিল মূলত: দুজন বিজ্ঞানীকে কেন্দ্র করে—এদের একজন হলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং অপরজন হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ই সারা ভারতবর্ষে আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, জ্ঞান বিজ্ঞানে শিল্প সংস্কৃতিতে ব্যবসা বাণিজ্যে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই বাঙালীরা যাতে দেশের প্রথম সারিতে থাকে সে ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ।
১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ২রা আগস্ট অবিভক্ত ভারতবর্ষের (বর্তমানে বাংলাদেশের) যশোহর জেলার রাডুলি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রফুল্লচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রফুল্লচন্দ্রের পিতামহ ছিলেন যশোহর জেলার কালেক্টরীর সেরেস্তাদার। তিনি প্রচুর ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রর বাবা হরিশচন্দ্র রায় সে যুগের একজন স্বনামধন্য ও সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের দেশ তখন ছিল ইংরেজদের অধীনে। শিক্ষার ব্যাপারে হরিশচন্দ্র ছিলেন খুবই বিদ্যোৎসাহী ও প্রগতিবাদী। তিনি সে যুগের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ রামতনু লাহিড়ীর কাছে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষালাভ করেন। এছাড়া তিনি আরবী, ফার্সী, উর্দু এবং ইংরেজী ভাষাও খুব ভালভাবে শিখেছিলেন। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেই সময়কার অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত পণ্ডিত মানুষ যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিশির কুমার ঘোষ প্রমুখেরা হরিশচন্দ্র রায়ের কলকাতার বাড়ীতে নিয়মিত আসতেন। সেই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের এই বাংলাদেশে এসেছিল নবজাগরণের জোয়ার। হরিশচন্দ্র রায়ও সেই সময় এই সব জাগরণের বিভিন্ন কাজকর্মে
অংশগ্রহণ করতেন। সেই সময় আমাদের এই বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে শিক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না। নারীশিক্ষার ব্যাপারে অর্থাৎ মেয়েদেরকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে প্রফুল্লচন্দ্রের মা ভুবনমোহিনী দেবীকে বাংলা শেখাতে আসতেন। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয়ে হরিশচন্দ্র রায় তাঁর গ্রামে একটি মিডল স্কুল ও মেয়েদের জন্য আলাদা একটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষা ও চেতনা যাতে সমাজের সকলের মধ্যে বিস্তার লাভ করে সেই উদ্দেশ্যে হরিশ্চন্দ্র একটি উন্নত মানের লাইব্রেরীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হরিশচন্দ্রবাবুর এই লাইব্রেরীতে তখনকার বিখ্যাত বিখ্যাত পত্রিকা যেমন-হিন্দুপত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, অমৃত প্রবাহিনী, সোমপ্রকাশ-নিয়মিত আসত। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এইরকম এক সংস্কৃতিসম্পন্ন রুচিশীল ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেইজন্য ছোটবেলা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রর মনে শিক্ষা ও সাহিত্যে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রফুল্লচন্দ্রর বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন তাকে গ্রামের এক পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। পণ্ডিতমশায়ের এই পাঠশালা ছিল তার বাড়িতেই। প্রফুল্লচন্দ্রর সঙ্গে রাডুলি গ্রামের কয়েকজন শিশুও এই পাঠশালায় পড়াশুনা আরম্ভ করেছিল। ওই পাঠশালাতে অনেক সময় নানান মজার ব্যাপার স্যাপার ঘটত। বৈশাখ মাসের খুব গরমে দুপুরবেলায় পন্ডিতমশায় ছেলেদের কিছু লিখতে দিয়ে দিবানিদ্রা উপভোগ করতেন। পন্ডিতমশায়ের নাক ডাকার আওয়াজ পেলেই পাঠশালার শিশুরা পাঠশালা থেকে পালিয়ে কাছের কোনও বাগানে কচি কচি আম পেড়ে খেত এবং আবার কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে আসত ওই পাঠশালায়। পন্ডিতমশায় এইসব ঘটনার কোনও টেরই পেতেন না। কিন্তু একদিন তারা ধরা পড়ে গেল – পন্ডিতমশায় প্রফুল্লচন্দ্রর বাবা হরিশচন্দ্রর কাছে সবকিছু জানিয়ে বালক প্রফুল্লচন্দ্রর ব্যাপারে নালিশ জানালেন। সবকিছু শুনে বাবা ছেলেকে বকাঝকা করলেও এই ঘটনায় তিনিও খুব মজা পেলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র ধনী ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার বাল্যকাল কিন্তু বিলাসিতার মধ্যে কাটেনি। বালক প্রফুল্লচন্দ্র যাতে বাল্যকাল থেকে বিলাসী হয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে হরিশচন্দ্র ও ভুবনমোহিনী দেবীর সজাগ দৃষ্টি ছিল। পাঠশালায় পড়া শেষ করে দাদাদের মত ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এই স্কুলটি বাবা হরিশচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—এই স্কুলটি ছিল স্বদেশীয় ভাষায় প্রথম সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল। ওই অঞ্চলে আর কোন স্কুল না থাকায় বহু দূর দূর অঞ্চল থেকে অনেক ছাত্রই ওই স্কুলে পড়তে আসত। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা পন্ডিত মোহনলাল তর্কবাগীশ। তিনি প্রফুল্লচন্দ্রর গৃহশিক্ষকও ছিলেন। এর চরিত্র বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। বাল্যকাল থেকেই প্রফুল্লচন্দ্র প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। রাডুলির কাছে কপোতাক্ষ নদী, নদীর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকে সবসময়ই মুগ্ধ করত। মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় বালক প্রফুল্লচন্দ্র বেড়াতে যেতেন শিক্ষক মোহনলালের সাথে। কপোতাক্ষ নদীতে জোয়ার ভাটা, নৌকাযাত্রীদের কলরব, নৌকায় মাঝিদের ভাটিয়ালি গান বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে মাতিয়ে তুলত। তাদের বাড়ির কাছেই ছিল শাল-সেগুন-আম-জাম-কাঁঠালের এক বিশাল বাগান এবং বাগান থেকে অল্প দূরেই এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলে দেখা মিলত বনবিড়াল, খরগোস, শিয়াল, গোসাপ এবং নানা বিষধর সাপ। এই জঙ্গলের গম্ভীরসুন্দর রূপ বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে খুবই আকর্ষণ করত। সেজন্য প্রফুল্লচন্দ্র বাড়ীর কাউকে কিছু না বলে বন্ধু সতীশের সাথে প্রায়ই ছুটে যেতেন সেই জঙ্গল দর্শনে। একদিন বালক প্রফুল্লচন্দ্র ও তার বন্ধু ওই জঙ্গলে ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়েছিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের এক দুপুরবেলায় জাম খাবার ইচ্ছায় দুই বন্ধু জঙ্গলে হাজির। সতীশ জাম গাছে উঠে পাকা জাম সহ ছোটো ছোটো ডালগুলি ভেঙে নিচে ফেলছেন বন্ধু প্রফুল্লচন্দ্রর কাছে, আর প্রফুল্লচন্দ্র সেই ডাল থেকে জামগুলি পেড়ে রাখছেন। এমন সময় হঠাৎ গাছের উপর থেকে সতীশ লক্ষ্য করল যে কয়েকটা বুনো দাঁতাল শুয়োর ওই জামগাছের দিকে আসছে। সতীশ সেই দৃশ্য দেখে তাড়িতাড়ি তার পরনের ধুতিটা খুলে এক প্রান্ত ডালে বেঁধে দিল আর এক প্রান্ত প্রফুল্লচন্দ্রর কাছে নামিয়ে দিল যাতে প্রফুল্লচন্দ্র ওই ধুতিটা ধরে গাছের ডালে উঠতে পারে। তারপর গাছে উঠে দুজনে প্রাণপণে চিৎকার
শুরু করে দিল। ওই চিৎকার শুনে কয়েকজন চাষী লাঠি নিয়ে ছুটে এসে ওই বুনো শূয়োরদের তাড়িয়ে দিল এবং সে যাত্রায় ওই দুই বন্ধু রক্ষা পেল।
প্রফুল্লচন্দ্র নয় বছর বয়স পর্যন্ত একটানা নিজের গ্রাম রাডুলিতে বসবাস করেছেন এবং গাঁয়েই লেখাপড়া শিখেছেন তারপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। ‘ন’ বছর বয়সের মধ্যেই বালক প্রফুলচন্দ্র বাবার কাছে বসে ‘Lives of British Poets' পড়তেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ইংরেজ মনীষি যেমন কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং বায়রনের জীবনকাহিনীও পড়ে ফেলেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাবার নির্দেশে প্রফুল্লচন্দ্র ও অন্যান্য ভাইদের মাটি কোপাতে হত, নিয়মিত ব্যায়াম ও নৌকা চালনা করতে হত। শারীরিক গঠনের সাথে সাথে ছেলেদের মানসিক গঠনও যাতে ভালভাবে গড়ে ওঠে সে ব্যাপারে হরিশচন্দ্রর সজাগ দৃষ্টি ছিল। হরিশচন্দ্র যদিও জমিদারির নানান কাজে ব্যস্ত থাকতেন তবুও সময় পেলে তিনি তাঁর ছেলেদের সাথে নানান বিষয়ে গল্পগুজবও করতেন। হরিশচন্দ্র গল্পের মাধ্যমে তাঁর ছেলেদের নিজ পূর্বপুরুষের কাহিনী শোনাতেন-
তাঁদের পূর্বপুরুষ মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আমলে বা তার কিছুদিন পর থেকেই রাডুলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর ঠাকুরদা মানিকলাল ছিলেন নদীয়া-যশোহরের কালেক্টরের দেওয়ান। তিনি কর্মজীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তখন এইসব অঞ্চলে ছিল চোর ডাকাতের প্রচন্ড ভয়। সেজন্য তিনি মাটির হাঁড়িতে করে টাকা পাঠাতেন এবং ওইসব টাকার হাঁড়ির টাকার উপর নানা ধরণের মিষ্টি মন্ডা সাজানো থাকতো। ফলে ডাকাতরা ঘুণাক্ষরে টেরও পেত না যে ওইসব মাটির হাঁড়িতে টাকা আছে। তাঁদেরই এক পূর্বপুরুষ শ্রীরাম সেই সময়ে অত্যাচারী ইসলাম গাজীর হাতে নিহত হলে তার ছোট ভাই নীলাম্বর পরিবারের দায়িত্ব নেন। এই শ্রীরামের পৌত্র কমলাকান্ত ছিলেন খুবই সাহসী। তখন মগ, ফিরিঙ্গি ও নানা দস্যুদের নৃশংস অত্যাচারের ভয়ে রাডুলি ও তার চারপাশের অঞ্চলের লোকেরা খুবই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাত। সাহসী কমলাকান্ত এইসব গ্রামবাসীদের রক্ষা করার জন্য এক তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করেছিলেন, এর ফলে জলদস্যু ও মগ ফিরিঙ্গিদের
অত্যাচার অনেক কমে আসে। পূর্বপুরুষদের এইসব কীর্তিকাহিনী বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে খুবই মুগ্ধ করত।
প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর জীবনী মূলক “আত্মচরিত” গ্রন্থে লিখেছেন—” ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে আমি প্রথম কলকাতায় আসি। তখন আমার মনে যে ভাব লাগিয়েছিল তাহার স্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট হইয়া আছে।
আমার চক্ষুর সম্মুখে এক নূতন জগতের দৃশ্য আবির্ভূত হইল।” কলকাতায় তারা প্রথমদিকে ঝামাপুকুর লেনে ও পরে আমহার্স্ট স্ট্রীটে বসবাস করতেন। ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন।
বাল্যকাল থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রর পড়াশোনার দিকে ঝোঁক দেখা যায়। তাঁর রচিত “আত্মচরিত” গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তাঁর বয়স যখন মাত্র ১২ বৎসর সেই সময় তিনি রোজ ভোর চারটের সময় নিদ্রা ত্যাগ করে ইতিহাস বা মহৎ ব্যক্তিদের জীবনচরিত পাঠ করতেন। মাঝে মাঝে গৌরবের সাথে তিনি সহপাঠীদের সেইসব কাহিনীও শোনাতেন। বাংলায় বারভূঁইয়াদের প্রধান স্বাধীনচেতা রাজা প্রতাপাদিত্য যিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করেছিলেন, তাঁর প্রধান ক্ষেত্রগুলি রাডুলি গ্রামেরই নিকটে ছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তও ছিলেন তাদের গ্রামের দৌহিত্র এবং বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর জন্মস্থানও ছিল তাঁদের জেলাতে। হেয়ার স্কুলে পড়বার সময় তিনি কঠিন আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ সারতে প্রায় এক বছরেরও বেশী সময় লেগে যায়—ফলে পড়াশোনার ব্যাপারে প্রায় এক বছর নষ্ট হয় প্রফুল্লচন্দ্রর। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে গ্রামের নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরে আসতে হয়। পরে সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফিরে তিনি হেয়ার স্কুল ছেড়ে ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। কারণ হেয়ার স্কুলের পঠন পাঠনের পরিবেশ বালক প্রফুল্লচন্দ্র কাছে অত্যন্ত প্রাণহীন বলে মনে হত। হেয়ার স্কুলের সেই সময়কার প্রধান শিক্ষকও ছিলেন অত্যন্ত কড়া ধাতের মানুষ। পরবর্তীকালে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর জীবনগ্রন্থ আত্মচরিত লিখেছেন-
“হেয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়। তাঁহার অট্টহাস্য ও মুখভঙ্গী আমাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করত।
তাঁহার বিশাল বলিষ্ঠ দেহ, ঘন গুম্ফ এবং মুখাকৃতির জন্য তাহাকে বাঘের মত দেখাইত। সেইজন্য আমরা তাহার নাম দিয়াছিলাম 'বাঘাচণ্ডী'। পক্ষান্তরে অ্যালবার্ট স্কুলে আমাদের শিক্ষকের শান্ত ও মধুর প্রকৃতির আদর্শস্বরূপ
ছিলেন।”
অ্যালবার্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বিখ্যাত বাগ্মী কেশবচন্দ্র সেন। কেশবচন্দ্র সেনের ভাই কুঞ্জবিহারী ছিলেন অ্যালবার্ট স্কুলের রেক্টর। প্রফুল্লচন্দ্র অ্যালবার্ট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তবে তিনি তার এই রেজাল্টে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রোগভোগ ও শারীরিক দুর্বলতাই প্রফুল্লচন্দ্রর রেজাল্ট খারাপের অন্যতম কারণ। এরপর তিনি ফার্স্ট আর্টস বা এফ এ পড়বার জন্য ভর্তি হন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনসটিটিউশনে। পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের অন্যতম রূপকার রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ছিলেন সেই সময়ে মেট্রোপলিটন ইনসটিটিউশনের ইংরাজীর অধ্যাপক। তাঁর সংস্পর্শে আসার ফলে ছাত্রজীবনেই প্রফুল্লচন্দ্রের মনে গভীর জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের সঞ্চার হয়। তবে এফ. এ. পরীক্ষাতে প্রফুল্লচন্দ্রর ফল আরও খারাপ হয়। 1880 খ্রীস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এফ.এ. পরীক্ষায় পাশ করলেন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।
অংশগ্রহণ করতেন। সেই সময় আমাদের এই বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে শিক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না। নারীশিক্ষার ব্যাপারে অর্থাৎ মেয়েদেরকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে প্রফুল্লচন্দ্রের মা ভুবনমোহিনী দেবীকে বাংলা শেখাতে আসতেন। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয়ে হরিশচন্দ্র রায় তাঁর গ্রামে একটি মিডল স্কুল ও মেয়েদের জন্য আলাদা একটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষা ও চেতনা যাতে সমাজের সকলের মধ্যে বিস্তার লাভ করে সেই উদ্দেশ্যে হরিশ্চন্দ্র একটি উন্নত মানের লাইব্রেরীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হরিশচন্দ্রবাবুর এই লাইব্রেরীতে তখনকার বিখ্যাত বিখ্যাত পত্রিকা যেমন-হিন্দুপত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, অমৃত প্রবাহিনী, সোমপ্রকাশ-নিয়মিত আসত। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এইরকম এক সংস্কৃতিসম্পন্ন রুচিশীল ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেইজন্য ছোটবেলা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রর মনে শিক্ষা ও সাহিত্যে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রফুল্লচন্দ্রর বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন তাকে গ্রামের এক পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। পণ্ডিতমশায়ের এই পাঠশালা ছিল তার বাড়িতেই। প্রফুল্লচন্দ্রর সঙ্গে রাডুলি গ্রামের কয়েকজন শিশুও এই পাঠশালায় পড়াশুনা আরম্ভ করেছিল। ওই পাঠশালাতে অনেক সময় নানান মজার ব্যাপার স্যাপার ঘটত। বৈশাখ মাসের খুব গরমে দুপুরবেলায় পন্ডিতমশায় ছেলেদের কিছু লিখতে দিয়ে দিবানিদ্রা উপভোগ করতেন। পন্ডিতমশায়ের নাক ডাকার আওয়াজ পেলেই পাঠশালার শিশুরা পাঠশালা থেকে পালিয়ে কাছের কোনও বাগানে কচি কচি আম পেড়ে খেত এবং আবার কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে আসত ওই পাঠশালায়। পন্ডিতমশায় এইসব ঘটনার কোনও টেরই পেতেন না। কিন্তু একদিন তারা ধরা পড়ে গেল – পন্ডিতমশায় প্রফুল্লচন্দ্রর বাবা হরিশচন্দ্রর কাছে সবকিছু জানিয়ে বালক প্রফুল্লচন্দ্রর ব্যাপারে নালিশ জানালেন। সবকিছু শুনে বাবা ছেলেকে বকাঝকা করলেও এই ঘটনায় তিনিও খুব মজা পেলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র ধনী ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার বাল্যকাল কিন্তু বিলাসিতার মধ্যে কাটেনি। বালক প্রফুল্লচন্দ্র যাতে বাল্যকাল থেকে বিলাসী হয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে হরিশচন্দ্র ও ভুবনমোহিনী দেবীর সজাগ দৃষ্টি ছিল। পাঠশালায় পড়া শেষ করে দাদাদের মত ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এই স্কুলটি বাবা হরিশচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—এই স্কুলটি ছিল স্বদেশীয় ভাষায় প্রথম সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল। ওই অঞ্চলে আর কোন স্কুল না থাকায় বহু দূর দূর অঞ্চল থেকে অনেক ছাত্রই ওই স্কুলে পড়তে আসত। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা পন্ডিত মোহনলাল তর্কবাগীশ। তিনি প্রফুল্লচন্দ্রর গৃহশিক্ষকও ছিলেন। এর চরিত্র বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। বাল্যকাল থেকেই প্রফুল্লচন্দ্র প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। রাডুলির কাছে কপোতাক্ষ নদী, নদীর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকে সবসময়ই মুগ্ধ করত। মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় বালক প্রফুল্লচন্দ্র বেড়াতে যেতেন শিক্ষক মোহনলালের সাথে। কপোতাক্ষ নদীতে জোয়ার ভাটা, নৌকাযাত্রীদের কলরব, নৌকায় মাঝিদের ভাটিয়ালি গান বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে মাতিয়ে তুলত। তাদের বাড়ির কাছেই ছিল শাল-সেগুন-আম-জাম-কাঁঠালের এক বিশাল বাগান এবং বাগান থেকে অল্প দূরেই এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলে দেখা মিলত বনবিড়াল, খরগোস, শিয়াল, গোসাপ এবং নানা বিষধর সাপ। এই জঙ্গলের গম্ভীরসুন্দর রূপ বালক প্রফুল্লচন্দ্রকে খুবই আকর্ষণ করত। সেজন্য প্রফুল্লচন্দ্র বাড়ীর কাউকে কিছু না বলে বন্ধু সতীশের সাথে প্রায়ই ছুটে যেতেন সেই জঙ্গল দর্শনে। একদিন বালক প্রফুল্লচন্দ্র ও তার বন্ধু ওই জঙ্গলে ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়েছিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের এক দুপুরবেলায় জাম খাবার ইচ্ছায় দুই বন্ধু জঙ্গলে হাজির। সতীশ জাম গাছে উঠে পাকা জাম সহ ছোটো ছোটো ডালগুলি ভেঙে নিচে ফেলছেন বন্ধু প্রফুল্লচন্দ্রর কাছে, আর প্রফুল্লচন্দ্র সেই ডাল থেকে জামগুলি পেড়ে রাখছেন। এমন সময় হঠাৎ গাছের উপর থেকে সতীশ লক্ষ্য করল যে কয়েকটা বুনো দাঁতাল শুয়োর ওই জামগাছের দিকে আসছে। সতীশ সেই দৃশ্য দেখে তাড়িতাড়ি তার পরনের ধুতিটা খুলে এক প্রান্ত ডালে বেঁধে দিল আর এক প্রান্ত প্রফুল্লচন্দ্রর কাছে নামিয়ে দিল যাতে প্রফুল্লচন্দ্র ওই ধুতিটা ধরে গাছের ডালে উঠতে পারে। তারপর গাছে উঠে দুজনে প্রাণপণে চিৎকার
0 Comments