যজ্ঞ-যুধিষ্ঠির সংবাদ
মহাভারতের বনপর্বের প্রায় অন্তিমে যক্ষরূপী ধর্মরাজের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের যে কথোপকথন হয়েছিল তাকে অনেকে 'যক্ষ প্রশ্ন রূপে আখ্যা দিয়েছেন। লক্ষণীর হলো যে, এই প্রশ্নোত্তর পর্বের সঙ্গে গ্রিক সাহিত্যে ওয়াদিপাউস স্ফিংস-এর ধাঁধা পার্কের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্ফিংস-এর ধাঁধার সঠিক উত্তর দিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী ওয়াদিপাউস তাঁর পিতাকে বধ করেছিলেন। শেষে নিজের মা'কে বিবাহ করেছিলেন। এবং আলোচ্য গল্পে যক্ষরূপী ধর্মরাজের সকল প্রশ্নের সঠিক উত্ত নিয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর চার ভাই-এর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এবার আলোচনা করা যাক মূল
পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসকালের অন্তিম পর্বে তাঁরা তখন দ্বৈতবনে মার্কাণ্ডের মুনির আশ্রমের কাছাকাছি একটি কুটিরে বসবাস করছিলেন। সেই বনে এক ব্রাহ্মণের আরনিস নামের একটি যখন কাঠ একটি গাছে বাঁধা ছিল। একদিন একটি হরিণ হঠাৎ ঐ গাছে তার শরীর করতে করতে গাছে বাঁধা মানে কাঠটি তার শিং-এ আটকে ফেলে। হরিণটি বেশ অতিপুষ্ট ছিল। স্তন কাঠটি নিয়ে লাকাতে লাকাতে অন্য একটি আশ্রামে চলে যায়। ব্রহ্মা যখন বিরটি জানতে পারলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটি উদ্ধারের জন্য পান্ডবদের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। বিপ্লবারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে পান্ডবেরা তখন সেটি উদারের জন্য জোর চেষ্টা চালাতে শুরু করলেন। এক সম হরিণটিকে দেখাতে পেরে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন দূর থেকে একটি তির নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু হরিণটি তখনই অদৃশ্য হয়ে যায়। এইভাবে হরিণটি খুঁজতে খুঁজতে পাণ্ডবেরা এস ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা নকুলকে বললেন, উঁচু কোনো গাছে চড়ে দেবো ভাই, পাশাপাশি কোনো জলাশয় আছে কি-না ? এরপর একটি জলাশারের খোঁজ পাওয়া গেলে সহদেব নকুল, অর্জুন এবং ভীম একে একে ঐ জলাশয়ে ভাল খেতে তোলেন। যখন একে একে পাণ্ডবেরা জল খেতে যাচ্ছেন, সেখানে উপস্থিত ধর্ম তাদের বলেছিলেন যে, ঐ জলাশয় তাঁর তত্ত্বাবধানে আছে।
তিনি তাঁদের জল পান করার সুযোগ তখনই দেবেন যদি তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর করা প্রশ্নগুলির উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারেন। আর উত্তর সঠিক না হলে তিনি তখনই তাঁদের মেরে ফেলবেন।
বলাবাহুল্য, চার পাণ্ডব ভ্রাতারা কেউই ধর্মরাজের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারেন নি। তাই তাঁরা তৎক্ষণাৎ মারা গিরেছিলেন। ভাইরের দীর্ঘক্ষণ কিরে আসছে না দেখে, সবশেষে, বুধিষ্ঠির গিয়েছিলেন জলাশয়টিতে, ভাইদের সন্ধানে। তাঁকে দেখে দৈববাণী ঘোষিত হলো- “আমি এক বক, আমিই তোমার ভাইদের মেরেছি। তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারো তাহলে তোমার দশাও এনের মতোই হবে। তাই তুমি সাহস করো না পুত্র, আমার একটি নিয়ম আছে। আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে, তারপর জলাশয়ে নেমে ভাল পান করবে।
রাজা যুধিষ্ঠির তখন মনে মনে চিন্তা করলেন, এমন ভাষণ দান কোন পাখির কাজ নর। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে আপনি? আপনি কি ? , ন মারহ ? দয়া করে আপনার পরিচয় দিন।”
যজ্ঞ বললেন- “আমি কোন পাখি নাই। আমিই তোমার পরাক্রমী ভাইদের হত্যা করেছি। আমি যজ্ঞ। তোমার মঙ্গল হোক
যক্ষের এমন অপ্রীতিকর কথা শুনে যুধিষ্টির সামান্য এগিয়ে গিয়ে দেখালেন একটি গাছের উপর তেজী, বিশালাকার বিকট চক্ষুবিশিষ্ট এক বক্ষ শুয়ে আছেন।
যুধিষ্ঠিরকে দেখে বক্ষ বললেন- “হে রাজন। তোমার ভাইদের আমি বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার বারণ শোনে নি। তাই আমি তাদের মেরে ফেলেছি। আর তোমার প্রাণ যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে এই জলাশয়ের জল পান করো না। এই স্থানটি আমার অধিকারে আছে। আমার নিয়ম হলো আগে প্রশ্নের উত্তর দাও। তারপর জল পান কর।*
যুধিষ্ঠির বললেন- “আপনার অধিকারের কোনো জিনিস নেওয়ার ইচ্ছা আমার বিন্দুমাত্র নেই। আপনি আপনার প্রশ্ন করুন। কোন বুদ্ধিমান মানুষ কখনো নিজের প্রশংসা করেন না।”
যক্ষ প্রশ্ন করলেন— “কে সূর্যকে উদিত করেন ? সূর্যের চারপাশে কারা থাকেন ? কে-বা তাঁকে অস্তমিত করেন ? তিনি কোথায় প্রতিষ্ঠিত ?"
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ব্রহ্মদেব সূর্যকে উদিত করেন। তাঁর চারপাশে দেবতারা থাকেন। ধর্ম সূর্যকে অস্তমিত করেন। এবং সূর্যদেব সত্যে প্রতিষ্ঠিত।”
যক্ষ বললেন— “মানুষ কিসের দ্বারা শ্রোত্রিয় হন ? মহত্ত্ব লাভ কার দ্বারা করা যায় ? কিসের সাহায্যে ব্রহ্মপদ লাভ হয় ? এবং কিভাবে বুদ্ধিমান হয় ?”
যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন— “মানুষ শ্রুতির দ্বারা শ্রোত্রিয় (বেদাধ্যেতা) হয় এবং তপস্যার দ্বারা মহত্ব লাভ করেন। ধৃতির দ্বারা মানুষ ব্রহ্মরূপ প্রাপ্ত হন এবং বৃদ্ধদের সেবা দানের মাধ্যমে মানুষ বুদ্ধিমান হয়।”
যক্ষ বললেন— “ব্রাহ্মণদের দেবত্ব কী ? কোনটি তাঁদের সাধুধর্ম ? কোনটি তাঁদের মনুষ্যভাব ? এবং তাঁদের অসাধু ভাব কোনটি ?”
যুধিষ্ঠির বললেন- “বেদপাঠের দ্বারা ব্রাহ্মণদের দেবত্বভাব আসে। তপস্যা হলো তাদের সাধু ধর্ম, মৃত্যু হলো তাদের মনুষ্য ভাব এবং নিন্দা করা হলো অসাধু ব্যক্তির আচরণ।”
যক্ষের প্রশ্ন— “ক্ষত্রিয়গণের দেবভাব, সাধুভাব, মনুষ্যভাব এবং অসাধুভাব, এগুলি কি ? ”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর- “অস্ত্রশিক্ষার দ্বারা ক্ষত্রিয়দের দেবত্বভাব তৈরি হয়। যজ্ঞ সম্পাদনের দ্বারা সাধুভাব, ভয় হলো তাদের মনুষ্য ভাব; এবং দীন-দুঃখীকে রক্ষা না করলে ক্ষত্রিয়গণের অসৎ আচরণ প্রকটিত হয় ।”
যক্ষের প্রশ্ন— “যজ্ঞীয় সাম কি ? যজ্ঞীয় যজুঃ কি ? কে যজ্ঞ বরণ করেন এবং কাকে যজ্ঞ অতিক্রম করে না।”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “প্রাণ হলো যজ্ঞীয় সাম । মন হলো যজ্ঞীয় যজুঃ। ঋক যজ্ঞকে বরণ করে, এবং যজ্ঞ তাকে অতিক্রম করতে পারে না।”
যক্ষ বললেন— “দেব তর্পণকারীদের কোন বস্তু শ্রেষ্ঠ ? পিতৃ পরুষদের তর্পণকারীদের জন্য কোন্ বস্তু শ্রেষ্ঠ ? প্রতিষ্ঠা যারা চায় তাদের কাছে কোন বস্তু শ্রেষ্ঠ ? সন্তান আকাঙ্ক্ষাকারীদের নিকট শ্রেষ্ঠ কী ? ”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “দেবতর্পণকারীদের জন্য বর্ষা শ্রেষ্ঠ, পিতৃতর্পণকারীদের জন্য ধন-ধান্য-সম্পত্তি শ্রেষ্ঠ, প্রতিষ্ঠা যারা চায় তাদের কাছে গোধন শ্রেষ্ঠ এবং সন্তান যারা চায় তাদের কাছে পুত্র সন্তান শ্রেষ্ঠ।”
যক্ষ প্রশ্ন করলেন— “এমন কোন্ ব্যক্তি আছে যিনি ইন্দ্রিয়ের বিষয় অনুভব করেন, শ্বাস গ্রহণ করেন, বুদ্ধিমান, সম্মানিত এবং সকল প্রাণীর কাছে সম্মানীয় হয়েও জীবিত নন ?”
যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন— “যে ব্যক্তি, দেবতা, অতিথি, সেবক, মাতা-পিতা ও আত্মা— এই পাঁচকে পোষণ করেন না, তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমর্থ হলেও জীবিত নন।"
যক্ষ প্রশ্ন করলেন— “পৃথিবী অপেক্ষা ভারী কি ? আকাশ অপেক্ষা উঁচু কে ? বায়ু অপেক্ষা দ্রুতগামী কে ? কার সংখ্যা তৃণের চেয়েও বেশি ?”
যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন— “পৃথিবীর চেয়েও অধিক ভারী হলেন ‘মা’। আকাশের চেয়েও পিতার অবস্থান ঊর্ধে। মন বায়ুর চেয়েও বেগবান এবং চিন্তার সংখ্যা তৃণের চেয়েও বেশি।”
যক্ষ প্রশ্ন করলেন— “কে ঘুমোলে তার পলক পড়ে না। জন্মগ্রহণ করেও স্পন্দিত নয় কে ? কে হৃদয়হীন হয় ? এবং কে বেগের সাহায্যে বর্ধিত হয় ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “মাছ ঘুমালেও তার পলক পড়ে না। ডিম উৎপন্ন হয়েও স্পন্দনহীন থাকে । পাথরের হৃদয় থাকে না। নদী সবেগে বৃদ্ধি পায়, প্রবাহিত হয়।”
যক্ষের প্রশ্ন— “প্রবাসীর বন্ধু কে ? গৃহে বসবাসকারীর মিত্র কে ? রোগীর মিত্র কে ? মুমূর্ষু ব্যক্তির মিত্র কে ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “সহযাত্রী হলেন প্রবাসী ব্যক্তির বন্ধু। গৃহীর বন্ধু তাঁর স্ত্রী। বৈদ্য হলেন রোগীর মিত্র এবং মুমূর্ষু ব্যক্তির একমাত্র মিত্র হলো দান।”
যক্ষ জিজ্ঞাসা করলেন— “সকল প্রাণীর অতিথি কে ? সনাতন ধর্ম কী ? অমৃত কী ? এবং এই সমস্ত জগৎ কী ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “অগ্নি সমস্ত প্রাণীর অতিথি । অবিনাশী জ্ঞানযোগ হলো সনাতন ধর্ম । জল এবং যজ্ঞশেষ হলো অমৃত এবং বায়ু হলো জগৎ সমুদায়।”
যক্ষের প্রশ্ন— “কে একা একা বিচরণ করতে পারে ? কে বারবার জন্মগ্রহণ করে ? শীতের প্রতিকার কিসে হয় ? মহান ক্ষেত্র কোনটি ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “সূর্য একাকী বিচরণ করেন। চন্দ্র বারবার জন্ম নেন। শীতের উপশম অগ্নির দ্বারা হয় । পৃথিবী হলো মহান ক্ষেত্র।”
যক্ষের প্রশ্ন— “ধর্মের একমাত্র আশ্রয় কোনটি ? যশের প্রধান আশ্রয় কোনটি ? স্বর্গের প্রধান স্থান কোনটি ? এবং সুখের একমাত্র আশ্রয় কোনটি ?” যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ধর্মের একমাত্র আশ্রয় হলো দাক্ষ্য বা দক্ষতা, দান যশের, সত্য স্বর্গের এবং শীল হলো সুখের প্রধান বা একমাত্র আশ্রয়।”যক্ষের প্রশ্ন— “মানুষের আত্মা কে ? দৈবকৃত সখা কে ? উপজীবিকা কি ? এবং প্রধান আশ্রয় কি ?"
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “পুত্র হলো মানুষের আত্মা । স্ত্রী হল তার দৈবকৃত সখা, মেঘ তার জীবনের সহায়ক এবং দান হলো মানুষের প্রধান আশ্রয়। ”
যক্ষের প্রশ্ন— “যিনি ধন্যবাদের পাত্র তাঁর উত্তম গুণ কোনটি ? ধনের মধ্যে উত্তম কোনটি ? লাভের মধ্যে উত্তম কোনটি ? এবং সুখের মধ্যে উত্তম কি ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ধন্যবাদের যোগ্য ব্যক্তিদের উত্তম গুণ হলো তাঁর দক্ষতা। ধর্মের মধ্যে শাস্ত্রজ্ঞান সর্বশ্রেষ্ঠ। লাভের মধ্যে আরোগ্যময় জীবন এবং মানসিক সন্তোষই হলো উত্তম সুখ।”
যক্ষের প্রশ্ন- “প্রধান ধর্ম কোনটি ? কোন ধর্ম সর্বদা ফলবান ? কাকে সংযত করলে শোক থাকে না ? কার সঙ্গে সন্ধি করলে সে সন্ধি ভঙ্গ হয় না ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ইহলোকে দয়া হলো শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বৈদিক ধর্ম সবসময় ফলবান। মনকে সংযত রাখলে শোক বিমুক্ত হয় এবং সাধুর সঙ্গে সন্ধি করলে সে সন্ধি ভঙ্গ হয় না।”
যক্ষের প্রশ্ন— “কি ত্যাগ করলে প্রিয় হয় ? কি ত্যাগ করলে শোক দূরীভূত হয় ? কি ত্যাগ করলে অর্থবান হওয়া যায় ? কি ত্যাগ করলে সুখী হয় ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “অভিমান ত্যাগ করলে প্রিয় হয়। ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক দূরীভূত হয়। কামনা ত্যাগ করলে অর্থবান এবং লোভ ত্যাগ করলে মানুষ সুখী হয়।” যক্ষের প্রশ্ন- “ব্রাহ্মণ, নট ও নর্তক, ভৃত্য ও রাজা— এঁদের দান করার প্রয়োজন কোথায় ?"
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ধর্মের নিমিত্ত ব্রাহ্মণকে; পুরস্কার হিসাবে নট ও নর্তকীকে; বেতন বা ভরণ পোষণের নিমিত্ত ভৃত্যকে; এবং রাজাকে কর এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশার দান প্রদান করা হয়।”
বক্ষের প্রশ্ন- “জগৎ কোন বস্তু দ্বারা আচ্ছাদিত ? কীসের জন্য এটি প্রকাশিত হয় না ? মানুষ কি কারণে মিত্রকে ত্যাগ করে ? এবং কোন্ কোন্ কারণে স্বর্গে গমন
করা যায় না ?"
বুধিষ্ঠিরের উত্তর- “মানুষ অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছাদিত। তমোগুণের কারণে তা অপ্রকাশিত থাকে। লোভের ফাঁদে পড়ে মানুষ মিত্রকে ত্যাগ করে, এবং আসক্তির
জন্য স্বর্গে গমন করা যায় না। ”
যক্ষের প্রশ্ন— “পুরুষকে কোন অবস্থায় মৃত বলা হয় ? কোন্ অবস্থায় রাষ্ট্রকে মৃত বলা হয় ? শ্রাদ্ধ কী করে মৃত হয় ? এবং মৃত যজ্ঞই বা কী ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “দরিদ্র ব্যক্তি মড়ার মতন বা জীবস্মৃত। রাজা-বিহীন রাষ্ট্রকে অরাজক বা মৃত রাজ্য বলে। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ব্যতীত শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হলে তা মৃত শ্রাদ্ধ এবং বিনা দক্ষিণায় সম্পন্ন যজ্ঞকে মৃত-যজ্ঞ বলা হয়।”
যক্ষের প্রশ্ন— “দিক (দিশা) কী ? জল কী ? অন্ন কী ? এবং বিষ কী বস্তু ? শ্রাদ্ধের কাল-ই বা কী ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর- “সৎ ব্যক্তিই হলেন দিশা। কারণ তিনি ভগবৎ প্রাপ্তির পথ দেখাতে পারেন। আকাশ হলো জল, গাভী হলো অন্নের কারণ (গাভী থেকে দুধ-ঘি অর্থাৎ হব্য, হব্য দ্বারা যজ্ঞ, যজ্ঞ থেকে বর্ষা এবং বর্ষা থেকে অন্ন উৎপন্ন হয়)। কামনা বিষ-সদৃশ এবং উপযুক্ত ব্রাহ্মণ প্রাপ্তির দ্বারা শ্রাদ্ধের সময় সূচিত হয়।”
যক্ষ প্রশ্ন করলেন- “ক্ষমা কী ? লজ্জা কাকে বলে ? তপের লক্ষণ কী ? দম কাকে বলে ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “দ্বন্দ্ব সহ্য করার শক্তিই হলো ক্ষমা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজ না করার ইচ্ছা হলো লজ্জা। নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখে সৎভাবে জীবনযাপন করাই হলো তপ বা তপস্যা এবং মনকে বশীভূত রাখাই হলো দম।”
যক্ষের প্রশ্ন- “জ্ঞান, শম, দয়া ও আর্জ্জব কাকে বলে ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “প্রকৃতভাবে কোন বস্তু বা বিষয়কে সম্যক উপলব্ধি করা হলো জ্ঞান, মনের শান্তিভাবকে বলে শম বা প্রশান্তি, সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করাকে বলে দয়া এবং সমচিত্ত ভাবকে বলে আর্জ্জব বা সরলতা।”
যক্ষের প্রশ্ন— “মনের কোন্ শক্তি দুর্জয় ? কোন্ ব্যাধি অনন্ত ? সাধু বলে কাকে গণ্য করা হয় ? এবং অসাধু কাকে বলে ?"
যুধিষ্ঠিরের উত্তর– “ক্রোধ হলো মানুষের মনের দুর্জয় শক্তি । অনন্ত ব্যাধি হলো লোভ, যে সকল প্রাণীর হিত কামনা করে সে সাধু এবং দয়াহীন নির্দয় ব্যক্তিকে অসাধু
বলে।”
যক্ষের প্রশ্ন— “মোহ, মান, আলস্য ও শোকের লক্ষণ কী ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞান বা অজ্ঞতাকে বলে মোহ। আত্মাভিমান হলো মান। ধর্মানুষ্ঠানে উৎসাহ না থাকাই হলো আলস্য এবং শোকের লক্ষণ হলো
অজ্ঞান।”
যক্ষের প্রশ্ন— “ঋষিগণের বিচারে স্থৈর্য, ধৈর্য, স্নান ও দানের লক্ষণ কী ?” যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “নিজের ধর্মের প্রতি অবিচল থাকাই হলো স্থৈর্য, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ বা নিয়ন্ত্রণকে বলে ধৈর্য, মনোমালিন্য ত্যাগ করাকে বলে স্নান এবং প্রাণীগণকে রক্ষা করার লক্ষ্যে করণীয় যে কোন কিছুকে ঋষিদের বিচারে দান বলে।”
যক্ষের প্রশ্ন— “পণ্ডিত কে ? নাস্তিক কে ? মূৰ্খ কে ? কাম কি ? এবং মৎসর-ই বা কী ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলা হয়। মুর্খ ব্যক্তিকে নাস্তিক বা নাস্তিক ব্যক্তিকে মূর্খ বলে। জন্ম-মৃত্যু চক্রে বাসনার প্রকাশই হলো কাম। এবং হৃদয়ের অনুতাপকে মৎসর বলে।”
যক্ষের প্রশ্ন- “অহংকার কী ? দত্ত কাকে বলে ? পরমদৈব কাকে বলে ? পৈশুন্য কার নাম "
যুধিষ্ঠিরের উত্তর- “প্রবল অজ্ঞতাই হলো অহংকার, নিজেকে বড় ধর্মাত্মা বলে প্রকাশ করাই হলো দত্ত। দানের ফলকে বলে পরমদৈব এবং অপরের দোষ অন্য কাউকে বলাকে বা বলার প্রচেষ্টাকে বলে পৈশুন্য।”
যক্ষের প্রশ্ন- “ধর্ম, অর্থ এবং কাম— এগুলি পরস্পর বিরোধী। কিভাবে এগুলির একত্রে সমাবেশ হয় ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর- “যখন ধর্মাচরণ এবং স্ত্রীর তাতে অনুমোদন একসঙ্গে এক সুরে সম্পাদিত হয় (অর্থাৎ পত্নী কামসাধনেও যেমন সহযোগী হবেন, তেমনি অগ্নিহোত্রাতেও তাঁর অনুমোদন থাকবে) তখনই এই তিন বিষয়ের সমাবেশ সম্ভব।”
যক্ষের প্রশ্ন- “অক্ষয় নরক কোন ব্যক্তি লাভ করেন ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “যে ব্যক্তি কোনো গরীব ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণকে মন থেকে বা ডেকে কোন ভিক্ষা দেয় না, তার অক্ষয় নরক প্রাপ্তি হয়। যে ব্যক্তি বেদ, ধর্মশাস্ত্র, ব্রাহ্মণ, দেবতা এবং পিতৃধর্মে অবিশ্বাসী হয় তার নরক প্রাপ্তি হয়। যে ব্যক্তির ধনসম্পদ আছে, তা সত্ত্বেও তার দান ও ভোগ করার ইচ্ছা না থাকলে তারও নরক লাভ হয়।”
যক্ষ বললেন- “রাজন! কূল, আচার, স্বাধ্যার এবং শাস্ত্র প্রবণ এগুলির মধ্যে কার সাহায্যে ব্রাহ্মণত সিদ্ধ হয় ?”
যুধিষ্ঠির বললেন- “প্রিয় যক্ষ। কুল, ধ্যায় এবং শ্রুতি বা শাস্ত্র শ্রবণ- এগুলির কোনটিই ব্রাহ্মণত্বের কারণ নয়। কেবলমাত্র আচার ও আচরণই ব্রাহ্মণত্বের কারণ। তাই ব্রাহ্মণদের সদাচারী হওয়া অবশ্য কর্তব্য। সদাচারী ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব অক্ষয় থাকে। সদাচার বিনষ্ট হলে ব্রাহ্মণতের বিনাশ হয়। শাস্ত্র পাঠ করা, শাস্ত্র বিচার করা বা শাস্ত্রজ্ঞান শেখানো— এগুলি ব্রাহ্মণত্বের লক্ষণ হিসাবে যথেষ্ট নয়। চতুর্বেদ অধ্যয়ন করার পরও যদি কেউ দুষ্ট আচরণ করে, তার গুদের চেয়েও অধম গতি হয়। অন্যদিকে যিনি অগ্নিহোত্রে তৎপর এবং যথার্থই জিতেন্দ্রিয়, তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ।”
যক্ষের প্রশ্ন- “মধুর বাক্য বললে সুফল কী ? যারা ভেবে চিন্তে কাজ করে তারা কী পায় ? যে অনেক বন্ধু তৈরি করে, তার কী লাভ হয় ? যে ব্যক্তি ধর্মনিষ্ঠ, সে ক পায় ?”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “যিনি মধুর বাক্য বলেন, তিনি সকলের প্রিয় হন। যারা ভেবে-চিন্তে কাজ করেন, তাঁরা সফলকাম হন। যে অনেক বন্ধু তৈরি করে, সে সুখে দিন কাটায়। যে ব্যক্তি ধর্মনিষ্ঠ, তিনি সদগতি লাভ করেন। **
যক্ষের প্রশ্ন— “সুখী কে? আশ্চর্য কী ? পথ কী এবং বার্তা-ই বা কী ?- এই চারটি প্রশ্নের উত্তর দিলে, তোমার ভাইয়েরা জীবিত হবে।”
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “যিনি অঋণী হয়ে নিজের গৃহে থেকে দিনের পঞ্চম বা ষষ্ঠভাগে শাকান্ন খেয়ে তৃপ্ত থাকেন— তিনিই সুখী। প্রাণী-সকল প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। তা দেখেও অন্য সকল প্রাণী বাঁচার আশায় বেঁচে আছে এটিই জগতের সবচেয়ে আশ্বর্য বিষয়। তর্কের কোনো শেষ নেই। শ্রুতিও ভিন্ন ভিন্ন হয়। ধর্মের তত্ত্ব এতটাই গুঢ় যে, তা সর্বসাধারণের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়, আর ঋষিবচনকে সবসময় শিরোধার্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। তাই মহাজন বা মহাপুরুষরা যে পথে গমন করেছেন সেই পথই হলো শ্রেষ্ঠ পথ। আবার কাল-সূর্যরূপ অগ্নিতে, রাত্রি ও দিন রূপ ইন্ধন সহযোগে, মাস ও ঋতু-রূপ হাতা দিয়ে, মহামোহরূপ কড়াইতে ভগবান প্রতিনিয়ত যে রান্না করছেন- তাই হলো বার্তা।”
যক্ষ বললেন- “হে রাজন! তুমি আমার সব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়েছো। এবার বলো পুরুষ কে ? এবং সবার চেয়ে ধনী কে?"
যুধিষ্ঠিরের উত্তর— “যাঁর পুণ্যকর্মের খ্যাতি সমগ্র ভূমণ্ডল সহ স্বর্গলোকে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম যতদিন মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকবে ততদিন সেই পুণ্যাত্মা পুরুষ হিসাবে পরিগণিত হবেন। আবার যে ব্যক্তি অতীত বা ভবিষ্যতের সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, প্রিয়-অপ্রিয় সমান জ্ঞানে বিচার করেন তিনি সব চেয়ে ধনী।”
যক্ষ বললেন— “তুমি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির ব্যাখ্যা ঠিক ঠাক দিয়েছো। তুমি তোমার ভাইদের মধ্যে যে কোনো একজনকে চেয়ে নাও। সে জীবিত হয়ে যাবে।”
যুধিষ্ঠির বললেন- “যক্ষদেব! শ্যামবর্ণ, অরুণ নয়ন, শালগাছের ন্যায় দীর্ঘদেহী, সুবিশাল বক্ষ যার সেই মহাবাহু নকুলকে আপনি জীবিত করে দিন।”
যক্ষ বললেন— “রাজন! যার গায়ে দশ হাজার হাতির সমান বল, সেই ভীমকে বাদ দিয়ে তুমি আগে নকুলকে কেন বাঁচাতে চাও ? অথবা যার বাহুবলের উপর পাণ্ডবেরা সবচেয়ে বেশি ভরসা করে, সেই অর্জুনকেই বা কেন বাঁচিয়ে তুললে না ?”
যুধিষ্ঠির বললেন- “আমি যদি ধর্মের ধারক ও বাহক হই তাহলে ধর্ম ও আমাকে রক্ষা করবেন। তাই আমি ধর্মকে কখনোই ছাড়তে পারব না। আমার বিশ্বাস ধর্মও আমাকে কখনো ত্যাগ করবে না। আমার বিচার হলো সবার প্রতি সমান ভাব রাখা । এই হলো পরম ধর্ম। লোকে জানে রাজা যুধিষ্ঠির ধর্মপ্রাণ। আমার দুই মাতা— কুন্তী এবং মাদ্রী। দু'জনের মধ্যে আমার চোখে কোনো বিভেদ নেই। তাই কুন্তী পুত্র হিসাবে আমি যেমন জীবিত আছি তেমনি মাদ্রী নন্দন নকুলও প্রাণ ফিরে পাক। এই জন্যেই আমি নকুলের প্রাণ আগে চেয়েছি।”
যক্ষ বললেন— “ভরতশ্রেষ্ঠ। তুমি অর্থ ও কর্মকুশলতাকে বাদ দিয়ে সমত্বকে বেশি মর্যাদা দিয়েছো, তা আমাকে অনেক খুশি করেছে। আমি তাই তোমার সকল ভাইদের প্রাণ ফিরিয়ে দিলাম। তারা সকলে জীবিত হোক।”
যক্ষের ঘোষণামাত্র চার পাণ্ডুপুত্র তখনই উঠে দাঁড়ালেন। তাঁদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবই দূর হয়ে গেল।
যক্ষ-যুধিষ্ঠির কথোপকথন এভাবে আমাদের এক শাশ্বত জ্ঞান ভাণ্ডারের হদিশ দেয় যা, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অহংকার। সত্য ও ত্যাগের ভূমি হলো ভারতবর্ষ। তারই সামান্য কিছু দ্যুতি এই কথোপকথনে ফুটে উঠেছে।
0 Comments