শিবি রাজার উপাখ্যান
পাণ্ডবেরা মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে বললেন- “ভগবান! আপনি ব্রাহ্মণদের মহিমা নিয়ে অনেক গল্প শুনিয়েছেন। এবার রাজ-মাহাত্ম্য সম্পর্কে আমাদের জানতে ইচ্ছা করছে। দয়া করে আমাদের তা শোনান।”মার্কণ্ডেয় বললেন- “উশীনর পুত্র সুহোত্র নামে একজন কুরুবংশীয় রাজা ছিলেন। তিনি একদিন মহর্ষিদের সৎসঙ্গ পেতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার সময় পথে উশীনর পুত্র দেখলেন রাজা শিবি রথে চড়ে উল্টোদিক থেকে আসছেন। দুজনেই রাজা। দুজনেই মনে করেন যে, তিনিই শ্রেষ্ঠ। তাই কেউ কাউকে যাওয়ার পথ করে দেননি। বরং প্রত্যেকে নিজের নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এমন সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে হাজির হলেন। ঐ অবস্থায় দেবর্ষি জানতে চাইলেন কেন তাঁরা তর্কবিতর্ক করছেন? কেন-বা তাঁরা পথে দাঁড়িয়ে আছেন ?
তাঁরা বললেন- “মুনিবর! আমরা কোন বিবাদ বা ঝগড়া-ঝাঁটি করছি না। আমরা বুঝে উঠতে পারছি না কে, কাকে, আগে পথ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন। শাস্ত্রে বলে যোগ্য ব্যক্তিকে আগে পথ ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমাদের মধ্যে কে যোগ্যতর আমরা তার মীমাংসা করতে পারছি না। আমাদের রূপ, গুণ, এমনকি বয়স প্রায় সমান। এবার আপনি বলুন আমাদের দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ? কার, কাকে আগে পথ ছেড়ে দেওয়া উচিত ?”
তখন নারদ মুনি তাদের তিনটি শ্লোক শোনালেন যার মর্মার্থ হলো- কি ক্রুর, কি কোমল প্রকৃতির বা কি সাধু ব্যক্তি প্রত্যেকেরই প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক হতে পারে। তাই সভাব বা সৌহার্দ রক্ষা কোনা তুলনার মাপকাঠি হতে পারে না। যিনি দেবার্চনায় যত্নশীল, যিনি দান দ্বারা অসৎ কর্ম থেকে মুক্ত হন, ক্ষমা দ্বারা শঠ ব্যক্তিকে পরাজিত করেন সত্য দ্বার অসত্যকে এবং উত্তম ব্যবহার দিয়ে অসাধু ব্যক্তিকে পরাজিত করেন- তিনিই শ্রেষ্ঠ। তাই তোমাদের মধ্যে যে বেশি উদার তিনি আগে পথ ছেড়ে দাও। আমার বিচারে তোমরা দুজনেই উদার স্বভাব। তবে রাজা শিবি উশীনরের চেয়ে সামান্য হলেও এগিয়ে। তাই রাজা সুহোত্র শিবিকে পথ ছেড়ে দাও।”
রাজা শিবির মহত্ব পরীক্ষার জন্য দেবতারা একবার একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উপলক্ষে দেবরাজ ইন্দ্র ও অগ্নিদেব পৃথিবীতে এলেন। অগ্নিদেব একটি পায়রার রূপ ধরে রাজা শিবির কাছে এলে দেবরাজ ইন্দ্র বাজ পাখির রূপ ধারণ করে তার পেছনে পেছনে ধাওয়া করলেন। রাজা শিবি তখন সিংহাসনে বসেছিলেন। এমন সময় হঠাৎ ভয়ার্ত একটি পায়রা রাজার কোলে এসে বসে পড়লো। তখন রাজ পুরোহিত বললেন- “মহারাজ! পায়রাটি বাজপাখির তাড়া খেয়ে প্রাণ ভয়ে আপনার কোলে এসে বসেছে। কিংবদন্তী অনুসারে পায়রা শরীরের কোনো অঙ্গে বসলে অনিষ্ট হয়। আপনি রাজা। তাই ব্রাহ্মণকে কিছু অর্থ দান করে এই বিপত্তি থেকে মুক্ত হোন।”
তখন পায়রাটি বলল- “মহারাজ! আমাকে সত্যি সত্যি পায়রা ভাববেন না। আমি একজন ব্রহ্মচারী, নিষ্পাপ, তপস্বী। আমি কখনো আমার আচার্যের প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করিনি। আমি তন্ময় হয়ে প্রতিদিন বেদ পাঠ করি। এখন এই বাজ পাখিটির হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনার কোলে এসে বসেছি। আমাকে বাঁচান। বাজ পাখির হাতে আমাকে তুলে দেবেন না।
বাজ পাখি বলল- “মহারাজ! জগতে জন্মগ্রহণ বিষয়ে, অদ্ভূত বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব জন্মে যাদের আপনি পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র বা কন্যা বলে এসেছেন; পরজন্মে তাঁরাই আবার কন্যা, পুত্র, স্ত্রী, মাতা বা পিতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। শত্রু মিত্ররূপে আবার মিত্র শত্রুরূপে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। তাই আমার মনে হচ্ছে গত জন্মে এই কপোত আপনার জন্মদাতা ছিল। তাই আপনি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তবে সে যাই হোক, এখন আপনি আমার খাদ্য সংগ্রহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।”
রাজা শিবি বললেন- “পাখিরা এমন উৎকৃষ্ট সংস্কৃত ভাষায় কথা বলছে, এমন ঘটনা কেউ কি কোন দিন দেখেছে ? তাই আমার ভয় হচ্ছে এদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝে এদের প্রতি ন্যায় বিচার দিতে পারব কি না ?”
আমি জানি, যিনি ভয়ার্ত ও শরণাগতকে শত্রুর হাতে তুলে দেন, তার রাজ্যে বৃষ্টি হয় না। বীজ বপন করলে তা অঙ্কুরিত হয় না। সঙ্কটকালে কেউ তাকে রক্ষা করে না। তার সন্তানদের অকাল মৃত্যু হয়। পিতৃপুরুষের সদ্গতি হয় না। দেবতারা তাঁর পূজা গ্রহণ করেন না। সেই ব্যক্তির আক্ষরিক অর্থে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাঁর ভাগ্যে স্বর্গ লাভ জোটে না। ইন্দ্রাদি দেবগণ তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। তাই প্রাণ থাকতে থাকতে আমি এই অসহায় পায়রাটিকে কোন মতে তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না। আমি তোমাকে কপোতের পরিবর্তে অন্নের সঙ্গে মাংস রান্না করে দিচ্ছি। তুমি এখন যেখানে যেতে চাও, যাও। আমার শিবিরা তোমার জন্য সেখানেই অন্ন মাংসাদি দিয়ে আসবে।”
বাজপাখি বলল- “মহারাজ! আমি পায়রা ছাড়া অন্য কোন মাংস চাই না। ঈশ্বরের কৃপায় আমার ভাগ্যে এই পাখিটি জুটেছে। তাই এটিকেই ভোজন করতে চাইছি। আপনি বাধা দিয়ে দাঁড়াবেন না।”
রাজা বললেন- “হে শ্যেন! কপোত প্রাণ ভয়ে আমার আশ্রয় নিয়েছে। তার জন্য আমি আমার প্রাণ পর্যন্ত দিতে তৈরি আছি। কিন্তু পায়রাটিকে আমি তোমার হাতে দিতে পারব না। বরং আমার কাছে এমন কিছু চাও, যা দিলে আমি আমার পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ পেতে পারি।”
বাজপাখি বলল- “মহারাজ! আপনি যদি আপনার ডান জঙ্গা কেটে পায়রার সমান ওজনের মাংস খেতে দেন। তাহলেই আমি পায়রাটির মায়া ত্যাগ করতে পারি।” এরপর একটি ছুরি ও একটি তুলাদণ্ড আনা হলো। তুলাদণ্ডের একদিকে পায়রাটিকে রাখা হলো। অন্যদিকে রাজা স্বয়ং তাঁর বাম পা থেকে একটু একটু করে মাংস কেটে তুলাদণ্ডের অন্যদিকে রাখতে থাকলেন। কিন্তু পাল্লা সমান হচ্ছিল না। শিবির পা থেকে অবিরাম রক্ত ঝরছে। কিন্তু তখনও পায়রার দিকের পাল্লাটি ভারী দেখাচ্ছে। রাজা শিবি পুনারায় আরও এক টুকরো মাংস কেটে পাল্লায় রাখলেন। কিন্তু তাতেও পাল্লার দু'দিক সমান সমান হলো না। যন্ত্রণার চোটে শিবির চোখে তখন জল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক আগের মতোই অটুট আছে। দুই পাখি রাজা শিবির এই আচরণে হতবাক!
এরপর রাজা শিবি তাঁর ডান পায়ের মাংস কেটে তুলাদণ্ডে দিলেন। তখনও পায়রার ওজন মাংসের ওজনের তুলনায় বেশি দেখাচ্ছে। রাজা শিবি কিন্তু হার মানার পাত্র নন। এরপর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস কেটে কেটে তিনি পাল্লায় চাপাতে থাকলেন। শিবি রাজের সর্বাঙ্গ থেকে তখন রক্ত ঝরছে। পাল্লা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। পাল্লাতে তখনও পায়রার ওজন বেশি দেখাচ্ছে। শিবি রাজকে তখন কেমন যেন অসহায় দেখাচ্ছে। কারণ তাঁর শরীরে আর কোন স্থান থেকে মাংস কাটার জায়গা নেই। রাজা তখন ভাবছেন পায়রাটিকে বাঁচাবেন কি করে ? রাজা শেষে নিরুপায় হয়ে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন, তারপর উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে নিজেই পাল্লায় বসে পড়লেন।
রাজার এই অভূতপূর্ব এবং অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখে বাজপাখিটি হঠাৎ বলে উঠলো-“পায়রাটি রক্ষা পেয়েছে।” –এই বলে বাজ পাখি অদৃশ্য হয়ে গেল।
তখন রাজা শিবি কপোতটিকে বললেন- “হে পক্ষী! শিবিগণ সকলে তোমাকে কপোত বলেই জানেন। কিন্তু এখন আমার জানতে ইচ্ছা করছে, এই বাজপাখি আসলে কে ? আমার বিচারে ইনি নিশ্চয়ই কোনো অসামান্য পুরুষ ?”
কপোত তখন প্রত্যুত্তরে বলল- “মহারাজ! আমি ধূমকেতু অগ্নি আর ঐ বাজ পাখি হলেন শচীপতি ইন্দ্র । আমরা তোমার সাধু ব্যবহার ও মহত্ব পরীক্ষার জন্য এই উপায় অবলম্বন করেছি।
এমন সময় ইন্দ্রদেবও সেখানে উপস্থিত হলেন। বললেন- “অগ্নিদেব তোমার প্রচুর সুখ্যাতি করেন। এখন দেখছি তুমি তার চেয়েও অনেক বেশি উদার ও ধর্ম পরায়ণ। এই বলে দেবরাজ ইন্দ্র, শিবিকে স্পর্শ করলেন। রাজার দেহ আগের মতোই কন্দর্পকান্তি হয়ে উঠল।
এরপর অগ্নিদেব রাজা শিবিকে আশীর্বাদ করলেন এবং বললেন— “তোমার যশ ত্রিলোক-প্ৰসিদ্ধ হোক। যুগে যুগে তোমার উদারতা লোক মুখে অক্ষয় থাকুক।”
আসলে শিবি যে কতখানি মহান হৃদয়-সম্পন্ন নারদ মুনি তা নিয়ে আরও একটি কাহিনী একবার শুনিয়েছিলেন। একদিন এক ব্রাহ্মণ শিবিরাজের কাছে এসে অন্ন চাইলেন। বললেন, তিনি শিবির পুত্র বৃহদগর্ভের মাংস চান। এই বলে ব্রাহ্মণ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। শিবি তাঁর পুত্রকে বধ করে তার মাংস ও অন্ন প্রস্তুত করে ব্রাহ্মণকে খুঁজতে শুরু করলেন। হঠাৎ কে একজন খবর দিল, সেই ব্রাহ্মণ কোনো কারণে ক্রদ্ধ হয়ে শিবি রাজার বাড়ি, কোষাকার, অশ্বশালা ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়েছেন। শিবি তা শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত সেই বিপ্রবরকে খুঁজে বের করলেন। তাঁকে মাংস ও অন্নগ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন।
ব্রাহ্মণ তখন নিজে না খেয়ে শিবিকে বললেন, সেই মাংস তিনি যেন ভক্ষণ করেন। শিবি তখন শান্তভাবে ব্রাহ্মণের ঐ আদেশ পালন করতে যাচ্ছেন, তখন ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। শিবি তখন দেখলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পুত্র বৃহদগর্ভ। আর ঐ ব্রাহ্মণ ছিলেন আসলে বিধাতা ভগবান। তিনি শিবি রাজাকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। এই ছিল শিবি চরিত্র যা, বাস্তবে অবিশ্বাস্য। এক মানবের অতিমানব, মহান পুণ্যাত্মা হয়ে ওঠার কাহিনী।
শিবিকে এই নিয়ে তাঁর মন্ত্রীবর পরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি করে আপনি এত সাহস পান? আপনি কি শুধুই যশের লোভে এমন অদেয় বস্তু দান করেন ?
উত্তরে শিবিরাজ বলেছিলেন— আমি যশ ও ঐশ্বর্য লাভের আশায় এমন দান করি না। ভোগের কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। ধর্মাত্মা ব্যক্তিরা যে পথ দেখিয়ে গেছেন, আমি শুধুই তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করে চলেছি।
গল্পটি মহাভারতের বনপর্বের ১৯৩ তম অধ্যায়ে আলোচিত আছে।
0 Comments