ভারতের জাতীয় মহাকাব্য মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনী
পর্ব -01(প্রতি দিন সন্ধ্যায় পোস্ট )
🥺🥺🥺🥺🥺🥺🥺🥺🥺🥺
আজকের পর্ব : মুনি আস্তিকের কাহিনী
🧞🧞🧞🧞🧞🧞🧞🧞
✍✍✍✍✍✍✍✍✍✍✍
আব্দুল মুসরেফ খাঁন// পাঁশকুড়া
✍✍✍✍✍✍✍✍✍✍
আস্তিক মুনির নাম স্মরণ করে আমরা সর্প ভয় দূর করি। কেন এই ভয় দূর হয় ? সাপেদের সঙ্গে আস্তিক মুনির সম্পর্ক কী ? – এ নিয়ে আমরা অনেকে কৌতুহলী। বলাবাহুল্য, আস্তিক মুনির জন্ম বৃত্তান্ত অন্য সাধারণের মতো নয়। তাঁর জীবন ছিল রীতিমতো ব্যতিক্রমী এবং ঘটনাবহুল। মজার ঘটনা হলো এই যে, আস্তিক মুনির পিতা এবং মাতা উভয়ের নাম ‘জরুৎকারু’। ‘জরুৎকারু' নামটি এসেছে 'জরা' অর্থাৎ ক্ষয় এবং ‘কারু’ অর্থাৎ ‘দারুণ’ থেকে। উভয়ের শরীর আগে সুস্থ ও সবল ছিল; পরে জীর্ণ ও ক্ষীণাকার হয়েছে— তাই ‘জরুৎকারু’। বাসুকি নাগের বোন জরৎকারু দীর্ঘদিন ধরে কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যা করার ফলে শীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁর নাম হয়েছিল ‘জরুৎকারু’। অন্যদিকে আস্তিক মুনির পিতাও শীর্ণ ও দুর্বল ছিলেন তাই তাঁর নামও জরুৎকারু । এখন প্রথমে জেনে নেওয়া যাক মুনি আস্তিকের জন্মগ্রহণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঘটনাসমূহ; এবং পরে আলোচনা করা যাবে তিনি কিভাবে সপর্বংশ ধ্বংস হওয়াকে রোধ করে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন— সে সম্পর্কে। আস্তিক মুনির পিতা জরুৎকারু ছিলেন একজন যথার্থ যোগী ঋষি। তিনি আজন্ম ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। জপ, তপ, সংযম ও স্বাধ্যায়ে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তখন ছিল রাজা পরীক্ষিতের রাজত্বকাল। ঋষি জরৎকারু একজন স্বভাব পরিব্রাজক। ভ্রমণ করতে করতে যেখানে সন্ধ্যা নামতো সেখানেই তিনি রাত্রি যাপন করতেন। কঠোর ব্রত ও নিয়মনিষ্ঠার মোড়কে তাঁর জীবনচর্যা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। সর্ব সাধারণের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর খাদ্যাভাসেও ছিল ব্যতিক্রমী সংযম। প্রয়োজনে বায়ু পান করেও তিনি শরীর ধর্ম পালন করতে পারতেন। তাই তাঁর শরীর ছিল ক্ষীণকায়।
একদিন ভ্রমণ করতে করতে ঋষি জরুৎকারু একটি অত্যাশ্চর্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন। দেখলেন, একটি পরিখার মধ্যে কয়েকজন পিতৃপুরুষ মাথা নিচের দিকে করে সামান্য একগোছা শুষ্ক তৃণ আঁকড়ে ধরে ঝুলে আছেন। একটি ইঁদুর সেই
তৃণমূলটিকে ধীরে ধীরে কাটছে। সেই পিতৃপুরুষেরা ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে অনাহারী এবং দুর্বল। জরুৎকারু কৌতুহলী হয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন— “আপনারা কারা ? আপনাদের পরিচয়ই বা কী ? কেনই বা এভাবে তৃণ আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে ঝুলে আছেন ? ইঁদুরটি তৃণমূলটুকু কেটে দিলে আপনারা তো পরিখার মধ্যে পড়ে যাবেন। আপনাদের এই নিদারুণ অবস্থা দেখে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়েছি। বলুন, আমি আপনাদের কোন্ প্রয়োজনে লাগতে পারি ? আমি প্রয়োজনে আমার তপস্যালব্ধ সকল কর্মফল দিয়ে আপনাদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করবো। আমাকে দয়া করে সেই সুযোগটুকু দিন।”
পিতৃপুরুষেরা প্রত্যুত্তরে বললেন— “আপনি একজন ব্রহ্মচারী, তপস্বী। আমরা অত্যন্ত খুশি এই জেনে যে, আপনি আমাদের এই দুরবস্থা থেকে বাঁচাতে চান। কিন্তু হে ঋষি! আমাদের কোনো তপস্যালব্ধ ফল দ্বারা এই সমস্যাটি সমাধানযোগ্য নয়। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদেরও যৎকিঞ্চিৎ তপস্যা-লব্ধ ফল আছে। আমাদের সামনে বিপদ এই যে, আমাদের বংশ-পরম্পরা লোপ পেতে চলেছে। আপনি যথেষ্ট প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ । আপনি যেহেতু আমাদের দুরবস্থা সম্পর্কে সহানুভূতিশীল তাই আমরা আমাদের দুর্দশার কারণ বৃত্তান্ত বলছি— শ্রবণ করুন।
আমরা যাযাবর ঋষি। আমাদের একজন উত্তরপুরুষ আছে। তার নাম জরৎকারু। কিন্তু সে কেমন আছে এবং কোথায় আছে, তা আমরা জানি না। সে একজন তপস্বী, সংযমী, উদারমনা ও যশস্বী পুরুষ। আমাদের বংশ রক্ষা করতে পারে আমাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী জরৎকারু। আপনি তো একজন পরিব্রাজক, সন্ন্যাসী পুরুষ। ভ্রমণকালে কোনদিন কোথাও যদি জরৎকারুর সাক্ষাৎ পান তাহলে তাকে আমাদের দুর্দশার কথা বললেন। সে যেন এসে আমাদের উদ্ধার করে; এই কথাও তাকে জানাবেন। সেই সঙ্গে এও বললেন যে, তোমার পূর্বপুরুষেরা হেঁটমুণ্ড অবস্থায় পরিখার অভ্যন্তরে ঝুলছে। তুমি যদি বিবাহ করে সন্তান আনতে পারো, সেই সন্তানই শেষ পর্যন্ত তাঁদের উদ্ধারে সক্ষম হবে। এই যে ইঁদুরটিকে দেখছেন, ইনি আসলে হলেন মহাকাল । তিনি একটু একটু করে শুধু আমাদের জীবনদীপ নয়, আমাদের একমাত্র পুত্র জরুৎকারুর জীবন দীপটিও রসদশূন্য করে চলেছেন। যেদিন জরৎকারুর জীবন দীপটি পুরোপুরি নিভে যাবে, সেদিন আমরাও ইহলোক ছেড়ে চলে যাব।”
পিতৃকুলের মুখে এমন হৃদয়-বিদারী বৃত্তান্ত শুনে জরুৎকারু নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। পিতৃপুরুষদের ঋণশোধ করার জন্য তিনি যে কিছুই করেন নি- সেই জন্য নিজেকে বারবার ধিক্কার জানাতে লাগলেন। আবেগপূর্ণ কণ্ঠে তিনি তখন বললেন-
“আমি হলাম আপনাদের সেই অধম পুত্র জরৎকারু। আপনারা আমার পিতা ও পিতামহ । আমি এতদিন স্বার্থপরের মতো নিজের হিত ও উন্নতিসাধনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। কোনদিন আপনাদের কথা ভাবিনি। এখন যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করে কলুষমুক্ত হতে চাই। দয়া করে আমাকে কি করতে হবে বলে দিন।”
পিতৃপুরুষেরা জরৎকারুর এই আকস্মিক পরিচয়-দানে বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। মৃতপ্রায় জীবন-তরীতে তাঁরা দেখতে পেলেন এক টুকরো আশার আলো। বললেন— “পুত্র! আমরা কোনদিন ভাবতে পারিনি যে, তুমি স্বয়ং কোনোদিন এভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। এখন বলো, তুমি কেন এতদিন বিবাহ করো নি ?”
জরৎকারু করজোড়ে বললেন- “হে পিতা! আমার ইচ্ছা ছিল এই যে, আমি সারা জীবন অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালন করবো এবং অক্ষয় স্বর্গসুখ লাভ করবো। কিন্তু আপনাদের দেখা পেয়ে আমি আমার সিদ্ধান্ত বদল করেছি। বিবাহের জন্য তৎপর হচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি, সুবিধা পেলেই আমি বিবাহ করবো এবং ভিক্ষালব্ধ কন্যার পাণিগ্রহণ করবো। তবে এক্ষেত্রে আমার কিছু শর্ত আছে। আমি এই কন্যার ভরণ- পোষণের ভার গ্রহণ করতে পারবো না; এবং আমার উচিত কর্মে তিনি অন্তরায় হলে আমি এই বিবাহ অস্বীকার করে তপস্বীর বেশে পুনরায় ঋষি-জীবনে ফিরে যাবো। যাইহোক, আপনারা আশ্বস্ত হবেন যে, আমার দ্বারা সন্তান লাভ হবে, এবং সেই সন্তান আমাদের বংশকে রক্ষা করবে। আপনারাও একদিন পরম সুখে পরলোক প্রাপ্তি করতে পারবেন।”
জরৎকারু এভাবে তাঁর পূর্বপুরুষদের আশ্বস্ত করে এক নতুন জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু বিবাহের জন্য উপযুক্ত কোনো পাত্রীর সন্ধান করা এক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে মোটেই সহজ কাজ ছিল না। প্রথমত, তিনি ছিলেন বয়সে প্রবীণ। কন্যার নাম আবার তাঁর নামের মতোই হতে হবে ‘জরুৎকারু। আবার বিবাহিত কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে তিনি অপারগ। এতগুলি শর্তকে মাথায় রেখে কন্যা *নির্বাচন করা তাঁর পক্ষে তখন বেশ অসম্ভব হয়ে পড়ছিল । তিনি এক সময় হত্যাশ বোধ করছিলেন। যে কারণে, একদিন মরিয়া হয়ে তিনি বনে প্রবেশ করলেন। এবং পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে তিনবার বললেন— “আমি বিবাহের জন্য একটি কন্যা প্রার্থনা করছি। এখানে চর-অচর, প্রকট বা গুপ্ত যাঁরা আছেন দয়া করে আমার এ প্রার্থনাটি শুনবেন। আমি আমার বংশ রক্ষার জন্য একটি কন্যা ভিক্ষা চাইছি। কন্যাটির নাম হতে হবে জরৎকারু।'
জরুৎকারুর এই আহ্বান বাসুকি নাগ নিযুক্ত একটি সর্প শুনতে পেলেন, এবং তিনি প্রভু বাসুকিকে তা তৎক্ষণাৎ পরিবেশন করলেন। বাসুকি নাগেরও একটি অবিবাহিতা ভগিনী ছিলেন, নাম 'জরৎকারু'। তিনি নিজ ভগিনীকে এই বিবাহে সম্মত করালেন। এবং ঋষি জরৎকারুর হাতে ভিক্ষা রূপে তাঁর ভগিনীকে তুলে দিলেন। পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে বাসুকি বললেন- “এই তপস্বিনী কন্যা আমার ভগিনী, নাম 'জরুৎ কারু'। আমি আপনার প্রাক-বিবাহের শর্তগুলি শুনেছি। আপনি আমার ভগিনীকে বিবাহ করুন। ভয় নেই, এর ভরণ-পোষণের দায়ভার আমি বহন করবো। আপনি শুধুমাত্র আমার ভগিনীকে বিবাহ করে আমাদের বংশরক্ষার সহায়ক হোন।”
ঋষি জরৎকারু উদ্বেগ-মুক্ত হলেন। তবে অন্তিম শর্ত হিসাবে বললেন— “এই কন্যাকে কথা দিতে হবে যে, তিনি আমার কোন অপ্রিয় কাজ করবেন না, এবং যদি তা কখনো করেন, আমি তৎক্ষণাৎ এই বিবাহ অস্বীকার করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাব।”
বলাবাহুল্য, ঋষি জরৎকারুর অস্তিম শর্তটিও নাগরাজের দ্বারা স্বীকার করে নেওয়া হলো। এরপর সকলে নাগরাজ বাসুকির গৃহে গমন করলেন। সেখানে সকল নিয়মবিধি মেনে জরৎকারু দম্পতির বিবাহ সম্পন্ন হলো। তারপর নাগরাজের দেওয়া একটি সুন্দর বাসভবনে তাঁরা তাঁদের গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করতে লাগলেন।
একদিন মুনি জরৎকারু ক্লান্ত হয়ে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। দিন গড়িয়ে সূর্য ঢলে পড়লো। ঋষি-পত্নী চিন্তিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, তাঁর স্বামী জরৎকারুর স্নান, পূজার্চনা এবং আহারাদি তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি বিলক্ষণ জানতেন যে, তাঁর স্বামী এসব কাজে অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ। সূর্যাস্তের পর কোনভাবেই এগুলি করা যায় না। ঋষি আবার অত্যন্ত মেজাজী এবং ক্রোধী। তাঁকে জোর করে নিদ্রাভঙ্গ করালে তিনি তা কিছুতেই মেনে নেবেন না। অর্থাৎ একদিকে স্বামীর ধর্মরক্ষা, অন্যদিকে তাঁর মেজাজ-রক্ষা; এমন উভয় সঙ্কটে পড়ে স্ত্রী জরুৎকারু শেষ পর্যন্ত স্বামীর ধর্মরক্ষার প্রয়োজনটিকে প্রাধান্য দিলেন এবং তাঁর নিদ্রাভঙ্গ ঘটালেন। বললেন- “হে মহাভাগ, উঠে পড়ুন, সূর্যাস্ত হলো বলে। স্নান সম্পন্ন করে পূজার্চনা করুন।”
পরীর ডাকে ঋষির নিদ্রাভঙ্গ হলো। তবে এভাবে তাঁর অনিচ্ছায় নিদ্রাভঙ্গ করানোর জন্য স্ত্রীর তিনি প্রতি ভীষণ কুপিত হলেন। বললেন- “সপিনী, তুমি আমার নিদ্রাভঙ্গ করেছো, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছো। আমাকে অপমান করেছো। আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে আর থাকবো না। যেখানে ছিলাম, সেখানে চলে যাবো।”
ঋষি পত্নী তখন কাদতে কাদতে বললেন- “নাথ! সূর্যাস্ত সমাগত প্রায়। অথচ আপনার স্নান, পূজার্চনা ইত্যাদি হয়নি, এইসব ভেবে একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমি অসময়ে
আপনার নিদ্রাভঙ্গ করেছি। আমাকে মার্জনা করুন। আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন।”
ঋষি প্রত্যুত্তরে বললেন— “আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম যে, আমি নিদ্রামগ্ন থাকলে সূর্য কখনোই অস্ত যেতে পারতো না।”
ঋষি-পত্নী অসহায় হয়ে বললেন- “আপনাকে অপমান করার ধৃষ্টতা আমার নেই। আপনার ধর্মাচরণে যাতে কোন বিঘ্ন না হয় তা ভেবেই আমি এই কাজ করেছি।” ঋষি পত্নীর এই ব্যাখ্যায় ঋষির ক্রোধ সামান্য প্রশমিত হলেও ক্ষতি যা হওয়ার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে । জরৎকারু এবার বললেন- “মুখ নিঃসৃত ব্রহ্মাবাক্য কখনোই ব্যর্থ হয় না। আমি এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমাদের বিবাহের পূর্বে আমাদের মধ্যে এমন শর্তই স্বীকৃত ছিল। আমি চলে যাওয়ার পর তোমার দাদা বাসুকি নাগকে সমস্ত কিছু জানাবে। আমার চলে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না।”
ঋষি জরৎকারুর এভাবে নেওয়া আকস্মিক বিবাহ-বিচ্ছেদ সিন্ধান্তে ঋষি-পত্নী শোকে বিহ্বল এবং বাকরুদ্ধা হলেন। দুচোখে অশ্রুসিক্তা হয়ে শেষবারের মতো করজোড়ে বললেন- “হে ধর্মজ্ঞ! আপনি এই অভাগিনীকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন না। আপনি জানেন যে, আমাদের এই বিবাহ বিশেষ একটি উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। আমার ভ্রাতৃকূল মাতা কদ্রুর অভিশাপগ্রস্ত হয়ে আছেন। আমাদের সন্তানই কেবল তাঁদের শাপমুক্ত করতে সক্ষম। এখন যদি সেই উদ্দেশ্য পূরণ না হয়, আমরা যদি কোনো সন্তানের জনক-জননী না হই; তাহলে এই বিবাহ ব্যর্থ হয়ে যাবে। শাপগ্রস্ত ভ্রাতাদের পরিণতি কী হবে ?”
পত্নীর কথায় জরৎকারু ঋষি বললেন— “চিন্তা কোরো না। তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান বড় হচ্ছে। তুমি অচিরেই অগ্নির ন্যায় তেজস্বী, বিদ্বান ও ধর্মাত্মা এক পুত্রের জননী হতে চলেছো।” –এই কথা বলে আর কাল-বিলম্ব না করে ঋষি জরৎকারু
প্রস্থান করলেন।
ঋষি জরৎকারু চলে যাওয়ার পর ঋষি-নির্দেশ মত ঋষি-পত্নী ভ্রাতা বাসুকিকে স্বামীর গৃহত্যাগের দুঃসংবাদটি জানালেন। বাসুকি এই ঘটনা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। তিনি জানতে চাইলেন— “বোন! যে জন্য তোমার বিবাহ দিয়েছিলাম, তা কি সফল হয়েছে ? তুমি কি কোন সন্তান ধারণে সক্ষম হয়েছে ? তুমি তো জানো ব্রহ্মার নির্দেশ অনুসারে একমাত্র তোমার সন্তানই জনমেজয়ের যজ্ঞাগ্নি থেকে নাগকুলকে রক্ষা করতে সক্ষম।"
ঋষি-পত্নী ভ্রাতা বাসুকিকে বললেন– “আমি এই প্রশ্ন তাঁকে করেছিলাম। উনি আমাকে বলেছেন যে, আমি গর্ভধারণ করেছি। আমি জানি, তাঁর মুখ-নিঃসৃত বাক্য, ব্রহ্মবাক্যের মতো সত্য ও শাশ্বত।”
এই কথা শুনে বাসুকি অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। এরপর বিশেষ স্নেহ ও যত্ন দিয়ে প্রিয় বোনকে আদর করতে লাগলেন। অন্যদিকে মাতা জরৎকারুর গর্ভে বড় হতে লাগলো শুক্লা চাঁদের মতো সর্বগুণ সম্পন্ন একটি ফুটফুটে সন্তান ।
সময়ের ব্যবধানে মাতা জরুৎকারু এক দিব্য সন্তান জন্ম দিলেন। এই সস্তান তার পিতৃ ও মাতৃকুলের বংশ রক্ষার অনিশ্চয়তা দূর করলো। সেই সন্তান একটু বড় হলে তাকে পাঠানো হলো চ্যবন মুনির আশ্রমে, বেদ অধ্যয়নের জন্য। এই ব্রহ্মচারী বালক বাল্যাবস্থা থেকেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং সাত্ত্বিক ছিলেন। মাতৃগর্ভে থাকার সময় তাঁর পিতা তাঁর সম্পর্কে উক্তি করেছিলেন— 'অস্তি' অর্থাৎ আছে। তাই তার নাম হয়েছিল ‘আস্তিক'। বালক আস্তিক জন্ম থেকেই মাতুল বাসুকির অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। এই বালক বড় হয়ে ‘আস্তিক মুনি' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পিতৃ ও মাতৃকুলকে শাপমুক্ত করে বংশের গৌরব বৃদ্ধি করেন।
এখন আলোচনা করা যাক; মুনি আস্তিক কিভাবে তাঁর পিতৃ ও মাতৃকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তার আগে সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক রাজা জনমেজয় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কেন সর্পসত্র বা সর্পনিধন যজ্ঞ করেছিলেন।
রাজা জনমেজয়ের পিতা ছিলেন কৌরব বংশীয় রাজা পরীক্ষিৎ । তিনি ছিলেন রাজা পাণ্ডুর ন্যায় মৃগয়া-বিলাসী। একদিন মৃগয়ায় গিয়ে তিনি একটি হরিণকে শরবিদ্ধ করেন। কিন্তু শরাঘাত নিয়ে মুর্গটি দ্রুত পালাচ্ছিল। এবং রাজা পরীক্ষিৎ তাকে ধরার জন্য অনুসরণ করছিলেন। তা সত্ত্বেও হরিণটি নিমেষে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। রাজা পরীক্ষিতের তখন বয়স ছিল ষাট বছর। তার ওপর তিনি ছিলেন ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। তাই সামান্য পরে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এমন সময় তিনি সামনে একটি ঋষি-আশ্রম দেখতে পেলেন। আশ্রমে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন, একজন ঋষি চুপচাপ বসে আছেন। তাঁকে উদ্দেশ করে রাজা জানতে চাইলেন শরবিদ্ধ প্রাণীটিকে তিনি দেখেছেন কি-না ? আসলে ঋষি শমীক তখন মৌনীব্রত পালন করছিলেন। তাই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেন না। এতে হস্তিনাপুর-রাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সামান্য এক বনবাসীর এই আচরণ তিনি মোটেই সহজভাবে নিলেন না। তাই শাস্তিস্বরূপ দূরে পড়ে থাকা একটি মৃত সাপ ধনুকের একদিকে ধরে তিনি মুনির গলায় জড়িয়ে দিলেন। মুনিবর যেহেতু ছিলেন ধ্যানমগ্ন; তাই রাজার এই আচরণে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না।
মৌনী ঋষি শমীকের পুত্রের নাম ছিল ‘শৃঙ্গী’। পিতার ন্যায় তিনিও ছিলেন সিদ্ধপুরুষ, তেজস্বী ও বলশালী। তিনি তাঁর বন্ধুদের মুখে শুনলেন যে, রাজা পরীক্ষিৎ সামান্য আগে কিভাবে তাঁর পিতাকে অপমান করে গিয়েছেন। এই অপমান তিনি সহজে মেনে নিতে পারলেন না। তাঁর পিতার প্রতি রাজা পরীক্ষিতের এই আচরণে তিনি ভীষণ কুপিত হলেন। এবং তখনই কমণ্ডলু থেকে জল হাতে নিয়ে রাজাকে অভিশাপ দিলেন— “যে ব্যক্তি আমার পিতার কাঁধে মৃত সাপ জড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিকে সাত দিনের মধ্যে তক্ষক নাগ দংশন করবে।”
সামান্য পরে পিতা ঋষি শমীককে গিয়ে শৃঙ্গী সব কথা খুলে বললেন। ঋষি, পুত্রের এই আচরণে মোটেই খুশি হননি। বরং তাঁর প্রিয় শিষ্য গৌরমুখকে রাজা পরীক্ষিতের কাছে পাঠালেন। গৌরমুখ ঋষির অভিশাপ এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কে রাজাকে সতর্ক করালেন। বলাবাহুল্য, সেইদিন থেকেই রাজা পরীক্ষিৎ ভয়ে ভয়ে দিন গুনতে থাকলেন।
সপ্তম দিনে তক্ষক নাগ যখন রাজা পরীক্ষিতের বাসভবনের দিকে আসছিলেন তখন পথে কাশ্যপ নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তক্ষক ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে ব্রাহ্মণদেব! কোথায় চললেন ?”
উত্তরে ব্রাহ্মণ বললেন- “আজ তক্ষক নাগ রাজা পরীক্ষিতকে বিষে জর্জরিত করবে। তাঁর প্রাণ রক্ষার্থে আমি রাজবাড়ি যাচ্ছি।”
তক্ষক তখন নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন— “আমি যদি রাজাকে দংশন করি আপনি তাকে বাঁচাতে পারবেন ?” এই দেখুন আমার ক্ষমতা— এই বলে সামনের একটি বৃক্ষে তক্ষক দংশন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃক্ষটি পুড়ে শুষ্ক কাষ্ঠে পরিণত হলো।
এরপরেই ব্রাহ্মণ কাশ্যপ তার অর্জিত শক্তি বলে মৃত গাছটি পুনরায় ফল-ফুল- পাতায় সজীব করে তুললেন। ব্রাহ্মণের এমন আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে তক্ষক চমৎকৃত হলেন এবং কার্যসিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণকে প্রলোভিত করতে শুরু করলেন। বললেন- “রাজবাড়ি না গিয়ে আপনি কি চান বলুন, আমি তা আপনাকে এক্ষুনি দিচ্ছি।”
ব্রাহ্মণ বললেন— “আমি তো অর্থলাভের আশায় রাজা পরীক্ষিতের ভবনে যাচ্ছি।” তক্ষক নাগ তা শুনে তখনই প্রত্যাশার চেয়েও অধিক অর্থ ব্রাহ্মণকে দান করলেন। ব্রাহ্মণ তা পেয়ে নিজ গৃহে ফিরে পেলেন। এরপর তক্ষক হস্তিনাপুরে গেলেন। সেখানে ছলনার আশ্রয় নিয়ে তিনি রাজ দরবারে প্রবেশ করলেন; এবং সুযোগ বুঝে রাজা পরীক্ষিৎকে বিষে জর্জরিত করে মেরে ফেললেন।
রাজা পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় তাঁর পিতার এমন করুণ মৃত্যু কাহিনী মন্ত্রীদের কাছে শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। পরে মন্ত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন— “কোথা থেকে আপনারা এই বিবরণ শুনেছেন ?”
মন্ত্রীরা বললেন- “মহারাজ! তক্ষক যে বৃক্ষে দংশন করেছিল সেই বৃক্ষে শুকনো কাঠ সংগ্রহের জন্য আগে থেকে এক ব্যক্তি ঐ গাছে উঠে বসেছিল। সে তক্ষক ও ব্রাহ্মণের কথাবার্তা শুনেছিল। আমরা তার মুখ থেকে এই ঘটনা শুনেছি।”
এরপর রাজা জনমেজয় পিতার অকাল মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তৎপর হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর পিতার অকাল মৃত্যুর জন্য তক্ষক নাগই ছিল মূল চক্রী। শৃঙ্গী ঋষির অভিশাপ এক্ষেত্রে উপলক্ষমাত্র । মুনি যতই অভিশাপ দিন, তাঁকে অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানালে তিনি হয়তো অভিশাপ ফিরিয়ে নিতেন। যাইহোক, এরপর তিনি আর কালবিলম্ব না করে রাজ-পুরোহিত ও ঋত্বিকদের রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন। বললেন— “দূরাত্মা তক্ষক আমার পিতার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আপনারা এর প্রতিবিধান করুন।”
তখন পুরোহিত এবং ঋত্বিকেরা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে রাজাকে বললেন— “মহারাজ। দেবতারা বহু আগে থেকেই আপনার জন্য এক বিশেষ যজ্ঞের বিধান দিয়ে রেখেছেন। আপনি সেই যজ্ঞ আয়োজন করুন। সেখানে তক্ষককে আহুতি দেওয়া হবে।”
পুরোহিতদের বিধান অনুসারে রাজা জনমেজয় শুরু করলেন সর্পনিধন বা সর্পসত্ৰ যজ্ঞ। ঋত্বিকদের পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণে যজ্ঞকুণ্ডের হোমাগ্নি শিখা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। ধোঁয়া ও তাপে ঋত্বিকদের মুখ রক্তিম হতে লাগল । তাঁরা কালো বস্ত্র পরে মন্ত্রোচ্চারণ ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপে যজ্ঞ-ক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। ওদিকে যজ্ঞের প্রভাবে সর্পকুল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তারা দিভ্রান্তের ন্যায় ছোটাছুটি শুরু করল। ক্রমে দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতে লেজ ও ফণায় জড়িয়ে তারা হোমের আগুনে একে একে পড়তে লাগল । বিভিন্ন রং-এর, ভিন্ন ভিন্ন আকারের, হাজার হাজার সাপ এভাবে একে একে যজ্ঞকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিতে থাকলো। সর্পকুল তখন সত্যিই এক চরম সঙ্কটে।
সর্পযজ্ঞের মূল ঋত্বিক ছিলেন চ্যবন বংশীয় ‘চণ্ড ভার্গব’। তাঁর নেতৃত্বে এবং কৌৎস, উদগাতা প্রমুখ আরও অনেক পুরোহিতবর্গের সক্রিয় অংশগ্রহণে এরপর শুরু হলো নাম ধরে ধরে বড় বড় সর্পদের আহুতি দেওয়া। সর্পদের পোড়া গন্ধে যজ্ঞস্থল ভয়ংকর হয়ে উঠল। ইতিমধ্যে তক্ষক নাগও বিচলিত হয়ে উঠলেন। তিনি প্রাণভয়ে ইন্দ্রের শরণাপন্ন হলেন। ইতিমধ্যে সর্পকুলের একটি বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। প্রায় অন্তিম পর্বে নাগরাজ বাসুকিও আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। পরিত্রাণের উপায় ভাবতে গিয়ে তিনি বোন জরৎকারুকে কাছে ডাকলেন। বললেন— “আমার সমস্ত অঙ্গ জ্বলছে, বুক ফেটে যাচ্ছে। লেলিহান শিখা যেন আমাকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে। তুমি এবার আমাদের বাঁচাও। তোমাকে বিবাহ দিয়েছিলাম ঠিক এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ভগবান ব্রহ্মার কথা অনুসারে তোমার পুত্র আস্তিক এই যজ্ঞ বন্ধ করতে পারে। তুমি এবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নাও।”
ভ্রাতা বাসুকির নির্দেশ অনুসারে ঋষি-পত্নী জরৎকারু পুত্র আস্তিককে সকল ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং নাগদের রক্ষা করার জন্য তৈরী হতে বললেন। মায়ের নির্দেশ পেয়ে আস্তিক মাতুল বাসুকির কাছে গিয়ে বললেন— “নাগরাজ! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই ঘোর বিপদ থেকে আমি সর্পকুলকে রক্ষা করবো। আমি মধুর বাক্যে রাজা জনমেজয়কে প্রসন্ন করবো। বন্ধ করবো এই ভয়ংকর যজ্ঞ।”
এভাবে সকলকে আশ্বস্ত করে আস্তিক যজ্ঞশালার দিকে রওনা হলেন। সেখানে দেখলেন যে, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে যজ্ঞক্ষেত্র ঘেরা আছে। দ্বাররক্ষক শত অনুরোধেও তাঁকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। তখন তিনি যজ্ঞের-স্তুতিগান গাইতে লাগলেন। এই যজ্ঞ স্তুতি শুনে রাজা জনমেজয় তাঁকে যজ্ঞশালায় ঢোকার অনুমতি দিলেন। আস্তিক যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করে রাজা, পুরোহিত, ঋত্বিক, সভাসদ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্তুতি করলেন। এই স্তুতি-বাক্যে সকলে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন ।
আস্তিকের স্তুতিবাক্যে এবং অন্য সকলের মনোভাব বুঝে রাজা জনমেজয় খুশি হয়ে বললেন— “যদিও এ একজন বালক কিন্তু তার বাক্যবিন্যাস অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো। আমি তার আচরণে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। তাকে প্রাপ্য বর দিতে চাই। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী ?”
সভাসদরা বললেন— “মহারাজ! ব্রাহ্মণ যদি বিদ্বান হন তাহলে সে বালক হলেও সকলের সম্মাননীয়; তাই এই বালক যদি কিছু চায় আপনি অবশ্যই তা পূরণ করতে পারেন।”
জনমেজয় বললেন- “আপনারা সকলে যজ্ঞের বাকি কাজগুলি যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করুন।”
ঋত্বিকেরা বললেন— “মহারাজ তক্ষক নাগ ভীত হয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিয়েছে।”
তা শুনে রাজা জনমেজয় বললেন- “আপনারা এমন মন্ত্র উচ্চারণ করুন যাতে ইন্দ্ৰ সহ তক্ষক নাগ এক্ষুনি যজ্ঞকুণ্ডে এসে পড়েন।”
তা শুনে যজ্ঞের কাজ নতুন উদ্যমে শুরু হলো। সেই সময় আকাশে ইন্দ্র ও তক্ষক নাগকে দেখা গেল। যদিও ইন্দ্র এক সময় ভয় পেয়ে তক্ষককে ত্যাগ করে চলে গেলেন। তক্ষক সেই মুহূর্তে হোমাগ্নির কাছাকাছি চলে এলেন।
রাজা জনমেজয় তখন বললেন— “ব্রাহ্মণকুমার! তুমি এখন কি চাও বলো।” তা শুনে আস্তিক বললেন- “হে রাজন! আমি চাই এই মুহূর্তে এই যজ্ঞ বন্ধ হোক। হোমাগ্নিতে পড়তে থাকা সকল সর্প যেন রক্ষা পায়।”
রাজা জনমেজয় এমন বরের প্রার্থনা শুনে বিরক্তিবোধ করলেন। বললেন- “তুমি এই বর ছাড়া অন্য কোন প্রার্থনা কর। আমি এখনই তা পূরণ করবো।”
কিন্তু আস্তিক তার প্রার্থনায় অনড় রইলেন এবং বললেন– “আমার পিতৃ ও মাতৃকুলের কল্যাণের জন্য এই যজ্ঞ এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।”
এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকলে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সকলে বলতে থাকেন— “এই ব্রাহ্মণ তনয় যা চাইছে, একে তা দেওয়া উচিত।”
সভাসদগণ সহ সকলের ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে জনমেজয় সবশেষে ঘোষণা করলেন— “এই যজ্ঞ বন্ধ হোক। আস্তিকের ইচ্ছা পূরণ হোক।”
যজ্ঞ সমাপ্তির ঘোষণা শুনে সকলে আনন্দ প্রকাশ করলেন। যজ্ঞান্তে পুণ্যস্নান করে যথোচিত দানধ্যান ও ভজন পূজনের মাধ্যমে যজ্ঞ সম্পন্ন হলো। আস্তিককে সম্মাননা ও সৎকার করে শেষে বিদায় জানানো হলো। এখন প্রশ্ন হলো ইন্দ্র চলে গেলেও তক্ষক কেন হোমকুণ্ডে পড়েন নি ? এর কারণ হলো ইন্দ্ৰ চলে যাওয়া মাত্র তক্ষক সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তখন আস্তিক তিনবার দাঁড়াও। দাঁড়াও। দাঁড়াও! উচ্চারণ করেন। তক্ষক তখন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে ছিলেন। তাই হুতাশনে পতিত হলেন না । এইভাবে সপকূলের সমূহ বিনাশ থেকে রক্ষা করে আস্তিক ‘সৰ্পকূল ত্রাতা' হিসাবে পরিচিত হলেন।
এরপর আস্তিক গৃহে ফিরে এসে মাতা জরৎকারুকে সবিস্তারে ঘটনাগুলি জানালেন। যজ্ঞ থেকে যে সমস্ত সর্প বেঁচে ফিরেছিল, তারা সকলে আস্তিককে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলো। তারা বারবার বলতে লাগলো- “পুত্র, তোমার জন্য আমরা মৃত্যুমুখ থেকে ফিরতে পেরেছি। বলো তোমার জন্য আমরা কি করতে পারি ?”
আস্তিক তখন বললেন— “আমি এই বর প্রার্থনা করি; ‘যদি প্রসন্ন চিত্তে সন্ধ্যা সকালে কেউ এই মধুর উপাখ্যান পাঠ করে তার যেন সর্পভয় দূর হয়” ।”
আস্তিকের প্রার্থনা শুনে উপস্থিত সকলে সমস্বরে বললেন- “পুত্র তোমার ইচ্ছা পূৰ্ণ হোক । ”
এই ভাবে সর্পভয় থেকে রক্ষা পেতে আজও সকলে মহামুনি আস্তিকের নাম স্মরণ করে আসছে। অন্যদিকে নাগকুল রক্ষায় আস্তিক মুনির সেদিনের ভূমিকা আজও সকলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন।
#পৌরানিক #পুরাণ #মহাভারত
0 Comments