ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনে সংবাদপত্রের ভূমিকা
ভারতীয়
সংবাদপত্রের ইতিহাস ২৪১ বছরে পা দিল। ১৭৮০
সালের ২৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ
নাগরিক জেমস আগাস্টাস হিকি র হাত ধরে
‘ The Bengal Gazette or Calcutta General Advertiser ‘ প্রকাশের মধ্যে
দিয়ে যে ইতিহাসের সূচনা
তা কালের মধ্যে দিয়ে আজ নানা রূপে
বিকশিত। প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই এই সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ।
সেই ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম। একটি সংবাদপত্র নিছকই কিছু তথ্যের সমষ্টি নয়। একটি সংবাদপত্র কিন্তু একটা ইতিহাসের দলিল। তা হতে পারে
সংবাদের ইতিহাস, হতে পারে ভাষার ইতিহাস, হতে পারে আদর্শের ইতিহাস, হতে পারে সমাজের ইতিহাস, হতে পারে আন্দোলনের ইতিহাস, কিছুটা সাহিত্যের ইতিহাসও হতে পারে। এছাড়া মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতির বিকাশ বা অধপতনের ইতিহাসও
হতে পারে সংবাদপত্র। এতো ইতিহাস ধরে রাখার সামর্থ্য আর কার আছে
— এক সংবাদপত্র ছাড়া। একটা সংবাদপত্রে কী নেই ! সকাল
হলেই সমগ্র বিশ্ব সংবাদ আপনার আমার হাতের মুঠোয়। এমন একটি ক্ষেত্রের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হতে পেরে আমি নিজে গর্বিত।
একটা
দেশের আর্থ সামাজিক পরিবর্তনে সংবাদপত্র কী ভূমিকা নিতে
পারে বিশ্ববাসী তার প্রথম টের পেয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়। ফ্রান্সের বুর্বোন রাজবংশের বিরুদ্ধে লাগাতার কলম ধরেছিলো সেই দেশের সংবাদপত্র। এই সংবাদ মাধ্যমকে
ব্যবহার করেছিলেন সেই দেশের প্রথম সারির লেখক শিল্পীরা। ঠিক একইভাবে পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে লাগাতার জনমত গড়ে তুলতে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছিল ভারতীয় সংবাদপত্র। সেই সময়ের সমস্ত প্রথম সারির জাতীয় নেতারা দাদাভাই নৌরোজি থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, আজাদ, প্যাটেল, লাল বাল পাল বলে বিখ্যাত ত্রয়ী, অরবিন্দ, নেতাজি, চিত্তৰঞ্জন কে ছিলেন না
তালিকায়। নিজেদের বক্তব্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার মাধ্যম ছিল এই সংবাদপত্র। এমনকি
শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের মানুষজনও সংবাদপত্র কে হাতিয়ার করেছিলেন।
রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ কে ছিলেন না
তালিকায়। তাই বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক এ আর দেশাই
তাঁর ‘ সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম
‘ বইতে বলেছেন, “The press played
an important role in building and developing Indian nationalism and the
nationalist movement. The national movement, on its political side, was
possible because of the facility of political education and propaganda provided
by the press. ” তিনি
আরও লিখেছেন, ” With its help,
the Indian natiinalist groups were able to popularise among the people the idea
of representative government, liberty, democratic institutions, home rule,
dominion status and independence. ” এক
কথায় ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে দারুন ভূমিকা নিয়েছিল সংবাদপত্র। সেদিনের সংবাদপত্র শুধু রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশন করে নি, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। রামমোহন রায়ের ‘সংবাদ কৌমুদি ‘ বাংলার মানুষের চেতনা বৃদ্ধিতে কী ভূমিকা নিয়েছিল
তা ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন। দিকদর্শন, সমাচার দর্পন, সংবাদ প্রভাকর, বেঙ্গল গেজেট, সোমপ্রকাশ, তত্ত্ববোধনী, প্রবাসী, বন্দে মাতরম, নিউ ইন্ডিয়া,ধূমকেতু, লাঙল, অমৃতবাজার, যুগান্তর বসুমতী একে একে বহু সংবাদপত্র তা সাপ্তাহিক থেকে
পাক্ষিক, দৈনিক সমস্ত ধরনের পত্র পত্রিকার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো। আর বারে বারে
আইন পাশ করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এমনকি গ্রেফতার পর্য্যন্ত হয়েছেন সংবাদপত্রের মালিক সম্পাদকরা। ইলবার্ট বিল থেকে শুরু করে ভের্নাকুলার প্রেস এক্ট সবই করেছে তখনকার সংবাদপত্র। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার সংবাদপত্র কী ভূমিকা নিয়েছিল
তা তো আমরা সবাই
জানি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি
হচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেকের অবদান স্মরণ করা হবে। সংবাদপত্রের অবদানও কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। মহাত্মা গান্ধী নিজে ‘হরিজন’, ইয়ং ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন
তিনটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। লিখতেন। সমাজ সংস্কার ও ব্রিটিশ বিরোধী
জনমত গঠন করতে গান্ধীজি এই সংবাদপত্র গুলিকে
ব্যবহার করতেন। এই সংবাদপত্র গুলি
পড়েই আজও আমরা গান্ধীজির মত ও পথ
জানতে পারি। তিনি সংবাদপত্র কে ‘ unsleeping guardian ‘
বলে উল্লেখ করেছেন।বিশিষ্ট সাংবাদিক গবেষক মোহিত মৈত্র মন্তব্য করেছেন, ” In India in
bondage, the press played its distinctive role as the crusading agent for the “political
emancipation ” of the country. ” ব্রিটিশ
বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা এই সংবাদপত্র কে
হাতিয়ার করেছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু র ‘ ফরওয়ার্ড ব্লক ‘ পত্রিকার কথা কে না জানে।
সেদিন গোটা দেশ জুড়ে বিভিন্ন প্রদেশে বহু সংবাদপত্র ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল। অর্থাৎ দেশের মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তৈরী করতে আরও ভালো করে বলতে গেলে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরী করতে মূল ভূমিকা নিয়েছিল সংবাদপত্র। তাই বিখ্যাত লেখক সাংবাদিক মোহিত মৈত্র তাঁর A History of
Indian Journalism ‘ বইতে
লিখেছেন, ” The press
thus gradually became the mouthpiece of suffering people “. যদিও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তা বদলে যায়।
0 Comments